ভুল শহরের ভুল মানুষেরা

ভুল শহরের ভুল মানুষেরা

ফজলুল বারী : নিমতলীর পর পুরনো ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এতগুলো লোক পুড়ে মরলো। বিদেশি মিডিয়ায় এরজন্যে ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়নকে দায়ী করা হয়। বিদেশিদের মূল্যায়নের দরকার নেই। আমরা আমাদের দেশকে চিনি জানি। সমস্যাগুলো জানি। সমাধানও জানি। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা শহর যখন গড়ে ওঠে তখন বাঙ্গালদের এ শহরটির মূল যানবাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। একটা ঘোড়ার গাড়ি চলতে যে পরিমান জায়গা দরকার সে ভাবে তৈরি হয় পুরনো ঢাকার রাস্তা। সেই রাস্তার পাশেই গড়েওঠে বাড়িঘর। বাখরখানি আর কাচ্চি বিরিয়ানির দোকান। সেই বাড়ির দাওয়ায় অথবা বিরিয়ানির দোকানের বেঞ্চে বসে সুখি ঢাকাইয়া মানুষেরা ঘোড়া গাড়ি আলো করে চলা বিদেশি মেম দেখতো আর রাজা-উজির মারতো। সেই ঢাকায় হুহু করে মানুষ বাড়তে থাকে। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান পরে বাংলাদেশের রাজধানী হয় ঢাকা শহর। কিন্তু বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির পুরনো ঢাকার রাস্তাঘাটের আকার সেই ঘোড়ার গাড়ির মাপেই রয়ে গেছে। রাস্তা যুগোপযোগী প্রশস্ত করতে কেউ কোথাও কোন দিন এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে রাজি হননি। ভোটপ্রিয় কিন্তু ভবিষ্যত লক্ষ্য-দর্শনহীন নেতারা এসব বিষয়ে পুরনো ঢাকাবাসীদের কোনদিন বিরক্ত করেননি বা সে ঝুঁকিও নেননি। সে কারনে অনেক আগে থেকেই পুরনো ঢাকা ঘিঞ্জি-যানজটের এলাকা। ওপর থেকে আগুন পড়ে চুড়িহাট্টায় যানজটে আটকাপড়া মানুষকেই পুড়িয়ে মেরেছে।

প্রতিবছর ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের মানুষ শহীদ নূর হোসেনকে স্মরন করে। বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, পিঠে ‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে জীবন্ত পোস্টার হয়ে মিছিলে এসে প্রান দিয়েছিলেন যুবলীগ করা অস্টম শ্রেনী পাশ নূর হোসেন। তখন নূর হোসেনের উৎস বৃত্তান্ত খুঁজতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। বনগ্রামের এক গলির এক কক্ষের বাসায় গাদাদাদি করে থাকতো নূর হোসেনের পরিবার। ছোট এক চিলতে কক্ষে একটা চকি। পরিবারের কিছু সদস্য থাকতো চকির ওপরে। বাকি সদস্যরা চকির নীচে। সেই গাদাগাদির ঘরে থাকতে ভালো লাগতোনা বলে নূর হোসেন প্রায় বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে থাকতেন। সেই নূর হোসেনের পরিবারকে পরে বাড়ি, তার ভাইকে শেখ হাসিনার গাড়ি চালকের চাকরি দেয়া হয় বলে আজকের প্রজন্মের সাংবাদিকরা বনগ্রামের সেই বাড়ির খবর জানেননা। শুধু নূর হোসেন নন, পুরনো ঢাকার আরও অনেকের এমন এক কক্ষের চকির ওপরে-নীচের আবাসিক ব্যবস্থাটি আমি দেখেছি।

অদ্ভূত এমন সুখি মানুষদের বাস পুরনো ঢাকায়! তাদের পরিবারগুলো বড় হয়। কিন্তু অনেকের আবাসিক ব্যবস্থাটি এমন কক্ষের। বাড়ির আর জায়গা থাকলে বেসমেন্টে বা এখানে সেখানে ঘর তুলে তারা গড়ে তুলেছেন চুড়ি-স্নো-পাউডার সহ নানান মনোহারী সামগ্রীর কারখানা অথবা গুদাম। নকল প্রসাধন সামগ্রীর নানান কারখানা-গুদামও নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে। যাদের দিয়ে এসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা বা প্রশিক্ষন নেই। সবাই কাজ শিখেছেন ওস্তাদের কাছে। ওস্তাদ নিজেই কিছু জানেননা। চুড়িহাট্টার আগুনের পর আমরা টেলিভিশনে দেখলাম ডিনামাইটের মতো ফুটছে বডিস্প্রে’র কৌটা, আর তা ফুটন্ত মুড়িমুড়কির মতো এসে পড়ছে রাস্তায়! যারা বিদেশে বিমানে যান তারা জানেন বিমান বন্দরের লাগেজ চেকিং’এ নির্দিষ্ট মাপের বাইরে টুথপেস্ট-সেইভিং ফোম, বডিস্প্রে এসব থাকলে তা বের করে ফেলে দেয়। কারন এসব লাগেজে থাকলে উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ার পর বায়ুমন্ডলের চাপ পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরন ঘটতে পারে।

চুড়িহাট্টার মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডির পর বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন অগ্নিকান্ডের কারন রাসায়নিকের গুদাম-কারখানা। কয়েক দিন ধরে সেখানকার বাতাসে ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এসবের পড়াশুনা-প্রশিক্ষনহীন ব্যবসায়ীরাতো উল্টো বিশেষজ্ঞদের বিশেষজ্ঞ! সে কারনে ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সরকার যখন গুদামগুলো উচ্ছেদে নামলো তখন বরাবরের মতো রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে বাধা আসলো। তারা মিছিল করে বক্তৃতা দিয়ে বললো তাদের রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ নয়! আগুন রাসায়নিক থেকে লাগেনি। সরকার থেকে পালটা হুমকি দিয়ে বলা হলো এসব বিপদজ্জনক ব্যবসা-গুদাম তারা সেখানকার আবাসিক এলাকা থেকে সরাবেই। কিন্তু বেশ ক’দিন হয়ে গেলো সবকিছু নিরিবিলি-চুপচাপ! মানুষ অন্য ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। সম্ভবত রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা লোকজনকে আগের মতোই টাকাপয়সা দিয়ে আবার ‘সুখে শান্তিতে ব্যবসা করিতেছে’!

বনানীর আগুনের পর দেশ থেকে বিস্তর লোকজন আগুনের ভিডিও লিঙ্ক পাঠাচ্ছিলেন। প্রথমে একটু বিরক্তই হয়েছি। ঢাকার বস্তিতে যখন আগুন লাগে অথবা আগুন লাগানো হয় তখনতো এই লোকগুলোকে এতোটা সক্রিয় মনে হয়না। কিন্তু আগুনের রিপোর্টগুলো যখন টিভি চ্যানেলগুলোতে লাইভ দেখতে শুরু করলাম মনটা শুধু হতাশ-বিষন্ন হয়। প্রথম হলো রাস্তায় এত মানুষের জটলা। এ রকম দূর্যোগ পরিস্থিতিতে রাস্তায় অনাবশ্যক লোকজনের জটলায় উদ্ধার কর্মীদের জরুরি কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। বিদেশে এ ধরনের ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ শুরুতেই সংশ্লিষ্ট রাস্তার যানবাহন-হাঁটাচলা বন্ধ করে দেয়। মিডিয়ার লোকজনও থাকেন এই ব্যারিকেডের বাইরে।  শুধু উদ্ধার তৎপরতা নয় অন্য যানবাহন এবং জনসাধারনের নিরাপত্তার জন্যে এটি গুরুত্বপূর্ন। বিদেশে এত লোক রাস্তায় হাঁটেনা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখার অত সময়ও মানুষের নেই। বাংলাদেশের অনেক মানুষের বেকারত্ব-অফুরন্ত সময়। তাদের ভিড়ে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়। চুড়িহাট্টায় তাদের পৌঁছতে দেরি হয়েছে। বনানীতেও। হাজার মানুষের ভিড় ঠেলেে তুলনামূলক প্রশস্ত সড়কের বনানীতে ফায়ার ব্রিগেড পৌঁছতেও দেরি হয়। তারা পৌঁছবার পর জানা গেলো তাদের লাডার তথা উদ্ধার সিঁড়ি খুলছেনা। নতুন সিঁড়ি আনতে আনতে আরও কুড়ি মিনিট! ততোক্ষনে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন প্রান বাঁচিয়ে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে মারা গেলো। নীচে তাদেরকে ধরার বা রক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নেই। লোকজন মোবাইলে মানুষের এসব লাফিয়ে পড়া মৃত্যুর ভিডিও ফেসবুকে ছাড়ছিল! কী বীভৎস।

বনানীর ঘটনার পর আবার শুরু হয় দুষাদুষির প্রতিযোগিতা। অত তলার অনুমতি নিয়ে অত তলা বানিয়েছে। ফায়ার এক্সিট ছোট। অত তলার লিফট বন্ধ ছিল। এলার্ম বাজেনি। ভেতরের পানির ব্যবস্থা কাজ করেনি, ইত্যাদি। বিল্ডিং কোড না মানার কথা বলা হয়েছে। বিল্ডিং কোডটা কী? গায়ে গায়ে লাগানো ভবন! এটা কোন বিল্ডিং কোড? এভাবে যে সারা ঢাকায় শতশত বহুতল ভবন উঠেছে উঠছে এসব কী দেখার কেউ আছেন? বিদেশে আমাদের সব বাসা বাড়িতেও রান্নার ধোয়া প্রভাবে এলার্ম বেজে ওঠে। সরকারি সংস্থার লোকেরা প্রতিবছর একবার হলেও আমাদের সঙ্গে এপোয়েন্টমেন্ট করে এসে এলার্ম চেক করে। ব্যাটারি বা অন্য কোন সমস্যা থাকলে তা ঠিক করে দিয়ে যায়। আমাদের বেশিরভাগ চাকরিতে প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং সার্টিফিকেট থাকতে হয়। প্রতিবছর নতুন ফী, ট্রেনিং ক্লাস করে আপডেট করাতে হয় প্রাথমিক চিকিৎসার সনদ। ভবনে ভবনে নোটিশ বোর্ডে ঝুলানো থাকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে যার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে তার নাম এবং মোবাইল ফোন নাম্বার। অকুপেশনাল হেলথ এন্ড সেফটি শেখানো হয় প্রায় চাকরিতে। যে কোন ঘটনা পরিস্থিতিতে আগে নিজেকে নিরাপদ করা। এরপর অন্যকে নিরাপদ করা। নিজে নিরাপদ না হলে আরেকজনকে নিরাপদ করবেন কী করে।

বিদেশে ফায়ার ব্রিগেড বা শহর কর্তৃপক্ষের লোকজন কোন বাড়ি বা ভবন নিরাপদ কিনা তা খুঁজতে তদন্তে বেরোয়না। সবাই নিজেরাই নিজেদের বাড়ি-ভবন নিরাপদ করে বানায়। নিরাপত্তা বজায় রাখে। কারন এটি যে যার যার নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়। ধরা পড়লে মোটা জরিমানার বিষয়তো আছে। প্রতিটি ভবনে বা শপিংমলে নিজস্ব অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রপাতি যেমন আছে তা ব্যবহার জানাতে প্রায় মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এলার্ম বাজিয়ে ঘোষনা শুনে মহড়ায় অংশ নিতে সবাই যারযার ফ্ল্যাট-অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন। এই মহড়া স্কুলেও হয়। প্রতিটি ভবনের দেয়ালে থাকে এই ভবনের বাসিন্দাদের ‘ইমার্জেন্সি মিটিং পয়েন্টের ম্যাপ’। আগুন সব দেশেই লাগে বা লাগতে পারে। সবাই এ ব্যাপারে আগেভাগে এমন প্রস্তুতি নেয়। বনানীর ভবনে জানা গেল এসবের কিছুই নেই। বাংলাদেশের মোটামুটি কোন ভবনেই তা নেই। থাকলেই বা কী হতো। যদি লোকজনকে এসবের মহড়া দিয়ে সতর্ক-শেখানো না হয়।

 ঘটনার পর দায়িত্বশীল লোকজনের চিরায়ত গৎবাঁধা কথা শুনে অসহায় লাগছিল। তদন্ত কমিটি, এই করবো সেই করবো এমন একশ বয়ান। অগ্নি দূর্ঘটনা প্রতিরোধের মৌলিক চাহিদা-প্রস্তুতিগুলোতে সবাইকে অভ্যস্ত করুন। প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক করুন। আন্তর্জাতিক মানের বিল্ডিং কোড হচ্ছে প্রতিটি ভবনের আশপাশে পর্যাপ্ত খালি জায়গা-বাগান-নিজস্ব পার্কিং-পানির ব্যবস্থা সহ সবকিছু থাকতে হবে। অথচ বাংলাদেশে যেখানে সেখানে  বানিয়ে ফেলা হয়েছে গায়েগায়ে সব বহুতল ভবন! এখনও বানানো হচ্ছে! এগুলো ভেঙ্গে ফেলা ছিল প্রথম কর্তব্য। আপনারা যেহেতু তা ভাঙ্গবেননা, ভাঙ্গতে পারবেননা, অতএব প্রতিটি বাড়ি-ভবন ভিত্তিক নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে বাসিন্দাদের সচেতন তৈরি করুন। অযথা বিরক্তিকর বক্তৃতা-বয়ান বন্ধ করুন প্লিজ।

পরিকল্পনার অভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাবে এমনতি ঢাকা শহর এখন তাই একটি ভুল শহর। এ শহর এখন বাস অযোগ্য হিসাবে বিদেশ থেকে অপমানকর সব সিরিয়াল জিতছে। বাংলাদেশের কোন শহরটি এখন শুদ্ধ নিরাপদ? কোনটিই না। দিনে দিনে গ্রামগুলোও অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে। কারন কোথাও কোন নিরাপদ নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছেনা। এত মানুষের গিজগিজ অবস্থার দেশ। চুড়িহাট্টা বা বনানীর ঘটনা যে কোন স্থানে ঘটতে পারে যে কোন দিন বা রাতে। ভূমিকম্পের বিপদতো আছেই। নেপালে সর্বশেষ যে মাত্রার বিধবংসী ভূমিকম্প হয়েছে তা ঢাকায় হলে গায়েগায়ে লাগানো বিধবস্ত সব ভবন একটার ওপর আরেকটা পড়ে যে অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তাতে মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর যেতে সাতদিন সময় লাগবে। ওয়াসার লাইন ফেটে বন্যায় ডুবে যাবে শহর। গ্যাস লাইন ফেটে আগুন ধরে যাবে। এসব ঘটনা কভার করার মতো মিডিয়াও থাকবেনা। কারন অনেকেই বেঁচে থাকবেনা সেই মহাদূর্যোগে। এসব শুনেছিলাম ঢাকার একটি সেমিনারে। এসব ভেবে আপাতত কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। কারন তেমন পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি সামর্থও কোনটাই নেই বাংলাদেশের। আপাতত আগুন দূর্যোগ থামান। এই যে মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়, ডিএনএ পরীক্ষা সহ নানাকিছুতে নিশ্চিত করতে হয় তার পরিচয়, এটি তাদের স্বজনদের জন্যে দূর্ভাগ্যের। ভুল শহর ভুল মানুষের পরিচয় থেকে ঢাকাকে তার নিজস্ব পরিচয়ে ফেরানোর আন্তরিক উদ্যোগ নিন প্লিজ। আসল রোগে হাত না দিয়ে লক্ষনে মলম লাগানোর প্রবনতা দুই নাম্বারি।


Place your ads here!

Related Articles

Towards 1952

Between August 1947 and 21 February 1952 Independence of Pakistan in 1947 and Bangla language movement in 1952 – what

প্রবাসীর বইমেলা এবং বইকেনা

বইমেলাতে যাওয়ার শুরু স্কুল জীবন থেকেই। একেবারে মফস্বলে বেড়ে ওঠা আমাদের কাছে গল্পের বই বলতে বাংলা প্রথম পত্রের সাথে বাড়তি

Bangla article on God Particle

( উপরের ছবি দুটির বাম পাশের ছবিটি হোল সার্ণ গভেষণার ফলাফল ঘোষণার অডিটোরিয়াম হল ৪ঠা জুলাই ২০১২ জেনেভার কাছে মেরিনে

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment