আমি সব পাব, সব খাব: কাব্যহিংসা যখন কবিহিংসা

আমি সব পাব, সব খাব: কাব্যহিংসা যখন কবিহিংসা

অজয় দাশগুপ্ত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন একটা বিষয় বেশ বাজার পেয়েছে দেখলাম। কবির লড়াই। সাধারণত এসব বিষয় খুব একটা গুরুত্ব পায় না। এখন দিনকাল পাল্টেছে। সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষত ফেসবুকে কবিরাও সরব, সচল। আমাদের দেশের জীবিত কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ ও হেলাল হাফিজ দুজনেই এ মাধ্যমে সক্রিয়। তাদের ফলোয়ার, ভক্ত, অনুরাগী এবং দুশমন কোনোটার কমতি নেই। তাদের লেখা, মন্তব্য, কবিতার ওপর আমাদের ঝোঁক থাকাটা স্বাভাবিক। বিশেষত তরুণ-তরুণীদের আছে গভীর মনযোগ। তারা প্রায়ই কবিতা দিয়ে আমাদের চমকে দেন। কখনো কখনো এমন সব বিষয়ে লিখেন বা ছোটখাটো মন্তব্য করেন, ক্রমেই যা বড় হয়ে দেশ ছাপিয়ে বিদেশের বাঙালির মনেও ছাপ ফেলে যায়। বলাবাহুল্য, হেলাল হাফিজ ও নির্মলেন্দু গুণ উভয়ের সঙ্গেই আমার ফেসবুক বন্ধুত্বের সুবাদে আমি তাদের দেখি ও দেখেছি। গুণদার একাধিক একাউন্টের কারণে তিনি আসলে আছেন কি নাই, ঠিক বুঝি না। তবে হেলাল হাফিজ আছেন এবং সম্ভবত তার একটাই একাউন্ট। তার কবিতা ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না। অন্যদিকে গুণদা সর্বগ্রাসী।

একদা আমাদের যৌবনে তার জায়গা ছিল আদর্শের শীর্ষে। তিনি প্রেমের কবিতার পাশাপাশি হুলিয়ার মতো কবিতা লিখে আমাদের ইতিহাসকে দিয়েছিলেন নতুন গতি। আমরা পেয়েছিলাম, তার আগে চাই সমাজতন্ত্রের মতো সাম্যবাদের কবিতা। নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আজ আমি কারও রক্ত চাইতে আসিনি শেখ মুজিবের কথা বলতে এসেছি বা স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো, লিখে রীতিমতো দেশ কাঁপিয়ে তোলা কবি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের শরীরের রক্ত ঠা-া হয়ে আসে। তার শিরদাঁড়ায়ও টান পড়ে বৈকি। একদা বোহেমিয়ান স্বভাবে বাউল এই কবি শেষ বয়সে এসে তার সেই দৃঢ়তা আর ধরে রাখতে পারছেন না। অনেক আগে থেকেই তার কবিতা ও লেখা দলবিশেষে এককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। যদিও তিনি তার দেশজ অর্জনের বড় পুরস্কারটি নিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার হাত থেকে। তখন কিন্তু তার আদর্শবোধে টান পড়েনি। টান পড়েনি এরশাদের সঙ্গে সখ্যতার সময়ও। আত্মজৈবনিক গদ্যে নিজেই লিখেছেন, সেনাকুঞ্জে এরশাদের আমন্ত্রণে যাবার কথা। সেখানে তার কন্যাকে এরশাদ যখন মাথায় হাত রেখে বলেছিল, তোমার বাবা এদেশের একজন বড় কবি। গুণদা বিগলিত হয়ে তা হজম করেছিলেন এবং মনে মনে যে খুশি হয়েছিলেন সেটাও লিখতে কসুর করেননি। আওয়ামী লীগের হয়ে একতরফা লড়াই তার অনেক কবিতাকে লিফলেট বা দলীয় ইশতেহার বানিয়ে ছাড়লেও তিনি থেমে যাননি। এই সেদিন আমরা দেখেছি তাকে কেন স্বাধীনতা পদক দেওয়া হবে না এ নিয়ে কি ছেলেমানুষী কান্ডই বাঁধিয়েছিলেন। কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একদা তার ক্লাসমেট ছিলেন সে দাবিতে পুরস্কার শেষতক নিয়ে ছাড়লেন তিনি। তবু আমরা কিছু বলিনি। কারণ তিনি আমাদের প্রেম ও দ্রোহের কবি।

এবার আবার তিনি একটি বাল্যসুলভ কান্ড ঘটিয়ে নিজেকে আবারও ছোট করলেন। কবি হেলাল হাফিজ চোখে ভালো দেখতে পান না। তার অন্ধ হবার যোগাড়। সে সময় কীভাবে যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেছে তার। বলাবাহুল্য, তিনিও তার ব্যাচমেট। দুজনে একসঙ্গে অনেক গল্প করেছেন। সময় পেয়েছেন শেখ হাসিনার। এই গল্প, এই ছবি বেচারার জন্য কাল হয়ে যাবে কে ভেবেছিল। তার সহপাঠী নেত্রকোনার আরেক কবি তাকে জিয়া বন্দনার দায়ে ফাঁসিয়ে দেবেন সেটা নিশ্চয়ই ভাবেননি তিনি। অপরাধ, হেলাল হাফিজ নাকি একটা গান লিখেছিলেন আর সে গান গেয়েছিলেন ফকির আলমগীর। এখন অবধি সেটা প্রমাণ করতে পারেনি কেউ। কিন্তু কথা হচ্ছে, যদি তা হেলাল হাফিজ লিখে থাকেনও এতদিন কেন তা বলা হয়নি? এখন যখন তিনি শেখ হাসিনার সময় পেলেন এবং আনুকূল্যে চিকিৎসা পাবেন এ ঘটনা সামনে আনার পেছনে তো ঈর্ষা বা হিংসা ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। আমি সব পাব, সব খাব, ইচ্ছেমতো তেল দেব আর নেব। কারও বেলায় সহ্য করব না, এই হলো কবির রীতি? এদের কাছ থেকে কি শিখবেন তরুণ-তরুণীরা? কিছুদিন আগে আমি কলকাতায় রোববারের এক সকালে কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ি গিয়েছিলাম। আহা কি সে সকাল। দলে দলে লোক আসছে তাদের হাতে উপহার। মিষ্টি সিঙ্গারা, চা আর জলখাবারে মুখরিত সকালের মধ্যমণি কবি মিতভাষী। বলছেন, সব উপদেশের মতো কথা। আমরা শুনছি। দরজা অবধি এসে বিদায় দিলেন আমাকে। বসালেন নিজের কাছের চেয়ারে। যেন কত আপন।

আপনারা কী করছেন? পারস্পরিক ঈর্ষা আর হিংসার প্রচার। একসময় নিজের বইয়ের উৎসর্গপত্রে গুণদা লিখেছিলেন, আমাদের কাব্যহিংসা অমর হোক। এখন দেখছি তা কবি হিংসায় পরিণত হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণের সম্পর্ক হেলাল হাফিজের চাইতে অনেক শক্তিশালী। তিনি আমার সিডনির বাড়িতেও অতিথি হয়েছিলেন। আর হেলাল হাফিজকে দেখি শেষ যেদিন তিনি যুগান্তর ছাড়বেন। যুগান্তর অফিসে। তবু সত্য আর সুন্দরের স্বার্থে বলি, কবিদের এমন মিথ্যাচার আর পারস্পরিক বিদ্বেষ মানায় না। গুণদা যে ভুল করলেন তার প্রায়শ্চিত্ত তিনিই ভালো জানেন। আপতত হেলাল হাফিজ তার উদারতায় এগিয়ে থাকলেন।

আমাদের দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, কবিতা ও কবিদের পচনটাই নতুনভাবে দেখিয়ে দিলেন প্রথিতযশা কবি নির্মলেন্দু গুণ। তবে কি অযাচিত, অভাবিত প্রাপ্তির এই শেষ পরিণাম?

প্রথম প্রকাশ: http://amaderorthoneeti.net/new/2016/11/17/42557/#.WCzx949EmUl

Ajoy Dasgupta

Ajoy Dasgupta

অজয় দাশগুপ্ত: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক


Place your ads here!

Related Articles

China eyes huge investment in Bangladesh

Many nations define themselves in terms of territory or people; China defines itself in terms of history. It looks to

Holidays in Bangladesh

16 June, that was the date that my father (Shahadat Manik) had announced that we were going to Bangladesh on

ডাক্তারদের মৌচাকে ঢিল শেখ হাসিনার

ফজলুল বারী: দেশের সড়কের মতো নৈরাজ্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতে। নৈরাজ্য কোথায় নেই। মানুষ জিম্মি। এবারে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার পর

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment