জীবন ভ্রমন

by Anamul Bhuiyan Mukul | February 12, 2016 4:14 am

জীবন ভ্রমন ২৭ : কলেজ জীবনটা কখন শুরু হয় আর কখন শেষ হয় বুজাই যায় না । এই সময় নতুন বন্ধুত্ব খুব কম হয় । স্কুলের বন্ধুরাই এক সাথে থাকে । আমার বেলাতেও তাই ঘটেছে । ঊনআশি সালে এসএসসি রেসাল্ট হওয়ার পর প্রথম এপ্লিকেশন করি নটর ডেম কলেজে । এডমিশন টেস্ট এর পর ভয়ে ভয়ে রেসাল্ট দেখতে যাই ।

এখনো মনে আছে ২৬২ তম আমার সিরিয়াল । গ্রুপ ফোর এ ভর্তি হই । আমার ক্লাস রোল নম্বর ছিল 81475 । সবার জন্য সিট রিজার্ভ । যার যার সীটে বসতে হয় । আমার আসে পাশের সিটে ছিল স্কুল বন্ধু মনির , সাদী, ফিরোজ, মিতুল । মনির ও সাদী DU তে , ফিরোজ চিটাগং আর মিতুল সিলেট মেডিকেলে ভর্তি হয় ।

নটর ডেম কলেজে প্রত্যেক গ্রুপে একজন ক্লাস মনিটর থাকত । তার কাজ ছিল প্রতিদিন সকালে অফিস থেকে হাজিরা খাতা কালেকসন করা, প্রতেক ক্লাসের আগে উপস্থিতি মার্কিং করা , দিন শেষে অফিসে জমা দেওয়া । একটা উপস্থিতি সীটে ৭ দিন মার্ক করা যেত । প্রতি শনিবারে অফিস থেকে নতুন উপস্থিতি সীট লাগিয়ে দিত ।

উপস্থিতি নিয়ে কয়েক জনের সাথে মনিটরের খটমট লেগে যায় । ওই মনিটরের ভাব সাভ অনেকেই পছন্দ করত না । উপস্থিতি একটা বড় ব্যাপার ছিল পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে । কোনো এক সপ্তাহে উপস্থিতি নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হয় । ঐ সপ্তাহের শেষ দিনে কয়েক জন মিলে সকালে এসে অফিস থেকে হাজিরা খাতা নিয়ে ছিড়ে কলেজের বাহিরে ড্রেনে ফেলে দেয় ।

ওই দিন মনিটরশীপ নিয়ে খটমট লাগে । এই সুযোগে কয়েক জন বলল মনিটর চেঞ্জ করতে হবে । তারপর আমাকে দাযিত্ব দিল । আমি বেশ কয়েক মাস মনিটরর্গিরি করার পর সম্ভবত সাদির কাছে হস্তান্তর করি । আমি যেহেতু কলেজের ওয়ার্ক প্রোগ্রামে কাজ করতাম তাই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট ছিল মনিটরশীপ এর সাথে ।

এই সময় অনেকে বলত ” দোস্ত কাল আসতে দেরী হবে , ওই ক্লাসে একটু বাং মারব , খেয়াল রাখিস “। নিয়ম ছিল ক্লাসের শুরুতে এবসেন্ট মার্কিং করা । বলতাম ” ক্লাস শেষ হওয়ার আগে ডূকলেই ওকে, আমি শেষ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম যারা বলে যেতো “। কৃতগ্গতা স্বরূপ মাঝে মাঝে সিগারেট পাওয়া যেত ।

উপস্থিতি নিয়ে মুরগি লিয়াকতের সাথে একবার রাগারাগি হয় । সাত আট জন আমার পক্ষ নিল । একজন বলল ” দোস্ত রংবাজি করে লাভ নাই, আমরা কিন্তু এই এলাকার ছাত্র, দেরী হলে মুকুলকে আগে বলবা “। এরপর থেকে লিয়াকত প্রায় কানে কানে কিছু বলে যেতো । বুঝলাম লিযাকতের অন্য বেবসা আছে ।

একদিন বাংলা ক্লাসে রক্তাক্ত প্রান্তর পড়াচ্ছে । কম বয়সী স্যার, নামটা মনে করতে পারছি না । একটু রস কষ দিযে কথা বলছে । হঠাৎ লিযাকতের প্রশ্ন ” স্যার , হিরণ বালারে যখন ‘ও’ করতে চাইছিল তখন……” । সাথে সাথে প্রচন্ড হাসাহাসি , ওই দিন স্যার আর টেক্সটে যেতে পারেনি । এই আলাপ , সেই আলাপ , হ য ব র ল ।
জীবন ভ্রমন ২৮ : Father DOG . ১৯৭৯ সালে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় অফিস থেকে কি কারণে যেন বলেছে দোতলায় ফাদার ডগের কাছে যাও । মনে মনে বললাম ‘ফাদার ডগ’- এইটা আবার কেমন নাম । আমার মনে হযেছে হয়ত কুকুরকে ভালবাসে এমন কোনো বিদেশী ।

দোতালায় উঠে বোকার মত এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছি কুকুর ওয়ালা কোনো রুম পাই কিনা । একজনকে জিগ্গেস করলাম ” ভাই , এখানে ‘ডগ ফাদার’ কে ? ” । উনি বললেন ওই রুম । গিয়ে দেখলাম দরজায় লেখা আছে ” Director Of Guidance অর্থাৎ DOG ” । মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম “শালার এব্রিবিয়েসন , কারো গালি আর কারো বুলি ” । দরজা নক করার পর দেখি বেশ ভদ্র ,বয়স্ক এক বিদেশী । ভিতরে নিয়ে কিছু একটা সাইন করে দিলেন ।

আমাদের সময় প্রিন্সিপল ছিলেন ফাদার ফিসাতু । সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনেছি ওই সময় কেন যেন গ্রুপ ফোরের একটা মিশ্রিত সুনাম ছিল । একবার ফাদার ফিসাতু ফিজিক্স ( ফোর্স ) এর উপর কয়েকটা ক্লাস নেন । তখন বোর্ডে graph একে স্পিড, ভেলোসিটি, এক্সিলারেশন ইত্যাদির সাথে টাইম এর রিলেসন্শিপ বূজানোর চেষ্টা করেছেন । লোকাল বইতে এর লেশ মাত্র ছিল না ।

তিনি ক্লাসে লেকচারের সময় বিশাল আকৃতির দুইটা বই হার্ড বোর্ডের উপর রেখে বিশেষ টেকনিকে কোমরের সাথে হেলান দিয়ে নিয়ে আসত । দেখতে খুব ভালো লাগত । ওই পিরীয়ডিক্যাল পরীক্ষা আমাদের জন্য বেশ টেনসনের বিষয় ছিল । যতদূর মনে পরে খুব ভালো মার্ক পাই নাই । কারন প্রশ্ন খুব প্রেকটিক্যাল টাইপের ছিল ।

দীর্গ ৩৪ বছর পর গত মাসে ক্যানবেরাতে আমার ক্লাস নাইন এর ছেলেকে displacement -time graph এবং velocity – time graph পড়াতে গিয়ে বুজতে পেরেছি ওই দিন ফাদার ফিসাতূ কি বলেছেন । আসলে এরা থিওরির প্রাকটিক্যাল এপ্প্লিকেসন বুঝার উপর জোর দেয় । আর আমরা থেওরির উপর ভিত্তি করে তৈরী ফর্মুলার উপর নির্ভর শীল । A big difference .

এগ্রিকালচার সাইন্স এ আমরা ম্যাথ ,স্ট্যাটিসটিক্স, অর্গানিক, ফিজিক্যাল এন্ড এনালাইটিকেল কেমিস্ট্রি , মেকানিক্স ( ইন্জিন টেকনোলজি , হাইদ্রলিচ্স , বিল্ডিং কনসট্রাকসন ), ইকোনমিক্স , সোসিওলজি, কমুনিকেসন টেকনিকস ও এপ্লায়িড বায়োলোজি ইত্যাদি পড়ার কারনে যে বহুমুখী নলেজ অর্জিত হয়েছে তার কিছুটা এখন ব্যবহার করছি ছেলেকে পড়াতে গিয়ে । তাছাড়া এই নলেজের উপর ভিত্তি করে কম্পুটার সাইন্স ও বিজনেস ইনফরমেটিক্স উপর করেছি আরো দুইটি পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স ।

১৯৮১ সালে পরীক্ষার আগে আরেকবার যেতে হয়েছিল ফাদার ডগের কাছে । আমাদের মাথায় আসলো রেগ-ডে করতে হবে । কিন্তু কারো মাথায় এর ক্ষতিকর দিকটা আসে নাই । প্ল্যান মত সবাই রং পানি বোতলে নিয়ে এলো । ওই দিন ক্লাস শেষে শুরু হলো রং খেলা । গ্রুপ ফোর রুমের সামনে দিয়ে যারাই গেছে মোটামুটি রঞ্জিত হয়েছে ।

এই রং খেলার সময় অনেক রং করিডোর এর দেওয়ালে পড়ে । পরের দিন অন্য গ্রুপের দুই একজন ছাত্র অফিসে কমপ্লেন করে । তাতেই কাজ সারা । আর যাই কই । এক্স মনিটর হিসাবে ডাক পড়ল । সময়মত ফাদার ডগের দরবারে হাজির । অনেক জেরার পর ফাদার ডগ ” fun is OK but it is not fair to spoil college property ” এই রকম কিছু একটা বলে ৫০ টাকার একটা পেনাল্টি শ্লিপ ধরিয়ে দিলেন । আমাদের অনেককে এই পেনাল্টি দিতে হয়েছে।

আমার জন্য ব্যাপারটা একটু বিব্রতকর ছিল । কারন কলেজের ওয়ার্ক প্রোগ্রামে কাজ করতাম বিধায় ফাদার ডগ , অতুল দা , সুসিল দা, ফাদার বেনজামিন , প্রিন্সিপল পিসাতু এর সাথে প্রায়ই শূক্র শনিবারে দেখা হতো । কপাল ভাল ছিল ক্লাস শেষ হওয়ার কারণে আর অফিসে তেমন যাওয়া হয়নি । হাসতে একদিন সুসিল দা বলল তোমার তো ১০ ঘন্টার কাজ গেল ।

জীবন ভ্রমন ২৯ : প্রথম ইনকাম ৬০ টাকা । ১৯৭৯ সালে ssc পরীক্ষা দেওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাই । তখনও পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় নাই । আমার এক কাজিন এলাকার বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে জড়িত । উনি বলল “শুনেছি তুই অংকে ভালো” । স্কুলে পড়াতে পারবি ? আমি বললাম এখনো অনেক অংকের উত্তর সহ মনে আছে । চেস্টা করে দেখতে পারি ।

আমারদের বাড়ি থেকে এক দেড় মাইল দুরে ” রুবির হাট বঙ্গ বন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় ” । পরের দিন উনি অফিসে যাওয়ার পথে আমাকে স্কুলে নিয়ে গেলেন । হেড স্যারের সাথে পরিচয় করে দিলেন । হেড স্যার খুশি হয়ে বললেন ” ঠিক আছে , আজ ক্লাস eight এর অংক ক্লাসের শিক্ষক নেই , তুমি রাজি থাকলে আজ একটা ক্লাস নিতে পারো” । আমার কাজিন সাহস দিয়ে বলল ” কি পারবি না ” । আমি মাথা নাড়লাম কিন্তু ভিতরে ভয় ভয় কাজ করছে ।

আমাকে সাহস দিয়ে উনি বাস ধরে অফিসে চলে গেলেন । আমি টিচার্স রুমে বসে ক্লাস eight এর অংক বই এর একটা চ্যাপ্টার দেখে নিলাম । হেড স্যার আমাকে কোন চ্যাপ্টার উপর ক্লাস নিতে হবে আগেই বলে দিলেন । থার্ড পিরিয়ডে আমাকে পরিচয় করে হেড স্যার বের হয়ে গেলেন।

গ্রামের স্কুল । মাটির ফ্লোর । বাঁশের বেড়া । কাঠের ব্লাক বোর্ড । বিশ পচিশ জন ছাত্র ছাত্রী । ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় ছাত্রী রা আমার পিছনে পিছনে বের হয়ে আসলো । জিগ্গেস করলাম তোমরা কোথায় যাচ্ছ ? বুজতে পারলাম দুই ক্লাসের মাঝখানে ছাত্রীরা কমন রুমে চলে যায় । আবার টিচারের সাথে ফেরত আসে । বুজলাম এক ধরেনের নিরাপত্তা ।

প্রথম দিনে একটা ক্লাস নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলাম । সন্ধায় কাজিন এসে জানালো রিপোর্ট ইজ গুড । ছাত্ররা ভালো রিপোর্ট দিয়েছে । এরপর আমি প্রায় দুই মাসের মত ওই স্কুলে আসা যাওয়া করি । একদিন ক্লাস সেভেন এর ক্লাস টিচার ছিল না । আমি প্রথম ক্লাসে যাই । কয়েক জন তাদের মাসিক বেতন আমার কাছে দিল । আমি ৬০ টাকা অফিসে জমা ফিয়ে ছাত্রদের রিসিপ্ট এর ব্যবস্থা করে দেই ।

একদিন ক্লাস ten এর বীজ গণিত ক্লাস । সহকারী প্রধান শিক্ষক আমাকে আগেই সতর্ক বললেন “শয়তান পোলাপান আছে ” । ছাত্ররা বয়সে আমার সমান । বীজ গণিত আমার ফেবারিট সাবজেক্ট । আমি ব্ল্যাক বোর্ডে লিখছি । হঠাথ পিঠে কি যেন আঘাত করেছে । খুব ব্যথা পেয়েছি । উহ! শব্দ করে, কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকি । চোখে পানি আসার আগেই বের হয়ে আসি ।

টিচার্স রুমে না গিয়ে সরাসরি বাজারে পরিচিত চায়ের দোকানে । কয়েক জন ছাত্র কিছুক্ষণ পর চায়ের দোকানে এসে হাজির । একজন বললেন স্যার আমি অমুক চেয়ারম্যানের বাতিজা । আমাদের মাপ করবেন । আপনার গায়ে লাগবে বুজতে পারে নাই । আর এই রকম হবে না । অমুক স্যার শুনলে TC দিয়ে দিবে । আমি বললাম ঠিক আছে । আমি কাউকে বলব না । এর পর তারা তাদের কথা রেখেছে ।

একদিন হেড স্যার আমাকে ডেকে ৬০ টাকা দিয়ে বললেন তুমি এইটা দিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিও । আমি লজ্জায় নিলাম না । ওই সন্ধায় আমার কাজিন বলল টাকা নিস নাই কেন ? এই নে তোর সম্মানী । এই ৬০ টাকা তুই ক্লাস থেকে কালেকসন করেছিস । এইটা তোর । বুজলাম কোনো টিচার কালেকসন করলে সেই টাকা জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয় । পরে এডজাস্ট করে নেয় ।

Source URL: https://priyoaustralia.com.au/articles/2016/%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8-%e0%a6%ad%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ae%e0%a6%a8-2/