চীন থেকে আনা অস্ট্রেলিয়ানদের রাখা হবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে

চীন থেকে আনা অস্ট্রেলিয়ানদের রাখা হবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে

ফজলুল বারী: ‘মরনেরে ডরায় সবাই’! করোনা ভাইরাস জর্জরিত চীনের উহান প্রদেশে এখন অস্ট্রেলিয়ার ৬শ’র বেশি নাগরিকের অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে একশর বেশি শিশু। অস্ট্রেলিয়া সরকার বিশেষ বিমানে করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু শুরুতেই তাদেরকে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখন্ডে আনা হবেনা। বিশেষ বিমানে করে তাদের প্রথম আনা হবে ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের দ্বীপে। অস্ট্রেলিয়ার এই দ্বীপটি মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন, প্রায় দুই হাজার কিঃমিঃ দূরে ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত। সেখানে তাদের জনবিচ্ছিন্ন করে রাখা হবে ১৪ দিন। ওই সময়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করা হবে তাদের কারো শরীরে করোনা ভাইরাসের জীবানু আছে কিনা। এই জীবানু নাই’ পরীক্ষায় পাস মার্ক পাওয়া লোকজনই শুধু ফিরতে পারবেন অস্ট্রেলিয়ায় তাদের যার যার বাড়িঘরে। কারও শরীরে করোনা ভাইরাসের জীবানু পাওয়া গেলে তার চিকিৎসা ক্রিসমাস আইল্যান্ডে না মূল ভূখন্ডে হবে সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

 বুধবার উহানকে আটকে পড়া নাগরিকদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার এই কর্মপন্থা চূড়ান্ত করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। এ জন্যে বুধবার দু’বার সংবাদ সম্মেলনে আসেন দেশটির কর্মকর্তারা। এরজন্যে কয়েকশ কোটি টাকার দরকার হবে। কিন্তু কবে নাগাদ আটকে পড়া অস্ট্রেলিয়াদের ফিরিয়ে আনা হবে এটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর দিন তারিখ নির্ভর করবে চীন সরকারের ওপর। উল্লেখ্য উহানের সঙ্গে সব ধরনের বিমান যোগাযোগ বন্ধ আছে। করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্যে উহানে দুই দিন সময়ের মধ্যে এক হাজার শয্যার বিশেষ একটি হাসপাতাল গড়ে তুলে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে চীন সরকার। অভ্যন্তরীন রাজনীতির চাপে বিভিন্ন দেশ নাগরিকদের ফেরত আনার সিদ্ধান্ত নিলেও এর নেতিবাচক দিক নিয়েও সতর্ক করা হচ্ছে। অনেকের আশাংকা এরমাধ্যমে প্রানঘাতী রোগটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। এই দেশটায় চীনা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মূল জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালের আদমশুমারি অনুসারে এই সংখ্যা ১২ লক্ষ ১৩ হাজার ৯০৩ জন। এদের ৪১ ভাগ অর্থাৎ পাঁচজনের দু’জনের জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতির নানা কিছুর সঙ্গে চীন দেশটি এবং এর নাগরিকরা জড়িত। প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চীনা ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্ভরশীল। দাবানলে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতির পর পর্যটনকে কেন্দ্র করে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে দাঁড়ানোর যে চিন্তা করছিল তা থমকে দাঁড়িয়েছে করোনা ভাইরাস আতঙ্কে। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় বিদেশি পর্যটকদের সিংহভাগ চীন থেকে আসেন। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে এই পর্যটকদের সিংহভাগ এরমাঝে তাদের বুকিং বাতিল করেছেন।

চীনা পর্যটক ও ছাত্রছাত্রীরা এরমাঝে অস্ট্রেলিয়া সফল বাতিল করায় দেশটির ক্ষতির পরিমান এরমাঝে দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। এই ছুটির সুযোগে এবং চীনা নববর্ষ উপলক্ষে চীনা-অস্ট্রেলিয়ান পরিবারগুলো দেশটায় ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার এরমাঝে স্থানীয় ডাক্তারদের মাধ্যমে এক মিলিয়নের বেশি মাস্ক বিলির উদ্যোগ নিয়েছে। সিডনির চীনা দোকানগুলোর সব কর্মচারীরা এখন তাদের কাজের সময়ের সর্বক্ষন এই মাস্ক ব্যবহার করছেন।

এখন দেখা যাক ভাইরাস শনাক্তে চীন থেকে আনা নাগরিকদের ক্রিসমাস আইল্যান্ডে নেবার সিদ্ধান্ত কেনো নেয়া হয়েছে। দেশের প্রধান শহরগুলো থেকে সেখানে যাবার সরাসরি কোন বিমান যোগাযোগও নেই। বিশেষ ফ্লাইট যায় ডারউইন ও পার্থ থেকে। ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপটির জনসংখ্যা মাত্র ১৪০২ জন। দ্বীপটি এক সময় সিঙ্গাপুরের অধীনে ছিল। সিঙ্গাপুর থেকে মাত্র ১৩৩০ দক্ষিন পশ্চিমে এর অবস্থান। ১৯৫৮ সালে দ্বীপটি অস্ট্রেলিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফসফেট খনিজে সমৃদ্ধ দ্বীপটির মালিকানা অস্ট্রেলিয়া মূলত সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার বাইরের নানা দেশের লোকজন বিশেষ একটি কারনে ক্রিসমাস আইল্যান্ডের নাম জানেন। এর আগে যারা সমুদ্রপথে অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করতেন তাদের গ্রেফতার করে ক্রিসমাস আইল্যান্ডের জেলখানা তথা ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হতো। সমুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করায় এখন আর কারও অবৈধপথে অস্ট্রেলিয়ার জলসীমায় পৌঁছা কঠিন। এদেশে জেলখানা চালানোর ব্যয় অনেক বেশি। ক্রিসমাস আইল্যান্ডের জেলখানার খাবার থেকে শুরু করে জনশক্তি এর পুরোটাই বিমানে করে অস্ট্রেলিয়ার মূলভূমি থেকে নেয়া হতো। এদের পিছনে ব্যয়ও ছিল বিশাল। যেমন একজন দোভাষীর দৈনিক মজুরি ছিল পাঁচশ ডলার। শনি-রবিবার প্রতিদিনের জন্য এই মজুরি দাঁড়াতো আটশ ডলার। বিপুল ব্যয়ের জন্যে ক্রিসমাস আইল্যান্ডের জেলখানাটিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এখন চীনের উহান প্রদেশ থেকে চীনা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক যাদের আনা হবে তাদের ক্রিসমাস আইল্যান্ডের পরিত্যক্ত জেলখানাতেই বিচ্ছিন্ন করে রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু এরজন্যেও চিকিৎসক সহ জনশক্তি, যাবতীয় চিকিৎসা-খাবার সামগ্রী সবকিছুই অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখন্ড থেকে নিয়ে যেতে হবে। এরমাঝে খবর বেরিয়েছে উহানের চীনা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকরা ক্রিসমাস আইল্যান্ডে যেতে রাজি নন। তারা বলছেন ক্রিসমাস আইল্যান্ডের চেয়ে উহানে এর চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা বেশি। এ অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বুধবার বলেছেন এখন যারাই চীন থেকে আসবেন তাদেরকে দু’ সপ্তাহ বাড়িতে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় থাকতে হবে।

অস্ট্রেলিয়ায় এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ছয়জন রোগী পাওয়া গেছে। এদের চার জন নিউসাউথ ওয়েলস এবং দু’জন ভিক্টোরিয়া রাজ্যে। এদের সবাই সাম্প্রতিক সময়ে চীনের উহান প্রদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরেছেন। করোনা ভাইরাস আতংকে এরমাঝে চীন থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের দু’সপ্তাহ ক্লাসে না আসতে বলে দেয়া হয়েছে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নিজেদের সব পরীক্ষা দু’সপ্তাহের জন্যে পিছিয়ে দিয়েছে মেলবোর্নের বিখ্যাত মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়।


Place your ads here!

Related Articles

সবাই আমার ভালবাসা চায়

করিম আলী’র ডুব সাঁতার – সবাই আমার ভালবাসা চায় [করিম আলী’র ডুব সাঁতার – আমার নামে লেখা হলেও, কথা গুলো

কাহিনী সামান্য

‘ও টাঙ্গাইলের তাঁতী আমার ঘরে নিভেছে আজ বাতি’ যেদিন এই অসাধারন শোকগাথা লেখা হয়েছিল কেমন ছিল দিনটা? মেঘলা ছিল কি

বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি যথেষ্ট করতে পারছে ক্লাইমেটচেঞ্জ কে টেকেল করতে?

পরিবেশগত অবনত আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর মাঝে একটা। আমার মনে হয় এই সমস্যাটা ডমেস্টিক রাজনীতিই হোক আর বৈশ্বিক

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment