সেই একটি ছবির গল্প

সেই একটি ছবির গল্প

ফজলুল বারী: সেই ছবির দিনও আমি সংসদ ভবনে ছিলাম। শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলের নেত্রী। একটি ওয়াক আউটের ঘটনার পর বিরোধীদলের নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনের টেবিলের পাশাপাশি চেয়ারে এসে বসেছেন জামায়াতের মতিউর রহমান নিজামী, জাতীয় পার্টির ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ সহ আরও কয়েকজন। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কেউ নিজামীকে সেখানে ডেকে আনেননি। কৌশলী নিজামী নিজের একটি গ্রহনযোগ্যতা তৈরির আশায় বিরোধীদলের একজন এমপির দাবিতে বিরোধীদলের নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনের টেবিলে এসে বসে পড়েছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। কারন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ সবকিছু পারেনা। আল বদর নেতাকে নিয়ে খালেদা জিয়া তাদের সঙ্গে ঘরসংসারও করতে পারেন। শেখ হাসিনা পারেননা। সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ তাৎক্ষনিক সতর্ক হয়। এরপর আর কোনদিন নিজামী বা জামায়াতের কেউ সেই মঞ্চে এসে বসতে পারেননি। সেই সময় খালেদা জিয়া বিরোধী আন্দোলনের লিঁয়াজো কমিটির বৈঠক হতো আব্দুস সামাদ আজাদের কলাবাগানের বাসায়। সেই বৈঠকে জামায়াতের পক্ষে আসতেন কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান। কিন্তু কোনদিন কোন ছবি হয়নি। কারন সব ছবি আওয়ামী সহ্য করতে পারেনা। নিজামী সেই ছবিটা এখনও অনেকে নানা সময়ে উঁচিয়ে দেখিয়ে অনেকে আমাদের অনেক কটাক্ষ করে। কিন্তু এ রকম দ্বিতীয় কোন ছবি কেউ আর দেখাতে পারেনা।

অনেক দিন পর আরও দুটি ছবি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবি! কিছুদিন আগেও এমন কোন ছবি কষ্ট কল্পিত ছিল। কারন হেফাজতের এই নেতারাও যুদ্ধাপরাধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেজামী ইসলামীর ব্যানারে এরা পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। তাদের মাদ্রাসাগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের টর্চার সেল। আজ পর্যন্ত এরা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালো্বাসি’ গায় না। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে অভূতপূর্ব গণজাগরন সৃষ্টি হলে হেফাজতের নেতারা গণজাগরন মঞ্চের উদ্যোক্তাদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে পালটা আন্দোলন শুরু করে। মতিঝিলে এরা তান্ডব করেছে। কোরান পুড়িয়ে ছড়িয়েছে আড়াই হাজার লাশ গায়েবের গুজব। নারী নেতৃত্ব বিরোধী এর নেতা শফী হুজুরের মেয়েদের দেখলে তেঁতুলের মতো লালা ঝরে! এদেরকে এর আগে রেলওয়ের জমি দিয়ে বশ মানানো হয়েছে। আর তাদের কথায় যখন পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তন করা হয় তখন বিস্মিত-ক্ষুদ্ধ হন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন।

সুপ্রীমকোর্ট চত্বরে ন্যায় বিচারের প্রতীক গ্রীক দেবীর মূর্তি অপসারনের দাবিতে হেফাজত আন্দোলন শুরু করলে সরকারি লোকজন চুপ করে থাকায় আরেক বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। কোনটা মূর্তি কোনটা ভাস্কর্য তা নিয়ে হেফাজত নেতাদের জ্ঞানের বহর সীমিত থাকলেও আওয়ামী লীগের লোকজনও কেন নিশ্চুপ সে প্রমানও এখন সবার সামনে। প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে ফেরার পর হেফাজত নেতাদের সঙ্গে গণভবনে বৈঠকের আয়োজন চললেও তা গোপন রাখা হয়। ভারত সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন শেষে রাতেই যে গণভবনের দাওয়াতী হেফাজত নেতৃবৃন্দ তা ঘুনাক্ষরে কাউকে জানতে দেয়া হয়নি। সেই বৈঠকে নিজের থেকে শেখ হাসিনা যখন সুপ্রীমকোর্ট চত্বরের ভাস্কর্য অপসারনের দায়িত্ব নেন তখনো অনেকে মনে করেন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চাল বোঝা কঠিন।

কিন্তু এরপর আওয়ামী লীগ যখন জনভোগান্তির কথা বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা না করার ঘোষনা দেয় তখন স্পষ্ট হয় সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু হয়েছে ভিন্ন এক আওয়ামী লীগের! কারন এই আওয়ামী লীগ মঙ্গল শোভাযাত্রায় জনভোগান্তি দেখলেও এমন কোন ঘোষনা দেয়নি যে ভোগান্তি এড়াতে তারা আর কখনো ঢাকা শহরে রাস্তার স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে সভা মিছিল করবেনা বা প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের সময় রাস্তা বন্ধ করবেনা। ধর্ম নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী আওয়ামী লীগ এক সময় শায়খুল হাদিসের সঙ্গে ফতোয়া চুক্তি করে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পরে সেখান থেকে সরে এসেছিল। কট্টর মৌলবাদী, মেয়ে মানুষ দেখলে তেঁতুলের মতো লালা ঝরানো তেঁতুল হুজুর তথা শফী হুজুরের সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবি, তাদের রেলের জমি দেয়া, তাদের কথায় পাঠ্য পুস্তক বদলে ফেলা, তাদের খুশির জন্যে সুপ্রীমকোর্টের স্বাধীন সিদ্ধান্তে স্থাপিত গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য অপসারনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে কেউ আর কথিত ধর্ম নিরপেক্ষ আওয়ামী লীগকে মেলাতে পারেননা। দেশের বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব-ব্যক্তিত্বের সিংহভাগ আওয়ামী লীগ সমর্থক অথবা আওয়ামী লীগের প্রতি দূর্বল। এই মূহুর্তে তারাও অবাক চুপ! এসবে সায় থাকলে বলুন। সবাই আনন্দে নৃত্য করবে। বুদ্ধিজীবীরা জাতির বিবেক হয়ে থাকলে তারা চুপ করে থাকলে একটি দমবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়।

এখন চারদিকে প্রশ্ন কেন এসব হচ্ছে। এসব কী সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল? কৌশল যাদেরকে নিয়ে তারা কী কখনও আওয়ামী লীগকে বা নৌকায় ভোট দেয়? না দেবে? শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক এটি সবাই জানে। ধার্মিক তিনি আগেও ছিলেন, এখনও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগতো বরাবর দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ, বিজ্ঞান মনস্ক, আধুনিক চিন্তা চেতনার মানুষজনের ভোট পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর ডিজিটাল বাংলাদেশ শ্লোগানে উদ্ধুদ্ধ তরুন সমাজ তথা নতুন ভোটার। এদের মনের অবস্থার এখন কী খোঁজ রাখে আওয়ামী লীগ? বাংলাদেশের হিন্দু সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে আওয়ামী লীগের নিয়মিত-নির্ধারিত ভোটার মনে করা হয়। এদের কাছে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। অথবা আওয়ামী লীগ মনে করে এরা যাবে কোথায়? সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কী এখন আর আওয়ামী লীগকে চোখ বন্ধ করে ভোট দেয়? কুমিল্লায় কী দিয়েছে? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তরুনদের সিংহভাগ এখন আওয়ামী লীগকে নিয়ে কী কী কথা বলে, স্যোশাল মিডিয়ায় কি লিখে তা কী আওয়ামী লীগ নেতারা পড়েন? না এসব জানার-পড়ার প্রয়োজন মনে করেন? তা আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট ব্যাংকে ফাটল, হেফাজতীরা আওয়ামী লীগ থেকে রেলের জমি সহ নানাকিছু নেবে কিন্তু ভোট দেবেনা, তাহলে আওয়ামী লীগ কাদের নিয়ে ভোট খেলবে? নেতা-কর্মীদের? ক্ষমতার হালুয়ারুটি খেয়ে পরে এদের বেশিরভাগের এত চর্বি বেড়েছে যে আওয়ামী লীগের আগের ত্যাগী নেতা-কর্মী বাহিনীর
চরিত্রটি এদের আর নেই। নতুবা কি দেশে ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন হয়?

আবার সেই একটি ছবির গল্পের প্রসঙ্গে আসি। যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে একটা ছবি আওয়ামী লীগ হজম করতে পারেনি। কারন এটি আওয়ামী লীগ। এরসঙ্গে বাংলাদেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতি জড়িত। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের গৌরব জড়িত। তেঁতুল হুজুরের সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবিটি নিয়েও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কারন এই লোকটি এখন বাংলাদেশের প্রগতি বিরোধীদের নেতা। মেয়ে মানুষ দেখলে তার মুখে লালা ঝরে। আওয়ামী লীগ যে সবকিছু পারেনা তা ভুলে যান কী করে শেখ হাসিনা? আর স্বাতন্ত্র হারালে আওয়ামী লীগ জিতবে-টিকবে এটি তাকে কে বলেছে?

আওয়ামী মুসলিম লীগ টেকেনি। আওয়ামী লীগ এই ভূখন্ডের অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার গণমানুষের দল হয়ে ওঠায় পথ দেখিয়েছে বাংলাদেশকে। দেশকে স্বাধীন করেছে। আজ যে বাংলাদেশের এত অগ্রগতি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কারন মানুষের কাছে এটি বিএনপির মতো ঘুটা ঘুটা ওরস্যালাইনের দল নয়। আওয়ামী লীগ তার মৌলিকত্ব হারালে আমরা সবাই যে হেরে যাবো প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনার একদল স্তাবকের একটি কথা আমি সমর্থন করিনা। তাহলো, শেখ হাসিনা কখনো ভুল করতে পারেনা। এটি একটি ভুল এবং নিম্নমানের স্তাবকতা। কারন মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। ভুল করে ভুল জলে নামবেন না প্রিয় প্রধানমন্ত্রী।


Place your ads here!

Related Articles

Migration and Cultural Diversity

Diversity is often preached as quite a simple process which simply requires an immigrant coming from a foreign land with

বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি যথেষ্ট করতে পারছে ক্লাইমেটচেঞ্জ কে টেকেল করতে?

পরিবেশগত অবনত আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর মাঝে একটা। আমার মনে হয় এই সমস্যাটা ডমেস্টিক রাজনীতিই হোক আর বৈশ্বিক

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment