মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ সময়
ফজলুল বারী: প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েরা প্রায় জানতে এই সময়ে কোন মানবিক দায়িত্বটা তারা পালন করতে পারে? তাদের যে সব পরামর্শ দেই এর একটি হলো সম্ভব হলে এলাকার বা প্রতিবেশী কোন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে একটু সময়-সঙ্গ দাও। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগ এখন বয়োঃবৃদ্ধ, অসুস্থ। আগামী দশ-বারো বছর পর জীবিত মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যাবে কম। একদিন যৌবনে অকুতোভয় যারা আমাদের জন্যে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিতে জীবনপন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করা ছাড়া সেদিন তাদের চাওয়াপাওয়ার কিছু ছিলোনা। এর বাইরে স্বার্থ-ধান্ধার অন্বেষনে মুক্তিযুদ্ধে কেউ যায়না বা যাওয়া যায়না। সেদিনের সেই অকুতোভয় অদম্য সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য-বীর্যের ফসল আমাদের আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। তাদের কারনেই আজ দেশেবিদেশে আমরা মাথা উঁচু করা হাঁটা-চলা এক অদম্য জাতি বাংলাদেশি বাঙালি। তাদের শেষ সময়টায় একটু সময়-সঙ্গ দিয়ে যদি তাদের ঋণ কিছুটা শোধরাবার চেষ্টা করতে পারি আমরা।
আমি সব সময় অভিভাবকদের পরামর্শ দেই, আপনার বাচ্চাদের যখন পারেন কোন একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যান। সঙ্গে নিন উপহার হিসাবে কিছু ফুল-খাবার বা জামাকাপড়। এতে করে আপনার বাচ্চারা আপনার কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানোটা শিখবে। আপনি যদি বাচ্চাদের মুক্তিযোদ্ধার কাছে নিয়ে যান তারা তার বা তাদের কাছে শুনবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার গল্প। তাদের অকুতোভয় যুদ্ধের সেই সময়ের গল্প। বেশিরভাগ বয়োঃবৃদ্ধ-অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধারা আজ অনেকটা একাকিত্বে ভুগছেন। আপনি যদি আপনার বাচ্চাদের নিয়ে তাদের কাছে যান, আপনাদের সান্নিধ্যে ঘুচবে তাদের একাকিত্ব। এতে করে তাদের জীবনীশক্তি কিছুটা হলেও বাড়বে। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ লোক ঈদে সপরিবারে বাড়ি যান। ওই সময়েও তারা বাচ্চাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। ঈদে সবাই নিজের জন্যে নতুন জামাকাপড় কেনার চেষ্টা করেন। ওইসময়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যেও উপহার কেনাকাটার সামান্য বাজেট যদি রাখেন সেখান থেকেও মহানুভব কিছু করাটা শিখবে আপনার বাচ্চারা। শেষ দিনগুলোয় মুক্তিযোদ্ধাদেরও কিছুটা সম্মান দেয়া হবে। এসব বিষয় আমি সবাইকে বারবার তাগাদা দিয়ে বলি এই কারনেই যে খুব আর বেশিদিন বাঁচবেননা আমাদের সেই সময়ের শ্রেশঠ সন্তানেরা। আগামী কয়েকবছর পর তাদের বেশিরভাগকে সম্মান দিতে আমরা চাইলেও খুঁজে পাবো না আর। অতএব এখনই সময়।
আমি বিদেশে থাকি। দেশে যাদের কাজটিতে উৎসাহিত করি নিজে তা সেভাবে করতে পারিনা। তবে অনেক বছর থেকে সংযুক্ত আছি একজন মুক্তিযোদ্ধার সেবায়। ইনি আবু সাঈদ আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১ নম্বর সেক্টরের সালাহউদ্দিন সাব সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টরগুলো সংশ্লিষ্ট নেতৃ্ত্বের মুক্তিযোদ্ধাদের নামে পরিচিত ছিল। তিনি সাঈদ ভাই তা না করে তার সাব সেক্টরের যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনের নামে তার সাব সেক্টর কমান্ডের নামকরন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধে অনেক স্মরণীয় ভয়াবহ যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত এই সালাহউদ্দিন কমান্ড। আমি যখন জামালপুরের ধানুয়া কামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজতে যাই, সালাহউদ্দিন কমান্ডার যুদ্ধের গল্প শুনেছি সে এলাকাবাসীর মুখে।
আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় এলাকায় এলাকায় ঘুরে ঘুরে আমি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভ্যু করে আমি তাদের কাছ থেকে ওই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতাম। তাদের কাছে শুনতাম জানতাম এলাকার যুদ্ধ শুরুর দিনগুলোর বৃত্তান্ত, তাদের যুদ্ধে যাওয়া গল্প, স্মরনীয় কিছু যুদ্ধের বৃত্তান্ত। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকারদের তালিকাটিও সংগ্রহ করতাম তাদের কাছে। সেই সময়ে নেত্রকোনার পূর্বধলার শ্যামগঞ্জে পৌঁছে এলাকার তথ্য সংগ্রহে আমি যখন একজন মুক্তিযোদ্ধা খুঁজছিলাম তখন এলাকার লোকজন একটি দোকান দেখিয়ে দিয়ে বলেন ওখানে সাঈদ মুক্তিযোদ্ধা বলে একজন আছেন তার কাছে যান। তার কাছেই সব পাবেন। সেই থেকে আমি সাঈদ ভাইকেও পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হবার আগে আমি জানতামনা তার কথা। জানতামনা তিনি মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের ছোটভাই। জানতামনা তাহেরের সমাধিও সেখানে। জানতামনা এটি এমন একটি পরিবার যে পরিবারের সব সদস্য, সব ভাইবোন মুক্তিযোদ্ধা। এদের সবাই প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা।
সেই থেকে সাঈদ ভাই আমার ভাই। তার মা আমার মা। একজন মানুষ নিজের সংসার, ক্যারিয়ার ভুলে সারাক্ষন বাংলাদেশ বাংলাদেশ করে, সারাক্ষন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে এমন সাঈদ ভাইর মতো আমি খুব কম দেখেছি। ঢাকায় যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তখনও সাঈদ ভাই দেখা করতে আসতেন। যখন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম তখন সাঈদ ভাইতো ভীষন ক্ষিপ্ত আমার ওপর। তার কথা আমার মতো ছেলে যদি চাকরি, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় তাহলে বিপ্লব করবে কে। এরমাঝে বিদেশে এসে দেশের অনেককিছুর মতো আমি হারিয়ে ফেলি আমার সাঈদ ভাইকেও। যখন শুনি তার করুন বৃত্তান্ত, থমকে যেতে হয়।
সাঈদ ভাই বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে ঘরছাড়া ব্যস্ত থাকলেও তাদের একমাত্র মেয়ে লোপা, একমাত্র ছেলে তূর্যকে মানুষ করেছিলেন তার স্ত্রী পপি ভাবী। বুয়েট থেকে প্রকৌশল ডিগ্রী নিয়ে একটা চাকরিও শুরু করছিল তুর্য। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেড়াতে গিয়ে অস্তমিত হয় সে সূর্য! কাপ্তাই লেকে গোসল করতে নেমে পানিতে তলিয়ে যায় তূর্য। সন্তানের লাশ এ পিতার কাছেও এতো ভারী ছিল যে তা সহ্য করতে পারেননি আমার সাঈদ ভাইও। সেই থেকে মানসিকভাবে বিধস্ত সাঈদ ভাই হয়ে পড়েন স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী! তার মতো লোক যখন গৃহবন্দী হয়, সঙ্গে ফুরিয়ে আসে তার জীবনীশক্তি। নানান অসুখ বাসা বাঁধে তার শরীরে।
এরমাঝে তার দেখভালের বিষয়াদি নিয়েও সংকটের সৃষ্টি হয়। একমাত্র ছেলে অকালে মারা গেছে। একমাত্র মেয়েকে স্বামীর কাছে বিদেশে চলে যেতে হওয়ায় চাল-চুলোবিহীন মানুষটিকে দেখার দায়িত্ব নেন তার অনুজ মুক্তিযোদ্ধা এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। তিনি তার ন্যাম ভবনের ফ্ল্যাটে ভাইকে রেখে তার চিকিৎসা সহ নানাকিছুর দেখভাল করে যাচ্ছেন। ঢাকায় আমার এমন স্বজনদের দেখভালের জন্যে কাজী বাহার নামের স্বেচ্ছাসেবী যুবক আছে। যেখানে যখন দরকার তখন বললেই সেখানে দ্রুত ছুটে যায় বাহার। সর্বশেষ সাঈদ ভাইকে দেখে এসে বাহার যা বললো তাতে আমি বিচলিতবোধ করি। সাঈদ ভাই আর চোখে দেখেননা অথবা কাউকে চিনতে পারেননা। খেতে পারেননা অথবা খেতে চাননা বলে শুকিয়ে মড়ার মতো হয়ে পড়েছেন আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা সাঈদ ভাই।
এখন সাঈদ ভাইর সঙ্গে আমি পপি ভাবীর ভবিষ্যত নিয়েও ভাবি। ঢাকায় তাদের মাথাগোজার কোন ঠাই নেই। নিজের জন্যে কোনদিন সরকারের কাছে কোন প্লট বা আশ্রয় তিনি চাননি অথবা পাননি। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। নব্বুইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের যখন আজকের মতো অত লোকজন ছিলোনা তখন শেখ হাসিনাকে নিয়ে অনেক প্রোগ্রাম করেছেন সাঈদ ভাই। বিচলিত আমি প্রধানমন্ত্রী দফতরে কাজ করেন আমার এমন এক ঘনিষ্ঠ ছোটভাই আশরাফুল আলম খোকনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সে যোগাযোগ করে বেলাল ভাইর সঙ্গে। বেলাল ভাই আমাকে বলেন সাঈদ ভাই প্রধানমন্ত্রীর কোন সহায়তা নেবেন কিনা তা তিনি নিশ্চিত নন। সাঈদ ভাইতো কোনদিন কিছু চাননি, নেননি, এখন তার কিছু চাইবার-নেবার অবস্থাও নেই। তার সততা সহ সব গৌরব ধরে রাখা আমার পপি ভাবীর পাশে দাঁড়াবে কী রাষ্ট্র? প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনাকে খুব নির্ভর করি, প্লিজ উদ্যোগটি নিন। প্লিজ।
Related Articles
Concerns of Patriotic Awami League Supporters
Many supporters of the Awami League (AL) are very conscious and patriotic, who support the AL because they love Bangladesh
Cake cutting for Birthday
জম্মদিনের কেক কাটা -ড. ফরিদ আহমেদবিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবার ৬৬ পাঊন্ড ওজনের কেক কেটে ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক
21st February: A Day of Mourning, Pride Action
21st February is a day of national mourning, pride, reflection and action. It is the Language Martyr’s Day. It is