শুভমিতার অপার্থিব কণ্ঠে আমার সুরের মূর্ছনা
(প্রায় মাস ছয়েক আগে লিখা এই নিবন্ধটি শেষ পর্যন্ত পোস্ট করা হল। এর কিছু কিছু অংশ ইতিপূর্বে প্রকাশিত আমার একটি সাক্ষাতকারে প্রশ্নের উত্তর হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।)
‘যেদিন যায়, সেদিন ভাল।’ বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য। হাজার হাজার বছরের তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের মন ও মস্তিষ্কে ক্রমান্বয়ে একটা নেতিবাচক বিশ্বাস স্থায়ীভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে। আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই প্রবচনটির মাধ্যমে। প্রবাদ বাক্যটির জনপ্রিয়তার যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণ অবশ্য রয়েছে। কেননা, জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই ঐ প্রবাদ বাক্যের সত্যতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন, আজ চালের দর প্রতি কেজি একশ’ টাকা হলে পরদিন তা হয়ে যায় প্রতি কেজি দেড়শ’ টাকা। আগামীকাল ঝড় হলে পরশু ভূমিকম্প হয়ে বসে। বিংশ শতাব্দীতে যে মাটিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিয়েছি, আজ সেই একই মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই একই মাত্রার বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করতে পারছি না।
অনেকেই বলে থাকেন যে, আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনের জন্যও ঐ প্রবচনটি প্রযোজ্য। তাঁদের যুক্তিঃ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্র বিদায় নেবার পর তাঁদের বিকল্প হিসেবে ঠিক ঐভাবে আর কেউ এলেন না। উপমহাদেশের সংগীত-ভুবনে এক সময় যে রমরমা অবস্থা ছিল, তাও কোথায় যেন হারিয়ে গেল! হেমন্ত, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ, মানবেন্দ্র, সন্ধ্যা, লতা, আশা, রফি, মুকেশ, মেহেদী হাসান, আহমেদ রুশদী, বশীর আহমেদ, মাহামুদুন্নবী আর ফিরোজা বেগমের মতো সর্বোৎকৃষ্ট মানের সব কালজয়ী কন্ঠশিল্পীরা কিভাবে যে একই সময়ে আবির্ভুত হয়েছিলেন এবং তাঁদের তিরোধান বা অবসরগ্রহণের পর সেই শূন্যস্থানগুলো কেন যে সেভাবে পূরণ হয়ে সংগীত জগত আবার আগের মতো হয়ে উঠল না, সে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া একটু কঠিনই বটে।
তাঁদের সঙ্গে একমত পোষণ করার পরও ব্যাপারগুলি একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে খতিয়ে দেখা যাক। আসলে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ভারতবর্ষের দিকে দিকে যখন বিজয়ডঙ্কা আর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিদায়ঘণ্টা একই সাথে বাজতে শুরু করে, সেই নতুন উদ্দীপনাময় পরিবেশ ঐ অঞ্চলের জাতিসত্তাগুলির মাঝে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্মেষ ঘটায়। সেই সঙ্গে শিল্পবিপ্লব আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শান্তিবাদ ও মানবতাবাদের আন্তর্জাতিক হাওয়া এসে সেই সৃজনশীল পরিবেশকে আরও অনুকূল করে তোলে। তারই ফলশ্রুতিতে সেই সময় আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ভুবন ও-রকম জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু তাই বলে কি পরবর্তীকালে আমরা আবার পেছনে চলতে আরম্ভ করেছি? অনেক ঊর্ধ্বে উঠে, খুব নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করার পর এই প্রশ্নের উত্তরে কিন্তু ‘না’-ই বলতে হয়। বরং বলা যায় যে, বিশ্ব জুড়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্প-সাহিত্য নতুনদিকে মোড় নিয়েছেমাত্র। তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, আবুল বাশার, শওকত আলী, প্রমুখ প্রথম সারির লেখকবৃন্দের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তাঁদের অনেকেই আজও বিরামহীনভাবে লিখে চলেছেন। হুমায়ুন আহমেদের মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন লেখক ও চিত্র নির্মাতাকেও বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছিল। তা ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশে উন্নতমানের অসংখ্য আর্ট ফিল্ম এবং একেবারে ভিন্ন স্বাদের ছায়াছবি তৈরি হচ্ছে, যে-গুলি বিনোদন জগতে মানুষকে নতুন ধরণের চিন্তার খোরাক সরবরাহ করছে।
আবার সংগীত জগতের কথাই ধরা যাক। সলিল চৌধুরী, সুধীন দাসগুপ্ত, আর. ডি. বর্মণ ও আলতাফ মাহমুদের মতো যুগ সৃষ্টিকারী সংগীত পরিচালকদের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে বটে, কিন্তু বাপী লাহিড়ী এখনও কৃতিত্বের সাথে তাঁর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে সাবিনা, রুনা, সুবীর নন্দী, প্রমুখ কণ্ঠশিল্পী যুগ সৃষ্টি করেছেন এবং অদ্যাবধি নিরলসভাবে গান গেয়ে চলেছেন। তা ছাড়া এ. আর. রাহমান, শঙ্কর-এহসান-লয় (ত্রিরত্ন), প্রীতম চক্রবর্তী, সুমন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতার মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন গুণী সংগীত প্রযোজকদেরও আমরা পেয়েছি। আসল কথা হল, যা কিছু খোয়া যায়, তা নিয়ে আক্ষেপ করতে থাকাই মনে হয় মানুষের স্বভাব। আর যা কিছু সে পেতে আরম্ভ করে বা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে, তার জন্য খুব একটা কৃতজ্ঞতাবোধ তার তেমন থাকে না, যতক্ষণ না সে তা হারাতে বসে।
এবারে আবারও কণ্ঠশিল্পীদের প্রসঙ্গে আসা যাক। উদিত নারায়ণ, অনুরাধা পাড়োয়াল, সোনু নিগাম, শ্রেয়া ঘোষাল, শুভমিতা ব্যানার্জি এবং উপরোক্ত সুমন ও নচিকেতার মতো প্রথম শ্রেণীর অনেক শিল্পীদের কণ্ঠমাধুর্যে আজ ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস অনুরণিত। তবে এঁদের মধ্যে শুভমিতার কণ্ঠস্বরের আর কোনো তুলনা ব্যক্তিগতভাবে আমি খুঁজে পাই না। শুভমিতার সুধাকণ্ঠ স্বর্গীয়। শুভমিতার গীতিময় কণ্ঠ অপার্থিব। তাঁর গায়কী অসাধারণ ও অনন্য।
শিল্পী শুভমিতা ব্যানার্জি যে-কোনো ধরণের গানই অত্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে গাইতে সক্ষম। তাঁর গাওয়া রবীন্দ্র-সংগীত গানের ভুবনে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। এ ছাড়া রাগাশ্রয়ী এবং নগরভিত্তিক আধুনিক জীবনবোধসম্পন্ন ও নান্দনিক ধাঁচের গান পরিবেশনেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আর তার প্রমাণ শুভমিতা তাঁর অনেক গানের মাধ্যমেই দিয়েছেন। কিন্তু নচিকেতার কথা ও সুরে “মনের হদিশ কে-ই বা জানে” গানটি শোনার পর আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বাউল সুরের ও লোকগীতি ঢং-এর গান পরিবেশনেও তিনি সমানভাবে পারদর্শী। আর তখনই আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা শুভ উদ্যোগ নিয়ে ফেলি। নীচে তার বর্ণনা দিলাম।
আধুনিক গানের অ্যালবাম সম্বন্ধে আমার একটি বিনীত মত রয়েছে। তা হলঃ একই ধরণের গান, তা সে যতো উন্নত মানেরই হোক না কেন, ক্রমাগত শোনানোর ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরই একপেশে বলে মনে হয়, যা শ্রোতাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এ যেন অভ্যাগতদের কেবলই পোলাও বা বিরিয়ানী খাইয়ে যাওয়ার মতো একটি ব্যাপার। সেই কারণে আমি সাধারণত বিভিন্ন স্বাদের ও নানা ধাঁচের গান রচনা করে থাকি। আমার গানগুলির এই বৈচিত্র্যের কথা বিবেচনা করে শুভমিতার কণ্ঠকেই আমার সবচেয়ে উপযোগী বলে মনে হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে আমার প্রস্তাবিত অ্যালবামের স্বরচিত দশটি গান (in raw form) তাঁকে শোনালে তিনি গানগুলি গাইতে রাজী হন। অ্যালবামটির দশটি গানের কথা ও সুরই আমার। সাবির্ক বাদ্য রচনাও (Overall Music Composition) আমি নিজেই সম্পন্ন করি। কম্পিউটারভিত্তিক ভার্চুয়াল স্টুডিও টেকনোলোজি (VST) এবং Digital Audio Workstation (DAW) ব্যবহার করে আমাকে এই মিউজিক কম্পোজিশন করতে হয়।
এই দশটি গানের মধ্যে আধুনিক ঢঙের গানগুলির ব্যাপারে আগে থেকেই আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিন্ত ছিলাম। বলা বাহুল্য, শুভমিতা গানগুলি বিস্ময়করভাবে ভাল গেয়েছেনও। কিন্তু এই অ্যালবামের গোটা তিন-চারেক গান তো একেবারেই বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের দেহাতি সুরের গেঁয়ো উচ্চারণসমৃদ্ধ গান। এখন আর বলতে বাধা নেই যে, এই পল্লীগীতি ঘরানার গান ক’টি শুভমিতা কেমন গাইবেন, সে ব্যাপারে প্রথমদিকে খুব সামান্য হলেও এক ধরণের দুশ্চিন্তা আমার ছিল- তা তিনি যতো ভাল শিল্পীই হন না কেন। কারণ আফটার অল্ শুভমিতা বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের মেয়ে নন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, আমি তাঁকে যে-রকমভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই তিনি এই গানগুলি একেবারে ঐ এলাকার অবিকল গ্রাম্য উচ্চারণে ও ঢঙেই গেয়েছেন। তাতে নতুন করে আবার তাঁর অসাধারণ শিল্পীসত্তার পরিচয় পেলাম।
আমার এই অ্যালবামের শিরোনামঃ “সুরের বন্যা নাচে” স্বরচিত বিধায় আমার নিজের গানের প্রশংসা নিজেই করাটা মোটেও শোভা পায় না এবং এই মুহূর্তে আমি তা করছিও না। কিন্তু আমার সুর, গান, তাল ও লয় শুভমিতা তাঁর কণ্ঠে কতো সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন, তা সবাইকে শুনতে আহ্বান জানানোর অধিকার নিশ্চয় আমার রয়েছে। তাঁর যাদুকরী কণ্ঠে আমার স্বরচিত গানের সুরের যে মূর্ছনা তিনি তুলেছেন, তা উপভোগ করতে সবাইকে তাই আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
অ্যালবামের দশটি গানের মধ্যে দু’টি দ্বৈত-সঙ্গীত রয়েছে, যেখানে শুভমিতার কণ্ঠজুটি হিসেবে রয়েছেন টলিউড তথা কোলকাতার সাড়া জাগানো সঙ্গীত-প্রতিভা কণ্ঠশিল্পী সুজয় ভৌমিক। সুজয় যে শুভমিতার সুযোগ্য কণ্ঠদোসর, তার প্রমাণ তিনি ঐ দু’টি গানে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই দিয়েছেন এবং তাঁর কণ্ঠ ও গায়কীরও ভূয়সী প্রশংসা করতে হয়।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, এই দশটি গানের কেবল অডিও ভার্শন নয়, ভিডিও ভার্শনও মুক্তি পাওয়ার পথে। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার একঝাঁক উচ্ছল ভিডিও তারকা এবং কোলকাতার ‘রেইনবো ডিজিটাল রেকর্ডিং স্টুডিও’-র স্বত্বাধিকারী ও সাউন্ড রেকর্ডিস্ট স্বনামধন্য গিটারিস্ট বাপী সেন ও স্বয়ং শিল্পীযুগলের সমন্বয়ে নির্মিত দশটি গানের বর্ণাঢ্য ভিডিও অ্যালবামও শিগ্রি মহাসমারোহে বের হতে যাচ্ছে। (ভবিষ্যতে আমার রচিত গানে বাপীদা’র দুর্দান্ত গীটার বাজনা সন্নিবেশ করার ইচ্ছে রইল।)
সিডনী, কোলকাতা ও ঢাকা টীমের এক সমন্বিত প্রচেষ্টার ফসল এই অডিও ও ভিডিও অ্যালবামঃ “সুরের বন্যা নাচে” এতে থাকছে বৈচিত্র্যময় গানসমূহের এক অভূতপূর্ব সমাবেশঃ পাঁচটি অবিনশ্বর প্রেমের গান, দু’টি মনোমুগ্ধকর নাচের গান, একটি প্রার্থনা সঙ্গীত, একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক সঙ্গীত এবং আদম-হাওয়ার অমর উপাখ্যানভিত্তিক একটি সঙ্গীত। আশা করি, “সুরের বন্যা নাচে” অ্যালবামের গানগুলি সকল বয়সের এবং সকল শ্রেণীর দর্শক-শ্রোতাদেরই ভাল লাগবে।
সিডনী,
০৭/০১/২০১৫।
Related Articles
Review of the Bangladesh Constitution
The review of the Constitution of 1972 is not only an important issue but also goes to the heart of
Twenty fifth march 1971
Twenty fifth march 1971 is listed as Black Day in our History. In the dark of that night, West Pakistani
একুশে বইমেলার ডায়েরি থেকে
মনের মধ্যে তখন ছিল সাদাত হোসাইন এর নাম, এবারের বইমেলায় তার তিনটি বই বেরিয়েছে, কিনব বলে বাসা থেকে বের হলাম