বহে যায় দিন (ধারাবাহিক) – পূৰ্ব কথা, ভূমিকা

(২০০৬ প্রকাশিত ধারাবাহিক – প্রিয় ক্যানবেরা, অধুনা প্রিয় অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত)
আফজল হোসেন
৷৷ পূৰ্ব কথা ।।
কিছুদিন আগে মানিক ভাই, অর্থাৎ সাহাদৎ হোসেন মানিক, এক সকালে আমাকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছেন আমি যেনো পাক্ষিক ভিত্তিতে “প্রিয়অষ্ট্ৰেলিয়া’-র জন্য আমার এই ক্যানবেরার গত বাইশ বছর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, স্মৃতি-মাখা দিনগুলো এবং সেই সময়ের ক্যানবেরার চালচিত্রের ওপর ধারাবাহিক ভাবে লিখি । আমি ভাবতে পারিনি এরকম একটা অনুরোধ একদিন আমার কাছে আসবে। আমি মোটেও তৈরী ছিলাম না । প্রথমে কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলাম । কেনো না, আত্মস্মৃতি অথবা নিজেকে নিয়ে কোনোদিনই কিছু লিখিনি কিংবা লেখার কসরতও করিনি । বিভিন্ন সময়ে গল্প, ছড়া এবং কবিতা লিখেছি প্রচুর । সেগুলো দেশ-বিদেশের নানান পত্র-পত্রিকায় পত্রস্থ হয়েছে । তাই নিজেকে আত্মস্থ করতে খানিকটা সময় নিয়েছি।
সেই দিনে মানিক ভাইয়ের সেই অনুরোধের নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনো মহান উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। তা আমি জানি না এবং তাঁকে কখনও জিজ্ঞেস করিনি। আমি জানি এবং ভালো করেই জানি সম্পাদকেরা কি ভাবে লেখকদের কাছ থেকে লেখা বের করে নেন । অনেক বছর আগে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের লেখা একটা বই সারারাত জেগে পড়েছিলাম। বইটার নাম আমার প্রায় তিরিশ বছর পরে আজও স্পষ্ট মনে আছে – ‘সম্পাদকের বৈঠকে’। লেখক সাগরময় ঘোষ খুব সুন্দর এবং সাবলীল ভাষায় আড্ডার ঢঙে উল্লেখ করেছেন তিনি কি ভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অতীন বন্দোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ আরও অনেক নামকরা কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকে পূজা সংখ্যার জন্য লেখা সংগ্রহ করেছেন এবং পরবর্তীতে তাদেরকে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । যাহোক, শেষতক আমি সানন্দে তাঁকে কথা দিয়েছি এবং বলেছি এই মধ্য এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ১৪১৩ থেকে লিখবো ।
গত বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালের শুরুর দিকে আহমেদ ইমরান ভাইয়ের অনুরোধে আমি স্বল্প পরিসরে অল্প কথায় আমার এই ক্যানবেরার প্রবাস জীবনের ওপর নষ্টালজিয়া ভিত্তিক একটা লেখা ‘সুখ-দুঃখের নীল পদ্ম : আমি এবং ক্যানবেরা” লিখেছিলাম, যা “প্রিয়ক্যানবেরা’-র পক্ষ থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘প্রিয়-পত্রিকা’-য় প্রকাশিত হয়েছিলো । পরে এই লেখাটি কিছুটা কাট-ছাঁট করে একই বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ‘সমকাল’-এর ‘প্রবাস’ কলামে ছাপিয়েছিলেন মানিক ভাই । আমি নিশ্চিত, তাঁরা অই সময় উৎসাহ না দিলে আজ হয়তো সেই লেখাটা কোনোদিনই অবয়ব পেতো না । ফেলে আসা দিনগুলো হয়তো শুধু স্মৃতির নীল আকাশে শরতের সাদা মেঘের মতোই ভাসতো । বৃষ্টি হয়ে টুপটাপ ঝরে পড়তো না মাটিতে। ভিজিয়ে দিতো না ঘাসের নরোম ডগা কিংবা গাছের সবুজ পাতা আর রঙিন ফুল । তাঁদের দু’জনকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ ।
।। ভূমিকা ।।
দেখতে দেখতে এই ক্যানবেরা শহরে আমার কেটে গেছে পুরো বাইশ বছর, দুই দশকেরও বেশী । এর মাঝে স্মৃতির ঝুলিতে অনেক সুখময় এবং কষ্টময় দিবস ও রজনীর অসংখ্য আনন্দ-বেদনা জমা করেছি, অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি অনেক, নানান দিক থেকে জীবনকে দেখার সুযোগ পেয়েছি প্রচুর, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে মিশেছি এবং তাঁদের সাহচর্যে অনেক কিছু শিখেছি । আমি জানি, এ সবকিছুই আমার একান্ত ব্যক্তিগত সঞ্চয় এবং আগামী দিনের পথ চলার আলোকবর্তিকা – যা আমি এই ধারাবাহিক লেখার মধ্য দিয়ে ‘প্রিয়অস্ট্রেলিয়া’-র পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে ‘শেয়ার করবো ।
জার্মান প্রবাদ আছে ‘এভরী বিগিনিং ইজ ডিফিকাল্ট’, অর্থাৎ ‘প্রত্যেকটা শুরুই হচ্ছে কঠিন’ । আর এই শুরুটা নিয়েই যত্তসব ঝালেমা, মুস্কিলও বটে । কোথা থেকে শুরু করবো, কিভাবে শুরু করবো, কি রকম সাজাবো স্মৃতির মালা – তাই নিয়ে দারুণ ভাবনা-চিন্তার দোলনায় দুলছিলাম গত বেশ কিছুদিন। দোকানে ঢুকে আমরা যেমন কোনো একটা কিছু কেনার আগে নেড়ে চেড়ে উল্টে-পাল্টে দেখি, মনকে প্রবোধ দেই, চোখ দু’টোকে শীতল-শান্ত করি, আমিও সেই রকম আমার স্মৃতির ধূসর এবং মলিন পাতাগুলোকে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখেছি । এলোমেলো করে ভেবেছি বারবার । আলতো করে ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিয়েছি স্মৃতির পাতায় জমে থাকা অজস্র ধূলো-কণা। মানুষ যেভাবে থরেথরে ফুল দিয়ে মালা গাঁথে, আমিও সেই রকমভাবে গাঁথতে চেয়েছি খন্ডখন্ড ফেলে আসা দিনগুলোর আনন্দ-বেদনার ঘটনা দিয়ে স্মৃতির মালা । কিন্তু শুরুটা তেমন করে ভাবতে পারিনি । মাথার ভেতর শুধু এক ধরনের যন্ত্রনা অনুভব করেছি। আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ সত্যি, দারুণ কঠিন, বেশ কষ্টেরও।
মগজের মধ্যিখানে হঠাৎ একদিন জিওল মাছের মতো লাফিয়ে উঠলো একটা কিছু । তারপর শান্ত জলাশয়ে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে গেলো নিঃশব্দে । তবে রেখে গেলো তার রেশটুকু । আর তখনই মনে হলো এই বছরের জানুয়ারীর সাতাশ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের ‘সাহিত্য সাময়িকী’ পাতায় ফজল হাসানের প্রকাশিত গল্প ‘পলা জানে না’-র একটা অংশ । সেই অংশটাকে কিছুটা পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং সংযোজন করে আরম্ভ করবো এই ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্ব ।
তবে তার আগে এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমার এই লেখা শুধু আমার অভিজ্ঞতা এবং ক্যানবেরার বিগত দিনের স্মৃতি মাখা দিনগুলোর কথাই থাকবে, তা নয়। এর মাঝে অন্যান্য ঘটনা এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখও থাকবে । যেমন আমি আমাদের (অর্থাৎ আমরা যারা প্রথম ‘জেনারেশন’ মাতৃভূমি-জন্মভূমি ছেড়ে এই বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি) পেছনে ফেলে আসা সোনালী দিনের কথা, শেকড়ের টান, আগামী দিনের স্বপ্ন-আশা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, তাদের মন-মানসিকতা ও টানাপোড়েন, এমন কি সুখ-দুঃখের কথা বলবো, বিশেষ করে বর্তমান জীবন-যাত্রা, কালচারাল শক, নতুন পরিবেশ আর সমাজ-সংস্কৃতি সঙ্গে খাপ খাওয়ানো- সবই ধারাবাহিকভাবে আসবে ।
(চলবে)
Related Articles
Lecture on Social Business of tackling society's most pressing problems by Dr Yunus in Monash University
Social Business for Tackling Society’s Most Pressing Problems Monash University and the Monash Business School are proud to host a
কালিপুজা ক্যানবেরা তে হলেও বটতলায় হয়নি
বর্তমান পশিম বঙ্গের নবদ্বিপে ১৮ শতকের দিকে তৎকালীন রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের শুরু করা কালিপুজা এখন কেনবেরাতেও। গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর
ওয়েলিংটন টেস্টে পরাজয় আর চোট প্রসঙ্গ
ফজলুল বারী, ক্রাইস্টচার্চ থেকে: এখনও চলছে ময়নাতদন্ত ওয়েলিংটন টেস্টের। প্রথম ইনিংসে এমন একটি রেকর্ড ৫৯৫ রানের পর যে দল দ্বিতীয় ইনিংসে