বৈশাখি মেলা – সিডনি অলিম্পিক ভিলেজ

দু’হাজার সালে সিডনি অলিম্পিক উপলক্ষে গড়া হয় আজকের সিডনি অলিম্পিক ভিলেজ। অনেকগুলো স্টেডিয়াম-ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়া হয় তখন এই অলিম্পিক ভিলেজে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় স্টেডিয়ামটি এএনজেড স্টেডিয়াম। সিডনি অলিম্পিকের উদ্বোধনী-সমাপনী অনুষ্ঠান এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। সেই এএনজেড স্টেডিয়ামে এখন মাঝে মাঝে কনসার্ট হয় বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী বা ব্যান্ডের দল সিডনি এলে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আর কোন ভাষাভাষী মানুষের নববর্ষ বা আর কোন কমিউনিটি প্রোগ্রাম এর আগে এখানে হয়নি। এই ভ্যানুটি এতো ব্যয়বহুল যে অন্য কেউ হয়তো এখানে তাদের কমিউনিটি প্রোগ্রাম করার কথা ভাবতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার বাঙালিরা এক্ষেত্রেও একটি রেকর্ডের শিলালিপি স্থাপন করে রেখে দিলো শনিবার, ১৬ এপ্রিল। এখানে হয়ে গেলো বাঙালির প্রাণের বর্ষবরন অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা। এএনজেড পার্কের স্টাফরা এর আগে হয়তো বাঙালিদের নিয়ে এতোটা জানতোনা। তাদের একজন সিনথিয়া শনিবার তাদের স্টেডিয়ামে প্রায় পঁচিশ হাজার বাঙালির সমাবেশ দেখে মুগ্ধতায় একটা শব্দই প্রথমে বললো, ‘এমাজিং’! এরপর বললো এতো কালারফুল একটা জাতি, তাদের উৎসব, মেয়েগুলো এতো সুন্দর করে সাজে, এমন আর আগে আমি কখনো দেখিনি!
এ মাঠে ৭৫ হাজার দর্শক জায়গা হয়। অত বাঙালি সারা অস্ট্রেলিয়ায় নেই। কিন্তু শনিবার বাংলা নববর্ষ বরন উপলক্ষে প্রায় পঁচিশ হাজার দর্শক এসেছিলেন এ মাঠে! উদ্যোক্তারা বলেছেন এটি তাদের এ যাবতকালের সবচেয়ে সফল মেলা। এই মেলা পাগল বাঙালিদের সবাই দশ ডলারের টিকেট কেটে মাঠে ঢোকেন। সারাদিনের জন্যে গাড়ি পার্কিং’এর জন্যে খরচ করেন পঁচিশ ডলার করে! বাংলা নববর্ষে বাংলাদেশে অথবা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যেমন বাহারি সাজের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরেন, এএনজেড স্টেডিয়ামের বর্ষবরন-বৈশাখী মেলাতেও তারা তেমন সেজেগুজে এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি মেলার আরেক বৈশিষ্ট এখানে সমবেতদের নব্বুই শতাংশ তরুন এবং নতুন দম্পতি। এরা পড়াশুনা উপলক্ষে এদেশে এসেছিলেন।পড়াশুনা শেষে মাইগ্রেশন হয়ে যাবার পর দেশে গিয়ে বিয়ে করে স্ত্রী বা স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসীদের বেশিরভাগের ব্যাকগ্রাউনড এমন। তাদের অনেকের সঙ্গে যে বাবা-মা তারা এদেশে এসেছেন নাতি-নাতনির জন্ম উপলক্ষে।
বৈশাখি মেলা উপলক্ষে যে শুভেন্যুর প্রকাশ করা হয়েছে তাতে অস্ট্রেলিয়ার বাঙালিদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বানী দিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল, বিরোধীদলের নেতা বিল শর্টন, নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রিমিয়ার মাইক বার্ড সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। অষ্ট্রেলিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা মঞ্চে উঠে তাদের দেশে বসবাসরত বাঙালিদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথমেই ইংরেজি উচ্চারনের বাংলায় বলার চেষ্টা করেছেন, ‘শুভো নববর্ষা’! সিডনির অলিম্পিক পার্কের এই বৈশাখী মেলা এরমাঝে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের বাইরের সবচেয়ে বড় বাঙালি সমাবেশের অভিধা পেয়ে গেছে! কারন বিদেশে মূলত সভা-সমাবেশ হয় মিলনায়তনের ভিতরে! এদেশে সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কোন সভায় পঞ্চাশ-একশজন লোক জোগাড় করা গেলে বলা হয়, ‘হাউ এ বিগ মিটিং ইট ইজ’! আর এখানে বাঙালির মিলন উৎসবটি হয় পৃথিবীর অন্যতম বড় একটি স্টেডিয়ামে! এই বৈশাখী মেলা উপলক্ষে বিশেষ শার্টল ট্রেন-বাসের ব্যবস্থা করে সিডনির পরিবহন অধিদপ্তর! এবারও করেছে! এর মিডিয়া পার্টনার হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় টিভি স্টেশন, চ্যানেল নাইন।
বাঙ্গালির মেলা মানে নাগরদোলা। অলিম্পিক পার্কের মেলা উপলক্ষেও নাগরদোলা সহ নানান রাইডের ব্যবস্থা করা হয়। এবার মেলায় স্টল ছিল একশর বেশি। গয়নাগাটি, শাড়ি-পাঞ্জাবি-থ্রি-পিস থেকে শুরু করে বই, খাবারের স্টল ছিল এএনজেড স্টেডিয়ামের সামনের বড় অংশ জুড়ে। বাংলা নববর্ষের মেলায় যা যা পাওয়া যায়, হাওয়াই মিঠাই থেকে শুরু করে পিঠা-পুলি, লুচি-লাবড়া, ঝালমুড়ি, ফুচকা থেকে শুরু করে পিয়াজো-সিঙ্গারা, কাবাব-নান, মোগলাই, জিলিপি-বিরিয়ানি থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল এ মেলায়। একেকটি খাবারের দোকানে কাজ করেছেন দশজনের বেশি ছেলেমেয়ে। ভিয়েতনামীদের একটি স্টলে লম্বা লাইন সামাল দিয়ে আখের রস বিক্রি করা হয়। এভাবে লোকজন এখানে খাবার নিয়েছেন লাইনে দাঁড়িয়ে। পরিচিতজনের সঙ্গে মেলায় দেখা-আড্ডার সঙ্গে হালের ক্রেজ সেলফি, কিছুই বাদ যায়নি। এখন সেলফি তুলেই সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে ছবি আপলোড করা যায়। এর কারনে বুঝি বাঙালির নববর্ষ এখন অনেক বেশি বর্ণিল-প্রান্তবন্ত। বড় ইভেন্ট উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার সব স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধার ব্যবস্থা করে। সে কারনে এএনজেড স্টেডিয়াম থেকে কারও সেলফি বা ছবি আপলোডে একদম সমস্যা হয়নি।
সিডনি অলিম্পিক পার্কের এ মেলার আয়োজক বঙ্গবন্ধু পরিষদ অস্ট্রেলিয়া। এই সংগঠনের কর্তা ব্যক্তিদের সবাই বাংলাদেশি-অস্ট্রেলিয়ান। এই মেলার প্রধান প্রাণপুরুষ শেখ শামীমুল হক বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যতম সদস্য। কিন্তু এ মেলাকে শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের মেলা বলা বা দাবি করার সুযোগ নেই। সিডনিবাসী পশ্চিমবঙ্গের বিস্তর সংখ্যক বাঙালি এবারও যোগ দিয়েছেন এ মেলায়। তাদের খাবারের দোকান-বইয়ের দোকানও মেলায় ছিল। এর কারনে এটি এখন নিখাদ বাঙালিদের মেলা। এবারের মেলার অতিথি শিল্পী ছিলেন নচিকেতা। স্বভাবসুলভ ভীষন জমিয়ে গেয়েছেন এই শিল্পী! তার ‘রাজশ্রী তোমার জন্যে মুদ্রাস্ফিতি অষ্ট্রেলিয়ায়’ সহ নানা গানের সঙ্গে গেয়েছেন সবাই। এবার মেলা কমিটির বোধোদয়ের কারনেও অনেক গান গাইতে পেরেছেন নচিকেতা। অন্যবার সিডনির শিল্পীদের শুরুতে এতো সময় দেয়া হয় যে শেষের দিকে বৃষ্টি এসে গেলে অতিথি শিল্পী আর সেভাবে গাইবার সুযোগ পান না। এবার তা হয়নি। শুরুটা সিডনির শিল্পীদের দিয়ে শুরু হলেও মাঝের পুরো সময়টা ছিল নচিকেতার। মাঝে একবার বেচারাকে চায়ের বিরতিও নিতে হয়েছে। নচিকেতার পর আবার মঞ্চে ফেরেন সিডনির শিল্পীরা। প্রশান্তপাড়ের দেশটায় যে কতো বাঙালি শিল্পী প্রতিভা আছেন, এ মেলায় যারা আসেন তা তারা দেখেন-জানেন। বাঙালির এতো স্মার্ট প্রজন্ম যে অস্ট্রেলিয়ায় তা এ মেলায় না এলে বোঝা কঠিন। বাঙালির এতো স্মার্ট ছেলেমেয়েরা এখন আছে অস্ট্রেলিয়ার নানাকিছুর মূলধারায়। মেলার সুযোগে তারাও আসেন। মন ভালো হয় তাদের দেখে। এদের দেখে মন বলে একদিন কোন এক বাঙালি ছেলেমেয়ে অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীও হবে। সিডনির নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের অপেরা হাউস পর্বটির আতশবাজি দুনিয়া বিখ্যাত। আর অলিম্পিক পার্কের বর্ষবরনও শেষ হয় বর্ণাঢ্য আতশবাজির মাধ্যমে। আবহাওয়া ভালো থাকায় এই শনিবারের আতশবাজি পর্বটাও বিশেষ জমেছিল। অলিম্পিক পার্কের চারপাশে দাঁড়িয়ে নানাদেশের পর্যটকরা দেখছিল বাঙালির বর্ষবরনের আনন্দ। মনটা তখন আরও বড়-প্রশস্থ হয় বহুগুন। ভিন্ন দেশের ভিন্ন প্রেক্ষাপটের হলেও মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ উক্তি! ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবোনা’।
ফজলুল বারী, সিডনি থেকে
Related Articles
National Election: Some interesting insights
Bangladesh stands at a crossroads and the path to a new invigorated Bangladesh depends how the new political forces emerge
নতুনত্ব
সকাল সকাল চায়ের তেষ্টা পাগল করে দেয়। বাসি মুখে চা চড়িয়ে মুখে ব্রাশ গুজি। দক্ষিণের জানলাটা প্রায়ই খুলে রাখে টিপু।
রিভিউ:- মিউজিক ভিডিও “স্বপ্ন মনে জাগে”
এক অসাধারণ সম্মোহনী কন্ঠ যার , যে কিনা কথা বলতে শুরু করলে তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারা যায় না