ক্রাচের কর্নেল – একজন অমীমাংসিত মানুষের গল্প

ক্রাচের কর্নেল – একজন অমীমাংসিত মানুষের গল্প

বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা অনেকেই অনেক রকমের স্বপ্ন দেখি। কেউ দেখি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন আবার কেউ দেখি দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। কেউ দেখি শতভাগ স্বাক্ষরতা অর্জনকারী বাংলাদেশের স্বপ্ন আবার কেউ দেখি বিশ্বের বুকে গৌরব অর্জন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। কেউ দেখি একটা শ্রেণী বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন আবার কেউ দেখি মানুষে মানুষে সম্প্রীতির স্বপ্ন। কর্নেল তাহের ঠিক সমষ্টিগতভাবে এই স্বপ্নগুলোই দেখতেন তাও আবার বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের অনেক আগে থেকেই। কর্নেল তাহের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনেক আগেই সেই কিশোর বয়সে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন। তখনকার দিনে সদ্য কৈশোরে পা দেয়া একজন কিশোরের কাছ থেকে এমন কথা শোনা অনেকটা ইঁচড়ে পাকা মনেহলেও এর মূল আরো গভীরে গ্রথিত ছিলো। ক্রাচের কর্নেল বইটা একজন কর্নেল তাহেরের একেবারে শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য মৃত্যু পর্যন্ত বলা গল্পের আখ্যান। যে গল্প পড়তে বসলে আপনার মনেহতে পারে আপনি যেন বাংলাদেশের কোন মানুষের গল্প পড়ছেন না পড়ছেন বহির্বিশ্বের কোন মহান বিপ্লবীর গল্প।

কর্নেল তাহের সম্মন্ধে ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে বইটি পড়তে বসা। সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশে বাম রাজনীতি নিয়ে যুগেযুগে এতো বেশি নেতিবাচক প্রচার রয়েছে যে আপনার মনেহতে পারে তারা যেন আমাদের সমাজের কোন অংশ নয়। একেতো তাদের সাথে আমাদের গতানুগতিক চিন্তা চেতনার তফাৎ উপরন্তু তাদের একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন প্রণালী। অবশ্য হালের বাম রাজনীতিবিদদের দেখে আগেকার আমলের বাম রাজনীতিবিদদের বিচার করলে ভুল হবে। এখনকার বাম রাজনীতির নেতা নেত্রীরা বিভিন্ন দলের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত। অবশ্য এখনও সেই আগেকার দিনের মতো এক শ্রেণীর তরুণ তরুণী ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানোর মতো কঠিন কাজটা অবলীলায় করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানির মোটা বেতন, দামী গাড়ি কোন কিছুই তাদেরকে কিনতে পারছে না। ব্যাপারটা এমন না যে তাদের যোগ্যতা নেই কিন্তু তবুও তারা জীবনের গতানুগতিক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে এসে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন পড়ছেন সরকারের রোষাণলে। এছাড়াও বাংলাদেশের সমস্ত শক্তির কেন্দ্রবিন্দু সরকারি চাকুরী থেকেও নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বোঝা সামরিক বাহিনী থেকে তারা আরো বেশি দূরে।  

ক্রাচের কর্নেল বইয়ের প্রচ্ছদ

যাইহোক কর্নেল তাহের সম্মন্ধে আলোচনা করার আগে লেখক তারা পরিবার সম্মন্ধে আলোচনা করেছেন। এমন একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই হয়তোবা নান্নু থেকে কর্নেল তাহের আমাদের এই উপন্যাসের নায়ক ক্রাচের কর্নেল হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। পরিবার বলতে এখানে কর্নেল তাহের যে পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন সেটার এবং তাঁর নিজের পরিবার দুটোর কথায় বলা যায়। কর্নেল তাহেরের বাবা মা দুজনেই আমাদের সমাজের গতানুগতিক বাবা মাদের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা রকমের মানুষ। বাবার বদলির চাকুরী সূত্রে কর্নেল তাহেরের ভাইবোনদের অনেক ছোটবেলাতেই অনেক কিছু দেখা, শেখা এবং জানা হয়ে যায়। অবশ্য এখানে তাঁদের বাবা মায়ের ঠিক করে দেয়া জীবনপ্রণালীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। কর্নেল তাহেরের মা আশরাফুন্নেসা মোট এগারোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। একটি মারা যায় অল্প বয়সে। দশটি সন্তানের একটি সংসার রীতিমতো একটা প্রতিষ্ঠানের মতো করে গড়ে তুলেন আশরাফুন্নেসা।

কর্নেল তাহেরের বাবা মা দুজনেই খুব ভোরবেলা উঠতেন ঘুম থেকে। এরপর ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে উঠলে চালু হয়ে যেতো রুটিন মাফিক কাজ। সোমবার যেমনঃ

শেলী অর্থাৎ সালেহা রুটি বেলবে।

হীরু অর্থাৎ আরিফ কুয়া থেকে পানি তুলবে,

মন্টু অর্থাৎ ইউসুফ হাঁস, মুরগি আর কবুতরের খোপ খুলে দেবে,

নান্টু অর্থাৎ তাহের গরুকে খৈল দেবে,

খোকা অর্থাৎ সাঈদ গোয়াঘর পরিষ্কার করবে,

মনু অর্থাৎ আনোয়ার উঠান ঝাড়ু দেবে,

মঙ্গলবার আবার দায়িত্ব রদ বদল হবে। এভাবে চলতো প্রতিদিন। স্কুলে যাবার আগে এবং পরে প্রতিটা ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ ছিলো নির্দিষ্ট কাজ। সংসারে যারা পরে এসেছে, বেলাল, বাহার, ডালিয়া, জুলিয়া কেউই বাদ যায়নি এ নিয়ম থেকে। তার সন্তান বাহিনীর কাজ কঠোরভাবে তদারকী করতেন আশরাফুন্নেসা। এছাড়াও আশরাফুন্নেসা অবলীলায় তার ছেলেমেয়েদেরকে কামলাদের সাথে কাজে লাগিয়ে দিতেন। এতে করে অলক্ষে সন্তানদের হয়ে যাচ্ছিল কঠোর নিয়ামনুবর্তিতার প্রশিক্ষণ, হচ্ছিল প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ, কেটে গিয়েছিল কায়িক শ্রম নিয়ে শিক্ষিত মানুষের প্রচলিত দূরত্বের বোধ।  কৈশোরের এই প্রস্তুতি তার সব সন্তানকে দিয়েছিল বৃত্ত ভাঙ্গার সাহস।

কর্নেল তাহেরের মা

আমার কাছে মনেহয়েছে কর্নেল তাহেরের পরিবারের গল্প যেন বাংলাদেশের মূর্ত প্ৰতিছব্বি। যেখানে কর্নেল তাহেরের মা হচ্ছেন বাংলাদেশ আর তার সন্তানেরা হচ্ছেন তার সামরিক বাহিনী। কর্নেল তাহেরের মা একনিষ্ঠ পাখির মতো একটু একটু করে ছানাদের তিনি মুখে পুরে দিয়েছেন অলৌকিক মন্ত্র। সে মন্ত্র বুকে নিয়ে তার ছানারা সব উড়ে গেছে অসম্ভবের দেশে। কর্নেল তাহেরের বাবা মহিউদ্দীনের ছিলো বাগানের শখ। যে স্টেশনেই যেতেন, স্টেশনের আশেপাশে পতিত জায়গার অভাব হতো না। মহিউদ্দীন আহমেদ সেখানে শুরু করে দিতেন নানা রকম সবজির চাষ। বদলির চাকুরীতে কয়েক বছরের মধ্যেই নতুন স্টেশনে যোগ দিতে হতো তাঁকে। তখন ওয়াগনে মালপত্র উঠানো শুরু হতো, সঙ্গে গরু ছাগল, মুরগী, কবুতর সব। গরুকে রেলের ওয়াগনে উঠানো হতো মাচা বানিয়ে। দুই তিন দিন ধরে চলার শেষে পৌঁছাতে হতো নতুন স্টেশনে। আর আশ্রাফুন্নেসার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি দূর ছিলো না, পড়েছিলেন প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত কিন্তু পড়বার আগ্রহ, জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বই পড়ার নেশা ছিল নান্টু তথা তাহেরের। তখনকার দিনে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইকে বলা হতো ‘আউট বই’। আশ্রাফুন্নেসারও আউট পড়ার শখ ছিল। দিনের সব কাজ শেষ হলে রাতে আশরাফুন্নেসা হারিকেন জ্বালিয়ে আলোর কাছে মেলে ধরতেন সাঁওতাল বিদ্রোহের উপর বই ‘ভাগনা দিহীর মাঠে’ কিম্বা স্বদেশী আন্দোলনের উপর লেখা ‘কাঞ্চনজংঘার ঘুম ভাঙছে’। ছেলেমেয়েদের নিয়ে আহ্লাদ, আদিখ্যেতা একদম অপছন্দ ছিলো আশ্রাফুন্নেসার। প্রতি ঈদে সবার জন্য নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিল না তাই পালাকরে কিনে দেয়া হতো নতুন জামা।   

আশরাফুন্নেসা তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা বোধ সঞ্চালিত করেছেন বারবার সেটা হলো ‘আমাদের জীবন শুধু আমাদের নিজের জন্য নয়, এ জীবনের ওপর দাবি আশেপাশের চেনা অচেনা মানুষেরও’ কর্নেল তাহের কে নিয়ে আলোচনা করতে বসে এতো বিশদভাবে তাঁর মায়ের বর্ণনা দেয়ার একটাই কারণ সেটা হচ্ছে কর্নেল তাদের যে জীবনবোধ ধারণ ও পালন করতেন তাঁর শিক্ষা তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর মায়ের কাছ থেকে হাতেকলমে পেয়েছিলেন। কর্নেল তাহের সেই ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে দুরন্ত তার অনেক প্রমাণ আছে। তাঁর ভাইকে তাঁর নিজের বয়সের তুলনায় বড় ছেলেরা মারলে তিনি সেখানে যেয়ে যেমন প্রতিবাদ করেছেন আবার ঠিক তেমনি ভাষা আন্দোলনের রক্তারক্তির মূল হোতা মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে বহনকারী ট্রেনের বগি লক্ষ্য করে ঢিলও ছুড়েছেন। ছোটবেলার স্কুল শিক্ষকের কাছ থেকেই পেয়েছেন আন্দোলনের শিক্ষা যিনি ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথীদের একজন। এই শিক্ষকের কথাগুলো কর্নেল তাহেরের জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে ছিল এমনকি মাস্টারদা সূর্যসেনের কর্মপদ্ধতি তাঁকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে তিনি তার ভবিষ্যৎ জীবনের সবগুলো আন্দোলনে সেই পন্থা অবলম্বন করেছেন। মাস্টারদা যেমন ব্রিটিশদের ঝাকুনি দিতে চেয়েছিলেন কর্নেল তাহেরও বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে একটা ঝাকুনি দিয়ে গেছেন। নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের সমাজ এবং শাসনব্যবস্থার ক্ষতগুলো এবং নিরাময়ের চেষ্টা করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। 

যৌবনে কর্নেল তাহের

নিয়মমাফিক ম্যাট্রিকে ছাত্রছাত্রীদের বিষয় হিসেবে হয় উর্দু নয়তো আরবি নিতে হতো সেই সময় কর্নেল তাহের সংস্কৃত নিয়েছেন। পরবর্তিতে কলেজে ভর্তি হয়ে দুই বন্ধু মন্জু আর আর মজুমদারকে নিয়ে মনেমনে গড়ে তুলেছেন গেরিলা বাহিনী। তিনি সেই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন ‘ব্রিটিশরা ভারত ভেঙেছে এবার আমাদের পাকিস্তান ভাঙতে হবে’। এই সময়ে কয়েকটি বই তাহেরের চিন্তা চেতনাকে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করে তার মধ্যে ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ এবং এঙ্গেলস এর ‘এন্টিডুরিং’। কর্নেল তাহেরের সেনাবাহিনীতে যোগদানও কোন কাকতালীয় ঘটনা ছিল না উনি অনেক হিসেবে নিকেশ করেই সেখানে যোগ দিয়েছিলেন ‘ওয়ার ফেয়ার’টা শেখার জন্য কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে না। এরপর সামরিক বাহিনীতে যোগদান, প্রশিক্ষণ সবই যেন তাঁর বৃহৎ পরিকল্পনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ। অবশ্য এর মধ্যেই পরিবারের চাপাচাপিতে বিয়েটা করে ফেলেন।  বাংলাদেশের আর্থ সামাজিকতায় একটা বিষয় খুবই সাধারণ সেটা হলো বিয়ের আগে অনেকেই সমাজ দেশ বিশ্ব বদলে দেবার স্বপ্ন দেখেন কিন্তু বিয়ের পর হয়ে যান পুরোপুরি সাংসারিক হোক সেটা বাস্তবতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে বা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কিন্তু কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাঁর স্বামীকে বেঁধে রাখেননি বরং কোন পরিণতির কথা না ভেবেই  যতুটুকু পেরেছেন সহযোগিতা করে গেছেন স্বামীর অসম্ভব স্বপ্ন পূরণের। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন মেয়েরা সংখ্যায় একেবারেই হাতেগোণা।          

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী থেকে তাঁকে যে প্রশিক্ষণেই পাঠানো হয়েছে সেখানেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কিন্তু একটি দিনের জন্যেও নিজ মনে লালিত স্বপ্ন থেকে দূরে সরে যাননি। একটা স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এ সবেরই ধারাবাহিকতায় তিনি পাকিস্তান থেকে পলায়ন করেছেন আরো দুজন কর্মকর্তা মন্জুর এবং জিয়াউদ্দিনসহ। পাকিস্তান থেকে পলায়ন পর্বটা পড়ার সময় পাঠক সহজেই আবিষ্ট হয়ে যাবেন কারণ পলায়নের সেই গল্প সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ময়মনসিংহ সীমান্তের ১১ নং সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব নেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও তিনি তার বোধকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ততদিনে তাঁর পরিবারের সকল ভাইবোন এসে তাঁর সাথে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন অবশ্য অনেকেই আগে থেকেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু তাহেরকে পেয়ে সবাই আরো বেশি উৎসাহিতবোধ করেন। তাহের একের পর এক দুর্ধর্ষ সব অভিযান পরিচালনা করেন। অত্র এলাকায় পাকিস্তানিদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি কামালপুর একবার করে বিফল হয়ে আবারও আক্রমণ করেন। দ্বিতীয়বার আক্রমণের সময় একটা বিস্ফোরণে একটা পা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি ক্রাচ নিয়ে হাটা শুরু করেন আবার আমাদের কাছে পরিচিত পেতে শুরু করেন কর্নেল তাহের থেকে ক্রাচের কর্নেল হিসেবে। দেশ স্বাধীন হয় একসময় কিন্তু কর্নেল তাহেরকে দেশ স্বাধীনের মূল্য হিসেবে পা’টাকে বিসর্জন দিতে হয়। ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ আর তিন লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা অর্জিত হয় তার কাছে একটা পা নিতান্তই তুচ্ছ একটা ব্যাপার কিন্তু এই পঙ্গুত্বই পরবর্তিতে তাঁর জীবনের অনেক সম্ভবকে অসম্বভব করে তোলে যদিও এটা তাঁর জীবনাচরণে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। পরবর্তিতে উনার কর্মকান্ড দেখে মনেহয়েছে উনি বোধহয় জীবনের শুরু থেকেই একটা পা’হীন।      

কর্নেল তাহের এবং তাঁর ক্রাচ

মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকটাই বদলে যান তাহের। ইউনিফর্মের বাইরে তখন তাঁর ছিলো মাত্র দু তিনটে শার্ট। পুরোপুরিভাবে ছেড়ে দিয়েছেন মদ। সিগারেট না ছাড়লেও আগে যেখানে তাঁর ব্র্যান্ড ছিলো বিদেশি তখন ধরেছেন দেশি স্টার। তাহের মনেমনে আঁকতে থাকেন একটা সোনার বাংলার চিত্র যার ভিত্তি হবে নদী। তাহের এমন একটি বাংলার কল্পনা করতে থাকেন যেখানে সেই নদীর দুপাশে বিস্তীর্ণ উঁচু বাঁধ। সে বাঁধের উপর দিয়ে চলে গেছে মসৃণ সোজা সড়ক, রেলপথ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ লাইন। বাঁধের উভয় পাশে ইতস্ত ও বিক্ষিপ্ত গ্রাম। সেখানে নির্ধারিত দূরত্বে একই নকশার অনেক বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে এক একটি জনপদ। ঠিক এমনই একটা অসম্ভব স্বপ্ন কর্নেল তাহের বাংলাদেশকে নিয়ে দেখতে থাকেন এবং নিজের পদাধিকার এবং ক্ষমতার মধ্যে থেকে সেগুলোর যতদূর সম্ভব বাস্তবায়নও শুরু করেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পুরো ব্রিগেডের দায়িত্ব পাবার পর সেটাকে এমনভাবে গড়ে তুলেন যে অন্য ব্রিগেডের কাছে সেটা লাঙ্গল ব্রিগেড বলে খ্যাতি পেয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমায় এগিয়ে যেতে থাকে কর্নেল তাহেরের স্বপ্নিল জীবন। বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে দ্বিতীয় সিপাহী বিপ্ল্ব। সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই স্লোগান একসময় হয়ে যায় সিপাহী জনতা ভাই ভাই। এর মধ্যেই ঘনিয়ে আসে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫। বাংলাদেশের অবস্থা তখন ঘূর্ণির বলয়ে পড়া একটা খুড়কুটোর মতো। কখনও একদিকে তো পরমুহূর্তেই অন্যদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।

পরবর্তিতে বিভিন্ন ঘটনাক্রমে কর্নেল তাহেরের বন্দিত্ব বরণ, প্রহসনের বিচার এবং বাংলাদেশ সাক্ষী হয় একটা জবানবন্দীর। কেউ যদি কর্নেল তাহেরকে জানতে চায় তাহলে শুধুমাত্র তাঁর এই জবানবন্দিটা পাঠ করলেই তাঁর কর্মকান্ড এবং স্বপ্ন সম্মন্ধে প্রায় সবটুকু জানা হয়ে যায়। একসময় ফাঁসির রায় দেয়া হয়। ফাঁসির রায় শোনার পরও তাঁকে কোনভাবেই ক্ষমা ভিক্ষার আবেদনে রাজি করানো সম্ভব হয়নি। আমার জানামতে উপমহাদেশের ইতিহাসে ভগৎ সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর পর কর্নেল তাহের সম্ভবতঃ দ্বতীয় ব্যক্তি যিনি হাসিমুখে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছিলেন। দুঃখ একটাই ভগৎ সিং যেমন নিজের জীবন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন কিন্তু কর্নেল তাহেরের ফাঁসিটা একেবারে কোন কাজেই আসে না। সত্যিই কি আসে না? সেটাও অবশ্য একটা প্রশ্ন। কর্নেল তাহের ফাঁসি কাষ্ঠে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে পাঠ করেন সহযোদ্ধা জিয়াউদ্দিনের লেখা কবিতাঃ

“জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে, কাঁপিয়ে দিলাম।

জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙব বলে, ভেঙে দিলাম।

জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে, করেই গেলাম

জন্ম আর মৃত্যুর বিশাল পাথর রেখে গেলাম

পাথরের নিচে, শোষক আর শাসকের কবর দিলাম

পৃথিবী, অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।”

সপরিবারে কর্নেল তাহের

বইটা শেষ করা হয়েছে এইভাবে ‘কবর দেওয়ার পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা কবরের পাশে ক্যাম্প করে পজিশন নেয়। রাইফেল আর বেয়নেট উঁচিয়ে কবরটিকে পাহাড়া দেয় তারা। এক সপ্তাহ যায়, দুসপ্তাহ যায় সেনা পাহাড়া তবু নড়ে না।…তুমুল বৃষ্টি নামে একদিন। কি মনেহয় লুৎফার, ছাতা মাথায়, কাদা পথ হেঁটে হেঁটে কবরের কাছে চলে যান তিনি। বাতাসের ঝাপটায় ভিজে যায় তার শাড়ি। ঘন বৃষ্টিতে আবছা দেখা যায় অস্ত্র হাতে রেইনকোট পরা সিপাইরা দাঁড়িয়ে আছে এদিক ওদিক। বৃষ্টিতে ঝুম ভিজছে কবরটি। পানি চুইয়ে চুইয়ে ঢুকছে কবরের অনেক ভেতরে। সেখানে শুয়ে আছেন একজন অমীমাংসিত মানুষ। লুৎফা ভাবে মানুষটা ভিজছে।’ এভাবেই নিজের, সংসারের পরিণতির কথা না ভেবে বাংলাদেশকে নিয়ে অসম্ভব স্বপ্নবাজ একজন মানুষের জীবন কাহিনী থেমে যায়। এরপর বাংলাদেশের ইতিহাস যেমন দিক পরিবর্তন করে তেমনি কর্নেল তাহেরও চলে যান বিস্মৃতির অতলে। সেখান থেকে তাঁকে পরম মমতায় তুলে এনেছেন সুলেখক শাহাদুজ্জান তাঁর ‘ক্রাচের কর্নেল’ বইয়ে। এই বইটার বিশেষত্ব হচ্ছে এই বইটাতে কর্নেল তাহেরে জীবনকাহিনীর সমান্তরালে এসেছে বাংলাদেশের ইতিহাস যেটা পাঠকের জন্য বাড়তি পাওনা।

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

Related Articles

Rana Plaza Victims Urgently Need Assistance

Survivors of the Rana Plaza building collapse one year ago in Bangladesh are still suffering from their injuries and loss

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় ১ কোটি প্রবাসীর স্বার্থ উপেক্ষিত !

অর্থনীতির চালিকাশক্তি রেমিটেন্সের উৎস প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশের কোন সরকারই আজ অবধি সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। সদ্যঘোষিত ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’

সম্প্রচার নীতিমালাঃ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সরকারের করণীয়

সরকার যেসময়ে, যেকারনে, যে অবস্থায় এ নাজুক সম্প্রচার নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে এগুচ্ছে এতে করে স্পষ্টতঃই গণমাধ্যমের সাথে সরকারের সংঘাত সৃষ্টির

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment