জীবন ভ্রমন

জীবন ভ্রমন

জীবন ভ্রমন ২৭ : কলেজ জীবনটা কখন শুরু হয় আর কখন শেষ হয় বুজাই যায় না । এই সময় নতুন বন্ধুত্ব খুব কম হয় । স্কুলের বন্ধুরাই এক সাথে থাকে । আমার বেলাতেও তাই ঘটেছে । ঊনআশি সালে এসএসসি রেসাল্ট হওয়ার পর প্রথম এপ্লিকেশন করি নটর ডেম কলেজে । এডমিশন টেস্ট এর পর ভয়ে ভয়ে রেসাল্ট দেখতে যাই ।

এখনো মনে আছে ২৬২ তম আমার সিরিয়াল । গ্রুপ ফোর এ ভর্তি হই । আমার ক্লাস রোল নম্বর ছিল 81475 । সবার জন্য সিট রিজার্ভ । যার যার সীটে বসতে হয় । আমার আসে পাশের সিটে ছিল স্কুল বন্ধু মনির , সাদী, ফিরোজ, মিতুল । মনির ও সাদী DU তে , ফিরোজ চিটাগং আর মিতুল সিলেট মেডিকেলে ভর্তি হয় ।

নটর ডেম কলেজে প্রত্যেক গ্রুপে একজন ক্লাস মনিটর থাকত । তার কাজ ছিল প্রতিদিন সকালে অফিস থেকে হাজিরা খাতা কালেকসন করা, প্রতেক ক্লাসের আগে উপস্থিতি মার্কিং করা , দিন শেষে অফিসে জমা দেওয়া । একটা উপস্থিতি সীটে ৭ দিন মার্ক করা যেত । প্রতি শনিবারে অফিস থেকে নতুন উপস্থিতি সীট লাগিয়ে দিত ।

উপস্থিতি নিয়ে কয়েক জনের সাথে মনিটরের খটমট লেগে যায় । ওই মনিটরের ভাব সাভ অনেকেই পছন্দ করত না । উপস্থিতি একটা বড় ব্যাপার ছিল পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে । কোনো এক সপ্তাহে উপস্থিতি নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হয় । ঐ সপ্তাহের শেষ দিনে কয়েক জন মিলে সকালে এসে অফিস থেকে হাজিরা খাতা নিয়ে ছিড়ে কলেজের বাহিরে ড্রেনে ফেলে দেয় ।

ওই দিন মনিটরশীপ নিয়ে খটমট লাগে । এই সুযোগে কয়েক জন বলল মনিটর চেঞ্জ করতে হবে । তারপর আমাকে দাযিত্ব দিল । আমি বেশ কয়েক মাস মনিটরর্গিরি করার পর সম্ভবত সাদির কাছে হস্তান্তর করি । আমি যেহেতু কলেজের ওয়ার্ক প্রোগ্রামে কাজ করতাম তাই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট ছিল মনিটরশীপ এর সাথে ।

এই সময় অনেকে বলত ” দোস্ত কাল আসতে দেরী হবে , ওই ক্লাসে একটু বাং মারব , খেয়াল রাখিস “। নিয়ম ছিল ক্লাসের শুরুতে এবসেন্ট মার্কিং করা । বলতাম ” ক্লাস শেষ হওয়ার আগে ডূকলেই ওকে, আমি শেষ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম যারা বলে যেতো “। কৃতগ্গতা স্বরূপ মাঝে মাঝে সিগারেট পাওয়া যেত ।

উপস্থিতি নিয়ে মুরগি লিয়াকতের সাথে একবার রাগারাগি হয় । সাত আট জন আমার পক্ষ নিল । একজন বলল ” দোস্ত রংবাজি করে লাভ নাই, আমরা কিন্তু এই এলাকার ছাত্র, দেরী হলে মুকুলকে আগে বলবা “। এরপর থেকে লিয়াকত প্রায় কানে কানে কিছু বলে যেতো । বুঝলাম লিযাকতের অন্য বেবসা আছে ।

একদিন বাংলা ক্লাসে রক্তাক্ত প্রান্তর পড়াচ্ছে । কম বয়সী স্যার, নামটা মনে করতে পারছি না । একটু রস কষ দিযে কথা বলছে । হঠাৎ লিযাকতের প্রশ্ন ” স্যার , হিরণ বালারে যখন ‘ও’ করতে চাইছিল তখন……” । সাথে সাথে প্রচন্ড হাসাহাসি , ওই দিন স্যার আর টেক্সটে যেতে পারেনি । এই আলাপ , সেই আলাপ , হ য ব র ল ।
জীবন ভ্রমন ২৮ : Father DOG . ১৯৭৯ সালে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় অফিস থেকে কি কারণে যেন বলেছে দোতলায় ফাদার ডগের কাছে যাও । মনে মনে বললাম ‘ফাদার ডগ’- এইটা আবার কেমন নাম । আমার মনে হযেছে হয়ত কুকুরকে ভালবাসে এমন কোনো বিদেশী ।

দোতালায় উঠে বোকার মত এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছি কুকুর ওয়ালা কোনো রুম পাই কিনা । একজনকে জিগ্গেস করলাম ” ভাই , এখানে ‘ডগ ফাদার’ কে ? ” । উনি বললেন ওই রুম । গিয়ে দেখলাম দরজায় লেখা আছে ” Director Of Guidance অর্থাৎ DOG ” । মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম “শালার এব্রিবিয়েসন , কারো গালি আর কারো বুলি ” । দরজা নক করার পর দেখি বেশ ভদ্র ,বয়স্ক এক বিদেশী । ভিতরে নিয়ে কিছু একটা সাইন করে দিলেন ।

আমাদের সময় প্রিন্সিপল ছিলেন ফাদার ফিসাতু । সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনেছি ওই সময় কেন যেন গ্রুপ ফোরের একটা মিশ্রিত সুনাম ছিল । একবার ফাদার ফিসাতু ফিজিক্স ( ফোর্স ) এর উপর কয়েকটা ক্লাস নেন । তখন বোর্ডে graph একে স্পিড, ভেলোসিটি, এক্সিলারেশন ইত্যাদির সাথে টাইম এর রিলেসন্শিপ বূজানোর চেষ্টা করেছেন । লোকাল বইতে এর লেশ মাত্র ছিল না ।

তিনি ক্লাসে লেকচারের সময় বিশাল আকৃতির দুইটা বই হার্ড বোর্ডের উপর রেখে বিশেষ টেকনিকে কোমরের সাথে হেলান দিয়ে নিয়ে আসত । দেখতে খুব ভালো লাগত । ওই পিরীয়ডিক্যাল পরীক্ষা আমাদের জন্য বেশ টেনসনের বিষয় ছিল । যতদূর মনে পরে খুব ভালো মার্ক পাই নাই । কারন প্রশ্ন খুব প্রেকটিক্যাল টাইপের ছিল ।

দীর্গ ৩৪ বছর পর গত মাসে ক্যানবেরাতে আমার ক্লাস নাইন এর ছেলেকে displacement -time graph এবং velocity – time graph পড়াতে গিয়ে বুজতে পেরেছি ওই দিন ফাদার ফিসাতূ কি বলেছেন । আসলে এরা থিওরির প্রাকটিক্যাল এপ্প্লিকেসন বুঝার উপর জোর দেয় । আর আমরা থেওরির উপর ভিত্তি করে তৈরী ফর্মুলার উপর নির্ভর শীল । A big difference .

এগ্রিকালচার সাইন্স এ আমরা ম্যাথ ,স্ট্যাটিসটিক্স, অর্গানিক, ফিজিক্যাল এন্ড এনালাইটিকেল কেমিস্ট্রি , মেকানিক্স ( ইন্জিন টেকনোলজি , হাইদ্রলিচ্স , বিল্ডিং কনসট্রাকসন ), ইকোনমিক্স , সোসিওলজি, কমুনিকেসন টেকনিকস ও এপ্লায়িড বায়োলোজি ইত্যাদি পড়ার কারনে যে বহুমুখী নলেজ অর্জিত হয়েছে তার কিছুটা এখন ব্যবহার করছি ছেলেকে পড়াতে গিয়ে । তাছাড়া এই নলেজের উপর ভিত্তি করে কম্পুটার সাইন্স ও বিজনেস ইনফরমেটিক্স উপর করেছি আরো দুইটি পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স ।

১৯৮১ সালে পরীক্ষার আগে আরেকবার যেতে হয়েছিল ফাদার ডগের কাছে । আমাদের মাথায় আসলো রেগ-ডে করতে হবে । কিন্তু কারো মাথায় এর ক্ষতিকর দিকটা আসে নাই । প্ল্যান মত সবাই রং পানি বোতলে নিয়ে এলো । ওই দিন ক্লাস শেষে শুরু হলো রং খেলা । গ্রুপ ফোর রুমের সামনে দিয়ে যারাই গেছে মোটামুটি রঞ্জিত হয়েছে ।

এই রং খেলার সময় অনেক রং করিডোর এর দেওয়ালে পড়ে । পরের দিন অন্য গ্রুপের দুই একজন ছাত্র অফিসে কমপ্লেন করে । তাতেই কাজ সারা । আর যাই কই । এক্স মনিটর হিসাবে ডাক পড়ল । সময়মত ফাদার ডগের দরবারে হাজির । অনেক জেরার পর ফাদার ডগ ” fun is OK but it is not fair to spoil college property ” এই রকম কিছু একটা বলে ৫০ টাকার একটা পেনাল্টি শ্লিপ ধরিয়ে দিলেন । আমাদের অনেককে এই পেনাল্টি দিতে হয়েছে।

আমার জন্য ব্যাপারটা একটু বিব্রতকর ছিল । কারন কলেজের ওয়ার্ক প্রোগ্রামে কাজ করতাম বিধায় ফাদার ডগ , অতুল দা , সুসিল দা, ফাদার বেনজামিন , প্রিন্সিপল পিসাতু এর সাথে প্রায়ই শূক্র শনিবারে দেখা হতো । কপাল ভাল ছিল ক্লাস শেষ হওয়ার কারণে আর অফিসে তেমন যাওয়া হয়নি । হাসতে একদিন সুসিল দা বলল তোমার তো ১০ ঘন্টার কাজ গেল ।

জীবন ভ্রমন ২৯ : প্রথম ইনকাম ৬০ টাকা । ১৯৭৯ সালে ssc পরীক্ষা দেওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাই । তখনও পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় নাই । আমার এক কাজিন এলাকার বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে জড়িত । উনি বলল “শুনেছি তুই অংকে ভালো” । স্কুলে পড়াতে পারবি ? আমি বললাম এখনো অনেক অংকের উত্তর সহ মনে আছে । চেস্টা করে দেখতে পারি ।

আমারদের বাড়ি থেকে এক দেড় মাইল দুরে ” রুবির হাট বঙ্গ বন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় ” । পরের দিন উনি অফিসে যাওয়ার পথে আমাকে স্কুলে নিয়ে গেলেন । হেড স্যারের সাথে পরিচয় করে দিলেন । হেড স্যার খুশি হয়ে বললেন ” ঠিক আছে , আজ ক্লাস eight এর অংক ক্লাসের শিক্ষক নেই , তুমি রাজি থাকলে আজ একটা ক্লাস নিতে পারো” । আমার কাজিন সাহস দিয়ে বলল ” কি পারবি না ” । আমি মাথা নাড়লাম কিন্তু ভিতরে ভয় ভয় কাজ করছে ।

আমাকে সাহস দিয়ে উনি বাস ধরে অফিসে চলে গেলেন । আমি টিচার্স রুমে বসে ক্লাস eight এর অংক বই এর একটা চ্যাপ্টার দেখে নিলাম । হেড স্যার আমাকে কোন চ্যাপ্টার উপর ক্লাস নিতে হবে আগেই বলে দিলেন । থার্ড পিরিয়ডে আমাকে পরিচয় করে হেড স্যার বের হয়ে গেলেন।

গ্রামের স্কুল । মাটির ফ্লোর । বাঁশের বেড়া । কাঠের ব্লাক বোর্ড । বিশ পচিশ জন ছাত্র ছাত্রী । ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় ছাত্রী রা আমার পিছনে পিছনে বের হয়ে আসলো । জিগ্গেস করলাম তোমরা কোথায় যাচ্ছ ? বুজতে পারলাম দুই ক্লাসের মাঝখানে ছাত্রীরা কমন রুমে চলে যায় । আবার টিচারের সাথে ফেরত আসে । বুজলাম এক ধরেনের নিরাপত্তা ।

প্রথম দিনে একটা ক্লাস নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলাম । সন্ধায় কাজিন এসে জানালো রিপোর্ট ইজ গুড । ছাত্ররা ভালো রিপোর্ট দিয়েছে । এরপর আমি প্রায় দুই মাসের মত ওই স্কুলে আসা যাওয়া করি । একদিন ক্লাস সেভেন এর ক্লাস টিচার ছিল না । আমি প্রথম ক্লাসে যাই । কয়েক জন তাদের মাসিক বেতন আমার কাছে দিল । আমি ৬০ টাকা অফিসে জমা ফিয়ে ছাত্রদের রিসিপ্ট এর ব্যবস্থা করে দেই ।

একদিন ক্লাস ten এর বীজ গণিত ক্লাস । সহকারী প্রধান শিক্ষক আমাকে আগেই সতর্ক বললেন “শয়তান পোলাপান আছে ” । ছাত্ররা বয়সে আমার সমান । বীজ গণিত আমার ফেবারিট সাবজেক্ট । আমি ব্ল্যাক বোর্ডে লিখছি । হঠাথ পিঠে কি যেন আঘাত করেছে । খুব ব্যথা পেয়েছি । উহ! শব্দ করে, কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকি । চোখে পানি আসার আগেই বের হয়ে আসি ।

টিচার্স রুমে না গিয়ে সরাসরি বাজারে পরিচিত চায়ের দোকানে । কয়েক জন ছাত্র কিছুক্ষণ পর চায়ের দোকানে এসে হাজির । একজন বললেন স্যার আমি অমুক চেয়ারম্যানের বাতিজা । আমাদের মাপ করবেন । আপনার গায়ে লাগবে বুজতে পারে নাই । আর এই রকম হবে না । অমুক স্যার শুনলে TC দিয়ে দিবে । আমি বললাম ঠিক আছে । আমি কাউকে বলব না । এর পর তারা তাদের কথা রেখেছে ।

একদিন হেড স্যার আমাকে ডেকে ৬০ টাকা দিয়ে বললেন তুমি এইটা দিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিও । আমি লজ্জায় নিলাম না । ওই সন্ধায় আমার কাজিন বলল টাকা নিস নাই কেন ? এই নে তোর সম্মানী । এই ৬০ টাকা তুই ক্লাস থেকে কালেকসন করেছিস । এইটা তোর । বুজলাম কোনো টিচার কালেকসন করলে সেই টাকা জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয় । পরে এডজাস্ট করে নেয় ।


Place your ads here!

Related Articles

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে ড. আবেদ চৌধুরী’র আবিষ্কার

ড. আবেদ চৌধুরী। বর্তমান সময়ে তার যুগান্তকারী একটি উদ্ভাবন হলো সোনালী মিনিকেট চাল। যে চাল খেলে রক্তে শর্করা এবং সুগার

Canberra te Bangladeshider Jonne Dorkar Shadhinotar Gaan

ক্যানবেরাতে বাংলাদেশীদের জন্যে দরকার স্বাধীনতার গান – অজয় কর ক্যানবেরাতে আজ সন্ধ্যায় মোহনা কে সাথে নিয়ে ধ্রুপদ গান গাইছে- ১৫০

কথক, মেলবোর্ন এর আয়োজন এমন দিনে তারে বলা যায়

বাংলা সাহিত্যে বর্ষা-বন্দনায় রবীন্দ্রনাথের জুড়ি মেলা ভার। তার কবিতায়, গানে ও গদ্যসম্ভারে বর্ষাদিনের ছড়াছড়ি, সেখানে টলটল করছে বর্ষার প্রাচুর্য ।

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment