হাওরের রাজনীতিক – সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

হাওরের রাজনীতিক – সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

ফজলুল বারী: দাদা’র জন্যে শোকলিপি। শুরুটা কিভাবে করি তা বুঝে উঠতে পারছিনা। চোখ বারবার ভিজে আসছে। ছেলেবেলায় প্রথম তার নাম শুনি ‘হাওরের রাজনীতিক’। সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত দিরাই-শাল্লা এলাকা থেকে তার উত্থান। সে এলাকার মাইলের পর মাইল শুধু জলরাশি হাওরের। নৌকা ছিল যেখানকার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। শুকনো মওসুমে মাইলের পর মাইল হাঁটা পথ। বর্ষায় পূর্নিমার রাতে হাওরের জলরাশিতে আলোর নাচন খেলে বলে হাছন রাজা, আব্দুর রহমান বয়াতিদের উৎস ভূমিও সে অঞ্চল। সে এলাকায় বাড়ি বলে সুরঞ্জিতেরও নাম হয় হাওরের রাজনীতিক। সেখান থেকে সুনামগঞ্জ-সিলেট হয়ে ঢাকার ঝিকাতলায় এসে থিতু হলেও হাওরের রাজনীতিকের অভিধাটি তার নাম থেকে বাদ যায়নি। মৃত্যুর পর সেই হাওরের কাছেই তিনি ফিরে যাচ্ছেন। সেখানেই হবে তার শেষকৃত্য এবং সমাধি।
স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে হেঁটে আমাদের সাংবাদিকতার শুরু। ঢাকার রাজনীতিকদের তখন থেকেই প্রথম কাছে থেকে দেখি। চিনি-জানি। তৎকালীন ছাত্রনেতাদের অনেকের সঙ্গে তখন বন্ধুত্ব হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তখনও প্রবীন রাজনীতিক। অতএব তাকে দেখি দূর থেকে। আস্তে আস্তে সাহস করে সামনে যেতে শুরু করি। একজন রাজনীতিক কত আগে থেকে রাজনীতি শুরু করলেও এরশাদ জমানায়ও তিনি দেশের অন্যতম প্রবীন রাজনীতিক হন? বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের শুরু থেকেই তিনি এর সদস্য। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম কমিটির সদস্য ছিলেন। তখন তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপের সংসদ সদস্য। এরপর গড়েন নিজের দল একতা পার্টি। সেখান থেকে আওয়ামী লীগে। সব সময়ই তিনি সংসদ সদস্য। আগে পড়াশুনা জানা লোকজন রাজনীতিতে আসতেন। এমপি পদে দাঁড়াতেন। কারন এমপিরা আইন প্রণয়ন-পাশ করেন। সুরঞ্জিতের সেই সময় বয়সে তার পড়াশুনা-প্রজ্ঞার কারনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য না হওয়া স্বত্ত্বেও সংবিধান প্রণয়ন কমিটি থেকে তাকে বাদ রাখা যায়নি।
সিলেট অঞ্চলের আওয়ামী লীগে তখন আব্দুস সামাদ আজাদের একচ্ছত্র কর্তৃ্ত্ব। সুনামগঞ্জ থেকে আসেন আব্দুস সামাদ আজাদও। প্রচার আছে কর্তৃ্ত্ব খর্ব হতে পারে সে আশংকায় আব্দুস সামাদ আজাদ চাইতেন না সুরঞ্জিত আওয়ামী লীগে যোগ দিন। একই কারনে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে না পেরে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে স্পিকার হন সিলেট অঞ্চলের আরেক ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। অতঃপর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামী লীগে যোগ দিতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে। কিন্তু কর্তৃত্ত্বের দ্বন্দ্ব থেমে যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী, সুরঞ্জিতকে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়। কিন্তু সুরঞ্জিতের পক্ষের নেতাকর্মীদের ভোগান্তি থেমে থাকেনি একদিনের জন্যেও। ছাতকের মুহিবুর রহমান মানিকের ভোগান্তি মনে আছে সবার।
এরপরও আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলে সুরঞ্জিত টিকে ছিলেন নিজের প্রজ্ঞায়। জাতীয় সংসদে তার এখানে নিজস্ব একটি আসন ছিল। সরকারি দল অথবা বিরোধীদল হলেও বরাবর তার স্থানটি ছিল সামনের সারিতে। সংসদে সুরঞ্জিতের রসঘন বক্তৃতার ঝাঁঝ টের পেতেন যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদার মতো ব্যক্তিরা। সিলেটি আঞ্চলিক ভাষার কৌতুকে সুবিধাবাদী রাজনীতিক নাজমুল হুদাকে ‘বেহুদা’ ছাড়া খুব কম বলতেন। সুরঞ্জিতের তিরোধানে বাংলাদেশ তার অন্যতম শেষ অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের পাশাপাশি রসবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিটিকেও হারিয়েছে। জাতীয় সংসদ তাকে অনেক মিস করবে।
সাংবাদিকতায় আমাদের শেখার দিনগুলোতে নানান রাজনৈতিক সংকটে নানাকিছুর সাংবিধানিক ব্যাখ্যা জানতে আমরা চলে যেতাম সুরঞ্জিত দাদার কাছে। যা জানতে চাই তিনি বলে দিতেন এক-দুই মিনিটে। বাকিটা সময় চলতো জমজমাট আড্ডা। রাজনৈতিক রিপোর্টারদের প্রায় সবাইকে তিনি নামে নামে চিনতেন। নাম ধরে ডাকতেন। একবার ঢাকার বাইরে কোন একটি ট্যুরে এক হোটেলে তার সঙ্গে দেখা। এর আগে দেশের বাইরে নানান রিপোর্টিং ট্যুরে ট্যুরে দীর্ঘদিন লম্বা সময় রাজনৈতিক রিপোর্টের বাইরে থাকায় অনেক দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমাকে সে বার দেখেই একান্তে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তুমি রেবা সিলটি পুয়া দেশো দেশো ঘুরিয়া যে সব রিপোর্ট কররায় সিলটি হিসাবে আমরা এর লাগি বহুত প্রাউড ফিল করি’। তার সঙ্গে সেই দেখার কিছুদিন পর পড়াশুনা উপলক্ষে আমি অস্ট্রেলিয়া চলে আসি। এরপর এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করায় তার সঙ্গে আর সামনাসামনি দেখা হয়নি। ছেলেবেলায় দূর থেকে দেখেশুনে তাকে জেনেছি। আবার তিনি হয়ে যান আমার দূরের মানুষ।
এরমাঝে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওয়ান ইলেভেন নামের ঝড় আসে। সে ঝড়ে তছনছ হয়ে যায় অনেক রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ। শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে নানান হিসেবি-বিহিসেবি সমীকরনে ওলটপালট হয় বড় দুইখানা রাজনৈতিক ঘর। রাজনৈতিক সংস্কারের সে ঝড়ে পড়েন সুরঞ্জিতের মতো রাজনীতিকও। আওয়ামী লীগ-বিএনপি করতে হলে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া যে সবার উপরে সত্য, চোখ-দম বন্ধ করে তা মেনে চলতে জানতে হয়, সে ভুলটি আওয়ামী লীগের অনেক বাঘা নেতার সঙ্গে সুরঞ্জিতেরও হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে ক্ষমতায় ফিরলে সুরঞ্জিতও হন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য। কিন্তু সিনিয়র অনেক নেতার মতো তিনিও হারান প্রেসিডিয়ামের সদস্যপদ। এরপর সংবিধান সংশোধন কমিটির মূল ব্যক্তি হিসাবে বাহত্তরের ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধানে ফেরত যাবার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, দেশবাসীকেও দেখিয়েছিলেন। পরে তা কেন হয়নি তা সবাই জানেন। সুরঞ্জিত রেলমন্ত্রী হন। কিন্তু বিশ্রী এক ঘটনায় সেখান থেকে ছিটকেও পড়েন। এরপর থেকে তার ভূমিকাটি মূলত ছিল সভা-সমিতির বিবেকের ভূমিকার। যা সত্য তা বলতেন অকপটে। এই সময়গুলোয় তার রসঘন একটি বক্তব্য দেশের সমসাময়িক রাজনীতিতে বেদবাক্যের অভিধা পায়! বক্তব্যটি হচ্ছে ‘বাঘে ধরলেও ছাড়ে কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়েনা’!
কিন্তু অতঃপর সবকিছু ছেড়ে গেলেন বাংলাদেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিক-পার্লামেন্টিরিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পরিণত বয়সে তার মৃত্যু হলেও তার অভাব বাংলাদেশ অনেক দিন ফিল করে যাবে। কারন প্রজ্ঞায়-রসবোধে তার বিকল্প দ্বিতীয় কেউ রইলোনা বাংলাদেশের সংসদে। আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার মৃত্যুর পরও তাই তাকে বলেছেন, তিনি ছিলেন ‘নাম্বার ওয়ান পার্লামেন্টারিয়ান’। রাজনীতিকদের জীবন কত সাদাসিদে হতে পারে তার অন্যতম শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। হাওরের জলমাটির স্পর্শে গড়ে বেড়ে ওঠা মানুষটি আবার ফিরে গেলেন হাওর এলাকাটিতেই। এই সিদ্ধান্তটিও তিনি নিয়ে গেছেন। মাটির মায়ায় একজন মাটির মানুষের এর চেয়ে আপন-আপনার সিদ্ধান্ত কী হতে পারে? আমাকে একজন লিখেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নেই তা কে বলেছে, বাংলাদেশের সংবিধান খুললেই দেখা যাবে সুরঞ্জিত দাদা’র মুখ। অনেক শ্রদ্ধা তোমাকে দাদা। ভালো থেকো না ফেরার দেশে। নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, ‘অনন্ত কালের তরে, গৌড়মন মধু করে, পান করি করিবেক, যশস্বী তোমারে।‘


Place your ads here!

Related Articles

বিএনপি রোপনকৃত রাজনীতির বিষবৃক্ষ জঙ্গিবাদ উদপাদনের কারখানা – হাসানুল হক ইনু

বাংলাদেশ সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বর্তমান সম্মানিত সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতির বিষবৃক্ষ বিএনপি

Tidal Wave and Wind Power as renewable energy for Bangladesh

Currently the total demand for power in Bangladesh is about 5,500 MW (megawatts), while renewable energy covers only 30 MW

নাকফুল কেড়ে নিওনা বিপন্ন রোহিঙ্গা নারীর

ফজলুল বারী: বাংলাদেশের কিছু অসভ্য লোকের একটি বদভ্যাস হলো তার হিন্দু প্রতিবেশীকে মালাউন বলে গালি দেয়া! এর পিছনে ধর্মীয় আক্রোশ

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment