আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা…

আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা…

যত্নে চয়ন করা সব শব্দ আপন মনের খেয়ালে সাজিয়ে গুছিয়ে একজন যে চিত্র  এঁকে গেছেন তা আমাদের আত্মাকে আপ্লুত করে বার বার। তাঁর কবিতা পড়ে কে সুদর্শন, কে বা বনলতা, কোথায় বা মালয় সাগর জানার জন্য মননে তৃষ্ণা জেগে উঠে । মেধামননে  যার মস্তিস্ক এবং অতলান্তিক অনুভূতিতে যার হৃদয় অসাধারন ঋদ্ধ, মানুষের অন্তরকে ছুঁয়েছেন যিনি আপন অলৌকিক মাধুর্যে তাঁরই চারপাশের সফল, গুনী ও কৃতবিদ্য সমৃদ্ধ মানুষের সাথে হয়নি তেমন সখ্যতা, হৃদ্যতা। তাই বোধহয় নিজেকেই চুপি চুপি বলেন

‘সকল লোকের মাঝে ব’সে

আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আমি একা হতেছি আলাদা?

আমার চোখেই শুধু ধাঁধাঁ?

আমার পথেই শুধু বাধা?’

( উৎস:কবিতার শিরোনাম ‘বোধ’ কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’)

বেশীর ভাগ সৃজনশীল মানুষের নিয়তি বোধহয় এই ই। নিজের ভুবনে ডুবে থাকা তার চরিত্র। কোথায় পড়লাম যেন, একবার কলকাতার কোন এক রাস্তায় তাঁকে দেখতে পেয়ে কবি বুদ্ধদেব বসু তার দিকে যখন পা চালালেন উঁনি তার চেয়ে দ্রুত গতিতে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেললেন। যদিও নিজের মুদ্রা দোষে নিজেই একা হয়েছেন তবে অবাক হতে হয় নিজের বিষয়ে  বা তাঁর সৃষ্টির  ভবিতব্য নিয়ে এই কবির আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয় দেখে। তাই কাব্যে লিখিত তাঁর নিজস্ব বয়ান

‘একদিন শুনেছ যে-সুর-

ফুরায়েছে,-পুরানো তা-কোন এক নতুন কিছুর

আছে প্রয়োজন,

তাই আমি আসিয়াছি,-আমার মতন

আর নাই কেউ!

সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ’

(উৎস:কবিতার শিরোনাম ‘কয়েকটি লাইন’ কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’)

আসলেই তিঁনি নতুন এক চিত্র এঁকে গেছেন, আসলেই এই কবি সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে এক ঢেউ। বিশ্বব্রহ্মান্ডে অগুনতি প্রাণ জন্ম থেকে জীবন নামের নৌকা বেয়ে মৃত্যুতে পৌঁছেছে বা মৃত্যুর কোলে ঠাঁই নিয়েছে। আদিকাল থেকে এমনি হয়ে আসছে এবং আরও হয়ে যাবে। কিন্তু কতজন সৃষ্টি নামে সমুদ্রের বুকে ঢেউ বা তরঙ্গ তুলতে পারে? কতজন পারে সে ঢেউ ছড়িয়ে দিতে দূরে, বহু দূরে  স্থান-কাল ও ব্যক্তিমানসের  নানা  স্তরে স্তরে।

এতোক্ষণে পাঠকেরা বুঝে গেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ এমন একজন কবিই আছেন বাংলা সাহিত্যে যার কবিতা বহুল পঠিত, বহুল চর্চিত তিনি কবি জীবনানন্দ।

জীবনানন্দের জন্ম ১৮৯৯এ মৃত্যু ১৯৫৪তে। বেশীদিন বাঁচেন নি কবি। তবে দেখে মনে হয় কবির জন্ম নয় তাঁর মৃত্যুই বেশী চর্চিত হয়। অক্টোবরের ১৪তারিখে ১৯৫৪র কলকাতার ট্রাম লাইনে দূর্ঘটনায় কবলে পড়েন কবি। হসপিটালে ২২শে অক্টোবরে বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় কাব্যস্রষ্টা এই কবির মৃতু হয়। তাঁর মৃত্যু নিয়ে কত কথা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিৎষ্যতেও হয়তো হবে। বেঁচে থাকাকালীন প্রায় উপেক্ষিত ছিলেন কবি জীবনানন্দ। তবে তাকে নিয়ে নানান কর্মকান্ড সাক্ষ্য দেয়,  আমাদের চেতনায় সে বারতা পৌঁছায় যে জীবনানন্দকে জানার, বোঝার আগ্রহের পরিধি দেশ-কাল, জাতিতে সীমিত নয় আজ। প্রবন্ধের গোড়াতে বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। এখানে এই বক্তব্যের সমর্থনে একটি তথ্য তুলে ধরছি। চলন্ত ট্রামের ধাক্কায় আহত কবিকে প্রথম যে ব্যক্তি উদ্ধার করেন ইনি ছিলেন কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউর একজন চা দোকানী। যার নাম চুনিলাল। কবির মৃত্যুর ১৬বছর পর এই চুনিলালের সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলেন মার্কিন গবেষক লেখক প্রখ্যাত জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞ ক্লিন্টন বি সিলি। চুনিলালের সাথে ক্লিন্টন বাংলায়ই কথা বলেছিলেন। উল্লেখ্য যে আমাদের সাথেও আমেরিকা থেকে এক জুম আড্ডায় অংশ নিয়ে এই সেদিনও প্রায় ৮০বছরের বেশী বয়সের সিলি বাংলাতেই আলাপচারিতা চালিয়েছিলেন।  ফারুক মঈনউদ্দীন কৃত ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ ‘আ পোয়েট আ্যাপার্ট’এর বাংলা অনুবাদের ভূমিকাতে দেখা যায় ক্লিনটন লিখছেন

‘সান্ধ্য ভ্রমণ শেষে বাড়ী ফিরছিলেন তিনি। তখনই রাসবিহারী এভিনিউ পার হওয়ার সময় একটা চলন্ত ট্রামের সামনে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।’

যে কবির আকাঙ্খা

‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও-আমি এই বাংলার পারে

র’য়ে যাব… ’

(উৎস: কবিতার শিরোনাম ‘তোমরা যেখানে সাধ’ কাব্যগ্রন্থ ‘রূপসী বাংলা’)

ধানসিড়ি নদীতীরে যাঁর জন্ম আর বট-তমালের নীলছায়ায় যিঁনি মোহাবিষ্ট , সে কবি কেন মাত্র ৫৪বছর বয়সে  চলন্ত ট্রামের দিকে পা বাড়িয়ে মৃত্যুর আলিংগণে জড়ালো?

মেলেনি উত্তর।

দীর্ঘজীবী ছিলেন না কবি তারপরও তাঁর সৃজনশীল কর্মকান্ড সৃষ্টির সাগরে ঢেউ তুলে দিয়ে গেছে। জীবিতাবস্থায় পাঁচটির মত কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ঝরা পালক’প্রকাশিত হয় ১৯২৭সালে। তবে যে কাব্যগ্রন্থের নামে কবিকে পরিচিত করাতে মানুষ অভ্যস্থ্ সে বইয়ের নাম ‘রূপসী বাংলা’ এবং বইটি  প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর, ১৯৫৭ বা ১৯৫৮ সালে।

এই লেখাতে কবির প্রথম বই ‘ঝরা পালক’এর কয়েকটি কবিতার লাইন ঊদ্ধৃত করা হচ্ছে এবং যে ধরনের কবিতা তার পরবর্তী বইয়ে আর দেখা যায় নি। ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতর সংখ্যা ৩৫টি। বিস্মিত হতে হয় দেখে যে এমন কিছু কিছু শব্দ যা কবি ‘ঝরা পালক’এ ব্যবহার করেছেন সে শব্দাবলী বা সে ধরনের শব্দাবলী পরবর্তী বই ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ ও ‘বনলতা সেন’এ খুঁজেও পাওয়া গেল না।  ‘ধূসর পান্ডুলিপি’তে আছে ২১টি কবিতা। ‘বনলতা সেন’ বইটিতে আছে ৩০টি কবিতা। ‘ঝরা পালকে’র পর মনে হল কবি যেন আটঘাট বেঁধে ফিরলেন বাংলায়, ভাষায় ও উপমায় তাঁর আশ্রয় এখন শুধুই বাংলা।

‘ঝরা পালক’এ লিখিত বিভিন্ন কবিতার কয়েকটি লাইন দেয়া হল

                     ‘বিজন তারার সাঁজে

আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে।’

( কবিতার শিরোনাম  ‘আমি কবি,-সেই কবি’)

                 ‘-নব নবীনের লাগি’

প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমরা রয়েছি জাগি’।

…………………………………………

প্রদীপ নিভায়ে মানব-দেবের দেউল যাহারা ভাঙে

আমরা তাদের শাস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়!

    -জয় মানবের জয়!’ (কবিতার শিরোনাম ‘নব-নবীনের লাগি’)

    ‘-দূর দিগন্তে চ’লে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!

     কোন্  সুদূরের তুরাণী-প্রিয়ার তরে

     বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!

(কবিতার শিরোনাম ‘জীবন-মরণ দুয়ারে আমার’)

‘ঝরা পালক’গ্রন্থে  একটি কবিতার চরণ

                 ‘হে ভাই মুসলমান,

তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!

এ  ভারতভূমি নহেক’ তোমার, নহেক’ আমার একা,

হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ, -মুসলমানের রেখা;’

(কবিতার শিরোনাম ‘হিন্দু-মুসলমান’)

‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থে রূপসী বাংলা ও বাংলা মুখের কবির কাব্যের ভৌগোলিক পরিসর ও শব্দ চয়নের বৈচিত্র নিবিষ্ট পাঠকের মনে ভাবনা জাগাতে বাধ্য। এই গ্রন্থে কবি কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যেমন ‘আখের’, ‘দিওয়ানা’, ‘রেওয়াজ’, ‘নার্গিস’, ‘পশমিনা’, ‘খুন’, ‘খারাবী’, ‘তালাস’, ‘সাকী’, ‘মুসাফের’ আরও কিছু যে গুলোর কোনোটাই ১৯৩৬ প্রকাশিত ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ ও ১৯৪২এ প্রকাশিত ‘বনলতা সেন’এ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে ‘ঝরা পালক’এর ‘বেদিয়া’ কবিতার ক’টি লাইন দেখা যাক

‘বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি’

লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ ঊষার শ্বাস!

ঘুঘু হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস

নিবির কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে’ ফিরে’

বহু পুরাতন পরিচিতি সেই সঙ্গী আসিল কি রে!’

এই কবিতাতে ‘বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে’ ডাহুক-শালিকের ডাকে ‘রূপসী বাংলা’ ও ‘বনলতা সেন’এর কবি তাঁর  আগমন বারতা পাঠককে দিয়ে যান।

‘ঝরা পালক’এ কবিতায় অলিভকুঞ্জ, উইলোর বনের উল্লেখ করছেন, এখানে তাঁর মনে মিশরের নীলনদ আসে ঘুরে ফিরে  তবে পাঠক ধানসিড়ি নদীর দেখা পাবে না এখানে। কবিতা লিখছেন ‘মিশর’, ‘পিরামিড’, ‘মরুবালু’ নিয়ে এর পরের বইগুলোতেই কবি বলছেন ‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়’। বাংলার মুখে আবিষ্ট হয়ে পৃথিবীর রূপ খুঁজতে নিরাসক্তি আসে। এমন কি অনাগত সময়েও কবির ইচ্ছা  

‘পদ্মা-ভাগীরথী-মেঘনা-কোন নদী যে সে,-

সে সব জানি কি আমি!-হয়তো বা তোমাদের দেশে

সেই নদী আজ আর নাই,-

আমি তবু তার পাড়ে আজো তো দাঁড়াই!’

(উৎস: কবিতার শিরোনাম ‘পরস্পর’কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’)

এই প্রবন্ধটি ২২ অক্টোবর ২০২১ বাংলাদেশের ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সে প্রবন্ধে কাব্যগ্রন্থগুলোয় কয়টি করে কবিতা রয়েছে উল্লেখিত হয়নি। পরবর্তী সময়ে প্রবন্ধটি পড়ে দু’এক জন পাঠক কবিতার সংখ্যা উল্লেখ করার বিষয়ে পরামর্শ দান করেন। আমার পাঠকদের জানাই ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞ আমি পাঠকের সুপরামর্শের জন্য।        


Place your ads here!

Related Articles

Fundraising Dinner donation amount: Thanks from BAAC EC 2013-14

Dear Community Members, BAAC is proud of the Bangladeshi Canberra community for overwhelming responses and the active donation through participating

গাঙ্গালীন মসজিদের সম্মানিত সদস্য ও শুভানুধ্যায়ী দের কাছে খোলা চিঠি

২০সে মে ২০১৯ সম্মানিত বড় ভাই , শ্রদ্ধেয় গুরু জন সম বয়সী ও ছোট ভাই , আমার সালাম নিবেন।  আশা

Excellence in dancing – Arpita Shome Choudhury

Dance, the supreme art form which skillfully embodies the three primary ingredients- BHAVAM, RAGAM and THALAM fascinated her right from

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment