করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার বিজয় ঘোষনা

করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার বিজয় ঘোষনা

ফজলুল বারী: করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার বিজয় ঘোষনা করেছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী গ্রেগ হান্ট। মঙ্গলবার তিনি বলেছেন গত চব্বিশ ঘন্টায় আমরা একজন মাত্র কভিড নাইন্টিনের অজ্ঞাত সংক্রমনের রোগী পেয়েছি। এরমানে সামাজিক সংক্রমনের বিপদকে আমরা নিয়ন্ত্রনে আনতে পেরেছি। সামাজিক দূরত্ব সহ সব সতর্কতা বজায় রেখে এই বিজয় ধরে রাখতে হবে।

গত চব্বিশ ঘন্টায় অস্ট্রেলিয়া জুড়ে মাত্র ১২ জন নতুন রোগী পাওয়া গেছে করোনা ভাইরাসের। এরমধ্যে মধ্যে মাত্র একজন ছিল অজ্ঞাত সামাজিক সংক্রমনের রোগী। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন অবশ্য আগেভাগে জানিয়ে রেখেছেন আগামী ১১ মে’র আগে করোনাজনিত জাতীয় অনেক কড়াকড়ি শিথিল করা হবেনা।

উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় গত জানুয়ারি মাসে প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথম রোগী ছিলেন চীন থেকে আসা এক বৃদ্ধ। চীনা নববর্ষ উদযাপনে তিনি তার আদি দেশ চীন ভ্রমনে গিয়েছিলেন।

বহুজাতিক সমাজের দেশ অস্ট্রেলিয়ার চীনা বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালের আদমশুমারি অনুসারে মোট ১২ লক্ষ ১৩ হাজার ৯০৩ জন চীনা অস্ট্রেলিয়ান বাস করেন এই দ্বীপ মহাদেশে।

এদেশের ব্যবসা বানিজ্যের বড় একটি অংশ চীনাদের নিয়ন্ত্রনে। অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক অংশীদারও চীন। চীনা পর্যটক, চীনা ছাত্রছাত্রী এদেশের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস।

বিপুল সংখ্যক চীনা বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর অবস্থানের কারনে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটাও অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপদ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অবকাঠামো এই যুদ্ধের কৌশল বাস্তবায়নে বেশ কাজে দেয়। এদেশের যে কোন পাব্লিক টয়লেটে আগে থেকেই তরল সাবানে হাত ধোয়া শুকানোর ব্যবস্থা ছিল। এই দূর্যোগে সেই অবকাঠামোর আরও উন্নয়ন ঘটানো হয়।

করোনা যুদ্ধ শুরুর পর চীন থেকে আনা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের দুই স প্তাহের কোয়ারিন্টানে নিয়ে রাখা হয় মূল ভূমি বিচ্ছিন্ন ক্রিসমাস আইল্যান্ডের একটি পরিত্যক্ত জেলখানায়। আগে সাগরপথে কেউ অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেফতার করে ওই দ্বীপের জেলখানায় নিয়ে রাখা হতো।

পরে বিদেশ থেকে আসা অনেককে কোয়ারিন্টানে রাখা হতো পরিত্যক্ত মাইনিং কোম্পানির অতিথিশালায়। সর্বশেষ বিদেশ থেকে আসা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের নিজের খরচে দুই সপ্তাহ কোন হোটেলে কোয়ারিন্টানে থাকার পর তাদেরকে যারযার বাড়ি যেতে দেয়া হয়েছে।

আড়াই কোটি জনসংখ্যার অস্ট্রেলিয়ায় এখন পর্যন্ত ৫ লক্ষ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের করোনা টেস্ট করা হয়েছে। করোনা টেস্টে এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ হার। এখনও যাদের করোনা সিনড্রমের টেস্ট করা হয়নি এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে রবিবার থেকে চালু করা হয়েছে করোনাসেইফ নামের বিশেষ একটি মোবাইল এ্যাপ।

প্রথম চব্বিশ ঘন্টায় ২০ লক্ষের বেশি অস্ট্রেলিয়ান এই এ্যাপটি যার যার স্মার্ট ফোনে ডাউনলোড করে নিজেদের এ্যাপটির সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছেন। এ্যাপটির কারনে যে কোন ব্যক্তি একটি এলাকা দিয়ে যাবার সময় ওই এলাকায় কোন কভিড নাইন্টিন পজিটিভ রোগী থাকলে তার মোবাইল ফোনে সতর্কীকরন বার্তা পাবেন।

বা যে কোন সম্ভাব্য রোগী ওই এ্যাপের মাধ্যমে বার্তা পাঠালে পনের মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন বিশেষ স্বাস্থ্য কর্মীর দল।

২৮ এপ্রিল সকাল ৬ টা পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় ৬ হাজার ৭২৫ জন শনাক্তকৃত করোনা রোগীর অবস্থান জানা গিয়েছিল। তাদের ৫ হাজার ৬০২ জন সুস্থ হয়ে গেছেন। মারা গেছেন ৮৪ জন। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ার মৃতদের মধ্যে ক্রুজ রুবি প্রিন্সেসের ২০ জন, বৃদ্ধনিবাসের ১৬ জন রোগী রয়েছেন।

রুবি প্রিন্সেস জাহাজে ভ্রমন করে সিডনিতে নামা যাত্রীদের ৬ শ’র বেশি যাত্রীর করোনা পজিটিভ পাবার কারনে এটিকে অস্ট্রেলিয়ায় করোনা ছড়ানোর এপিক সেন্টার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ জাহাজটির ব্ল্যাকবক্স জব্দ করে তদন্ত করে এরপর জাহাজটিকে অস্ট্রেলিয়ার জলসীমা ছাড়া করেছে। পুরো তদন্ত শেষ হতে সময় লাগবে পাঁচ-ছয় মাস। আসামী জাহাজ কর্তৃপক্ষকে আগামীতে বিচারের আওতায় আনা হবে।

সিডনির একটি বৃদ্ধ নিবাসে গত চব্বিশ ঘন্টায় চার জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। সুখের খবর এখন পর্যন্ত কোন বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া যায়নি।

অস্ট্রেলিয়ার এই করোনা যুদ্ধ জয়ের বড় কারন ছিল এদেশের সংগঠিত চিকিৎসা অবকাঠামো। এখানে প্রতিটি নাগরিকের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার-চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে এই রাষ্ট্র।

এখানে সবার একজন পারিবারিক চিকিৎসক তথা জিপি আছেন। জিপিরা এই সময়ে সামনাসামনি চিকিৎসা ছাড়াও ফোনে, ভিডিওকল, ফেইসটাইমেও চিকিৎসা দিয়েছেন। চিকিৎসা পাবার বিষয়টি মানুষের অধিকারের পর্যায়ে নিশ্চিত থাকায় কোথাও কোন সংকটের সৃষ্টি হয়নি।

আইনানুগ সমাজের কারনে সামাজিক দূরত্ব এবং যে কোন ধরনের জনসমাবেশ এই রাষ্ট্র কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পেরেছে। এখানে মানুষ সচরাচর মিথ্যা বলেননা বা মিথ্যা বলতে অভ্যস্তও নন। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা পাওয়া সহজ। মিথ্যা ধরা পড়লে গুরুতর শাস্তি পেতে হয়। শাস্তি মানে বড় জরিমানা।

এই করোনা সময় দেশের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বাজার, রেষ্টুরেন্ট-ক্লাব-বার-জিম, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মসজিদে তালা মানে তালা। ছয়জন বা অতজনে মিলে নামাজের অনুমতির বিষয় নেই।

খ্রিস্টান প্রধান দেশটার গির্জাগুলোও সব তালাবদ্ধ। অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইস্টারেও সব গির্জা তালাবদ্ধ ছিল। স্কুল-কলেজে ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। সামাজিক দূরত্ব কেউ না মানলে তাকে ১৬৫২ ডলার জরিমানা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় ছবি দেখেও অপরাধের জরিমানা হয়। রাগবি-ফুটি এদেশের জনপ্রিয় খেলা। এনআরএল রাগবি লীগের কয়েকজন জনপ্রিয় খেলোয়াড় সাগরপাড় লাগোয়া একটি খামারে বেড়াতে গিয়ে সামাজিক দূরত্বের কড়াকড়ি মানেননি।

হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালিয়েছেন। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে বেআইনি শিকার করে এসবের ছবি-ভিডিও আবার শেয়ার করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে!

ওই ছবি ভিডিও দেখে তাদের একেকজনকে পঞ্চাশ হাজার ডলার করে জরিমানা ও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সাসপেন্ড করা হয়েছে তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স। আগামী আগষ্টে তাদেরকে বিচারের জন্যে আদালতে তোলা হবে। রাগবি লীগ কর্তৃপক্ষ তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাসপেন্ডও করেছে।

এরপর আবার সংশ্লিষ্টরা ফেসবুক লাইভে এসে অপরাধ স্বীকার করে ভক্তদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। আইনের এমন কড়াকড়ির কারনেই অস্ট্রেলিয়া প্রানের এত কম ক্ষয়ক্ষতিতে করোনা পরিস্থিতি এভাবে সামলে নিয়েছে। আক্রান্ত এবং সুস্থ হওয়া ও মৃতের সংখ্যাগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা করলেই এর ধারনা মিলবে।

অস্ট্রেলিয়া এমনিতে লাইনে দাঁড়ানো জাতি। সকালে কফির দোকানে বা যেখানেই হোক না কেনো তিনি পুলিশ-সেনা সদস্য বা তিনি মন্ত্রী এমপি বা নির্মান শ্রমিক যিনিই হোক না কেনো কোথাও ভিড় দেখলে এখানে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে যান। লাইনে সবাই সব সময় ভদ্রতাবশত এমনভাবে দাঁড়ান যাতে একজন আরেকজনের গায় গায়ে না গড়িয়ে পড়েন।

এবার করোনা যুদ্ধের সময়ে সামাজিক দূরত্ব নীতির সময় লাইন মেনে সব সুবিধা নেবার পুরনো অভ্যাসটিকে আরও স্বাস্থ্য সম্মত অবয়ব দেয়া হয়েছে। সুপার মার্কেট থেকে শুরু করে কফিশপ সব জায়গাতেই এবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াবার জায়গাগুলো মার্কিং করে দেয়া হয়েছিল।

এই সময়ে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এই ধারনা থেকে সুপার মার্কেটগুলোয় দেখা যায় টয়লেট টিস্যুর সংকট। প্যানিক বায়িং এর কারনে সুপার মার্কেটগুলোতে টয়লেট টিস্যু, পেপার টাওয়েল এসব এখনও রেশনিং করে বিক্রি করা হচ্ছে।

সুপার মার্কেটে ট্রলি নেবার আগেই হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এমন আইন মানা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো অনুসরন করায় এদেশে মাস্ক পরাটাও বাধ্যতামূলক ছিলোনা। প্রধানমন্ত্রী মিডিয়া ব্রিফিঙে কখনো মাস্ক পরেননি। কিন্তু অতি সতর্করা সব সময় মাস্ক পরেই ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন।

শুরুর দিকে মাস্ক পিপিই নানাকিছু নিয়ে সংকটও এদেশেও ছিল। কারন দাবানলের সময় বিপুল ব্যবহারে এদেশে মাস্কের মজুদ ফুরিয়ে যায়। চীনের অবস্থা স্বাভাবিক হবার পর মাস্ক সহ নানাকিছুর সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু এটা নেই ওটা নেই বলে কোথাও কোন কাজ থেমে ছিলোনা। এদেশে আমরা কাজ-শিফট পেতে নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগাড় করে নিতে অভ্যস্ত অভিবাসী।

কিন্তু এই যুদ্ধ সামাল দিতে গিয়ে লাখ লাখ মানুষ এদেশে কাজ হারিয়েছেন। ভার্জিন এয়ারলাইন্স নামের অভ্যন্তরীন যোগাযোগের অন্যতম প্রধান এয়ারলাইন্সটি বসে গেছে। কাজ হারানো অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক-স্থায়ী বাসিন্দাদের জব সিকার-জব কিপার নামে রাষ্ট্র নানান ভাতার ব্যবস্থা করলেও বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা এই সময়ে কঠিন এক সময় পার করছেন। তাদের কাজ ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আরও কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।


Place your ads here!

Related Articles

Rajnitir Kushti Nama 1

রাজনীতির কুষ্ঠি নামা (১) ৫৪জ্ঞর আওয়ামী লীগ ,যুক্তফ্রন্ট , ৬৬জ্ঞর ৬দফা ,৬৯জ্ঞর গন আন্দোলন , ৭০জ্ঞর নির্বাচন , ৭১জ্ঞর মুক্তিযুদ্ধ

Our constitution permits an unelected person to be the Prime Minister

The headline of my article may sound unusual or strange but it is argued that an unelected person could become

Welcome Julia Gillard: We Want Change

It is matter of great pleasure that she has been elected the Prime Minister of Australia making history. Although, there

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment