মন্ত্রিসভার ভূমিকম্প

ফজলুল বারী: নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা নিয়ে লিখতে বেশ দেরি করে ফেললাম। বিদেশে আমরা যারা থাকি জীবিকার কাজ আমাদের পয়লা নাম্বার ইবাদত। এরপর সময় বাঁচিয়ে আমি লিখি-পড়ি-বাগান পরিচর্যার কাজ করি। এই মন্ত্রিসভার ঘোষনার আগে আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন মন্ত্রিসভায়ও চমক থাকবে। কিন্তু চমক যে এ পর্যায়ের থাকবে তা নিশ্চয় খুব বেশি মানুষ ভাবেননি। আমি মাঝে মাঝে বিভিন্ন লেখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর একটি মন্তব্য কাজে লাগাই। দেশে থাকতে মাঝে জনাব মঞ্জুর আড্ডায় যেতাম। পছন্দের রিপোর্টারদের সঙ্গে তার এই ডিনার কাম আড্ডা চলতো হোটেল সোনারগাঁও বা শেরাটনে। মজার মানুষ জনাব মঞ্জু সেখানে শুরুতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলতেন, ফজলুল বারী বলোতো দেশের খবর কী।
দেশের খবর ঢের জানার ব্যবস্থা আছে জনাব মঞ্জুর। কিন্তু তার যে সবার কথা জানার-শোনার আন্তরিক আগ্রহ তা নজর কাড়তো। এমন এক আড্ডায় জনাব মঞ্জু একদিন বলেছিলেন, দেশেতো শেখ হাসিনা ছাড়া কোন রাজনীতিক নেই। তিনি (শেখ হাসিনা) কিছুদিন পরপর একটা রাজনৈতিক চাল চালেন আর আমরা তা নিয়ে নাচি। এভাবে নাচতে নাচতে ক্লান্ত-একঘেয়ে হয়ে গেলে তিনি চালেন আরেকটি চাল। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা নিয়ে এই শেষ চালে নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তাও এক প্রকার চাপা পড়ে গেছে। মন্ত্রিসভা ভূমিকম্পে অনেক রাঘববোয়াল মন্ত্রীর সঙ্গে বাদ পড়েছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও। কেনো এই মন্ত্রিসভা ভূমিকম্প শেখ হাসিনার? গত কয়েকদিনে তা জানার চেষ্টা করেছি। এসব গল্পও হতে পারে। কারন আসল কারন শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ জানেন না।
গত নির্বাচনে আমি আমার লেখালেখিতে আজান দিয়ে চাইছিলাম শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসুক। এটি কোন লুকোচাপার বিষয় ছিলোনা। লুকোচাপা করে আজান হয়না। কেনো চাইছিলাম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক তাও সবার কাছে স্পষ্ট। দেশের চলতি উন্নয়ন অগ্রগতির ধারবাহিকতার বিষয়তো আছেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতো। মুখে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করা আজকের মক্কা বদলকারী ডক্টর কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকীদের আমি এক্ষেত্রে জ্ঞানপাপী বলি। তাদের পাশে বসিয়ে রেখে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার মহাসচিব মির্জা ফখরুল ডক্টর কামালদের লেখা ড্রাফট এডিট করে বঙ্গবন্ধু বাদ দিয়ে শুধু শেখ মুজিব বলেন! অথচ তারা এই ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করতে পারেননা! বঙ্গবন্ধু আর জয়বাংলা বলতে সূচিবায়ুগ্রস্ত কোন ব্যক্তিকে আমি এখন আর মুক্তিযোদ্ধা মনে করিনা।
এবার মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি শেখ হাসিনা সেরেছেন ঠান্ডা মাথায় এবং বেশ গুছিয়ে। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা ঘোষনার ইতিহাসটি হলো বঙ্গভবন থেকে ডাক পাবার আগ পর্যন্ত কেউ জানেননা কে মন্ত্রী হচ্ছেন বা কে বাদ পড়ছেন। বঙ্গভবন থেকে এবারও ডাক এসেছে। কিন্তু তা শপথের আগ মুহুর্তে নয়। আগেভাগে। ধাক্কা সামলে হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি এড়াবার সবাই যথেষ্ট সময় পেয়েছেন। কিন্তু কেনো এই ভূমিকম্প? নির্বাচনের আগেভাগে শেখ হাসিনার কিছু বক্তব্যে এর আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষে লেখালেখি করতে গিয়ে একটি সংকট মোটাদাগে ধরা পড়ছিলো। তাহলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকারের দেশজুড়ে দৃশ্যমান উন্নয়ন-অগ্রগতি দেশের মানুষ মানলেও তারা এ বিষয়টি নিয়ে অন্য একটি কারনে কনভিন্সড না।
অন্য কারনটি হলো মানুষ উন্নয়ন-অগ্রগতি দেখেছেন, কিন্তু এরসঙ্গে জড়িত দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে হতাশ-অসন্তুষ্টও ছিলেন। এ খবর শেখ হাসিনার কাছেও ছিল। নয়া মন্ত্রিসভা ঘোষনার সময় শেখ হাসিনা বিষয়টি মাথায় রেখেছেন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রীদের তিনি নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছেন। পুরনো মন্ত্রীদের কে কোন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা তারা জানেন। বুকে হাত দিয়ে বিষয়গুলো এখন মিলিয়ে দেখতে পারেন। তারা কে কোথায় কী করছিলেন তা শেখ হাসিনা জানছেননা, বুঝছেননা এমন শিশুতোষ ধারনা তাদের কী করে হলো? এমন লোকজনেরতো মন্ত্রিসভায় থাকা যে উচিত না তা শেখ হাসিনা জেনেবুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমার হতাশা হলো এমন দুর্নীতিবাজদের বিচারের সম্মুখিন করা হবে তা আমি মনে করিনা। বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির নকশাটাই এমন। দুর্নীতিবাজদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়াটাকেই এখানে শুধু শাস্তি মনে করা হয়।
দুর্নীতির বাইরে শেখ হাসিনা নতুন মন্ত্রিসভা গঠনে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েছেন তাহলো বিতর্ক এবং বয়স। এর আগে বিতর্কের কারনে অনেককে নির্বাচনে মনোনয়নও দেয়া হয়নি। যেমন দুর্নীতির কারনে নয়, বিতর্কের কারনে বাদ পড়েছেন শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শেখ হাসিনা আবার সৎ মানুষকে মর্যাদা দেন। সে কারনে তার আসনে বিকল্প ধারার শমসের মবিন চৌধুরীকে মনোনয়ন দেননি। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস, পরীক্ষা বিতর্কের জন্যে নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা দেননি নুরুল ইসলাম নাহিদকে। যেমন বয়সের কারনে বাদ পড়েছেন আরেক দুর্নীতিমুক্ত মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। যে কোন সভা, এমনকি মন্ত্রিসভার বৈঠকেও তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। কৃষিমন্ত্রী হিসাবে তার ভূমিকা স্মরনীয় হয়ে থাকবে।
বেয়াই মন্ত্রী বাদ পড়ার পিছনে ফরিদপুরে হিন্দু সম্পত্তির দিকে নজর, তার ভাগ্নি জামাই পরিচয়ে একজনের দুর্নীতির বিশাল ফর্দের কথাও বলা হয়েছে। শহীদের সন্তান ও শারীরিক প্রতিবন্ধী সাংবাদিক প্রবীর শিকদার যাকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে চিকিৎসা করান শেখ হাসিনা, তাঁর বিরুদ্ধে বেয়াইর আক্রোশ, গ্রেফতার করিয়ে টেনেহিঁচড়ে ফরিদপুর নিয়ে যাবার ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি এবং পুরো সরকারকে বিব্রত করে। ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী না, ক্ষমতা পেলেই যে যা খুশি করা যায়না, বেয়াইর গদিচ্যুতি এর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আরেকটি তথ্য শেখ হাসিনা এবার একটি আত্মীয়মুক্ত মন্ত্রিসভা চেয়েছেন। সে কারনে চাচার পরিবারের তিন সদস্যকে এমপি করে আনলেও তাদের কাউকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেননি। আত্মীয়দের মন্ত্রিসভায় রাখবেননা এ ঘোষনায় প্রধানমন্ত্রী এবারও অবদমিত করেছেন শেখ সেলিমের মন্ত্রী হবার আগ্রহ। শেখ সেলিম এর আগে এ প্রশ্নে বেয়াইকে দেখাতেন। বেয়াই বাদ যাওয়ায় তারও আর দাবি করে বলার সুযোগ খর্ব হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালের অভিজ্ঞতায় বিবেচনা পাননি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহও।
নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষনা দিয়েছিলেন। নতুন মন্ত্রিসভা এর পয়লা পদক্ষেপ। শেখ হাসিনা যা বলেন তা করেন এবং করতে পারেন তা দেশের মানুষের মতো আমিও বিশ্বাস করি। কারন ব্যক্তিগতভাবে এবং পারিবারিকভাবে তিনি দূর্নীতির উর্ধে। তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজই তাই বলে। যিনি নিজের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকেন তিনিই এমন অকপটে যে কোন কথা বলতে পারেন, যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। শেখ হাসিনা এরমাঝে বলে রেখেছেন নতুন মন্ত্রীদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হবে। এটি তাঁর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের বার্তা। কিন্তু এই মন্ত্রিসভার দুটি মন্ত্রিত্ব আমার পছন্দ হয়নি। তাহলো তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ আর কামাল মজুমদারকে মন্ত্রী করা। হাসান মাহমুদকে বলা হয় আওয়ামী লীগের রিজভি।
তথ্যমন্ত্রীর পদে সাংবাদিক কাউকে নেয়া হলে মিডিয়ার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক আরও ভালো হতো। স্কুলের অতিরিক্ত ফী নিয়ে কামাল মজুমদারের ঘটনাক্রম ঢাকাবাসী ভুলেনি। সৎ জীবনযাপন করলে কি করে বারবার মন্ত্রিসভায় এবং শেখ হাসিনার গুডবুকে থাকা যায় এর প্রমান ইয়াসেফ ওসমান। আশা করছি তার নেতৃত্বে এবার রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দেশের জন্যে নতুন মাইল ফলক হবে। প্রবীন নেতা নুরুল মজিদ হুমায়ুনকে মন্ত্রী করাটা শেখ হাসিনার বিশেষ এক নিয়মিত অভ্যাসের অংশ। প্রতিবার তিনি খুঁজে খুঁজে তিনি তৃনমূলের নতুন একজনকে মন্ত্রী করেন। নুরুল মজিদ হুমায়ুন প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন আশা করছি। প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ন পছন্দ স ম রেজাউল করিম। তাঁর গ্রাম হবে শহর’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার মতো একজন মন্ত্রীরই দরকার ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লোটাস কামাল, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে আব্দুল মোমেন, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে হিসাবে দীপু মনি-নওফেল টিম চমৎকার পছন্দ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।
আমার ধারনা শেখ হাসিনা তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রিয় ছোট আপা এবং বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাকে তৈরি করছেন। সরকারের চলতি মেয়াদের পদ্মা সেতু সহ মেগা প্রকল্প বেশক’টির কাজ শেষ হবে। সরকারের সব কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে নতুন কর্মসংস্থান। শেখ হাসিনা একটি গতিশীল মন্ত্রিসভা বেছে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট ১৪ দল থেকেও আগামীতে মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ আসবে। গত নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা আর একবারের জন্যে দেশবাসীর কাছে সুযোগ চেয়েছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কাজ করতে শুরু করলে আমার ধারনা আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত নিষিদ্ধ হবে সরকারের এই মেয়াদে। শেখ রেহানা হবেন দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের কান্ডারী থাকবে শেখ হাসিনার হাতে।
Related Articles
Zaglul Ahmed Chowdhury: As I knew him
Zaglul Ahmed Chowdhury’s tragic demise due to the road accident on 29th November was the most wrenching piece of news
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কি সুদ মুক্ত সমাজ চান?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি আপনি সংসদে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু গুরুতপূর্ণ কথা বলেছেন। দৈনিক আমাদের সময় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ড. মোহাম্মদ
Election and Democracy in Bangladesh, The Unknown Riddle and Proposal for Improvement
Introduction: In the contemporary world, in comparison with dictator’s, military’s or kings’ rule, democratic governance by the elected representatives is