বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের কুড়ি বছর – দীপেন ভট্টাচার্য

বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের কুড়ি বছর – দীপেন ভট্টাচার্য

আন্দোলন হিসেবে পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে দেরিতে এসেছে। পরিবেশগত যত ধরণের সূচক আছে – বায়ু দূষণ, পানীয় জল দূষণ, আর্সেনিক, লবণাক্ততা, বন্যা – যাই বলুন না কেন সেগুলির সীমা যেভাবে গত চল্লিশ বছর ধরে যেভাবে অতিক্রম হয়ে আসছে তাতে অনেক আগেই তৃণমূল পর্যায়ে পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত হবার কথা ছিল। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা শক্তিশালী পরিবেশ আন্দোলন সৃষ্টি হবার অন্তরায় হয়েছে। এই অর্থে Bangladesh Environment Network ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) উভয়ই পথিকৃত সংগঠন বলা যায় – কারণ এ দুটি অস্তিত্বই শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষার্থে উৎসর্গীত। বাপা বাংলাদেশের বিভিন্ন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠনকে যেভাবে একটি ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে তা অনন্য। গত ২০ বছর বাপা যেভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে – যেগুলোর বেশীরভাগই প্রতিকূল বলতে হবে – কাজ করেছে সেজন্য বাপার প্রতিটি কর্মীর, তা সে যত ক্ষুদ্র বা বৃহৎভাবেই এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হোক না কেন, তাঁর অভিনন্দন প্রাপ্য।

বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা জটিল, এর জন্য সাহসেরও প্রয়োজন। আমরা জানি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নাজুক অবস্থায় আছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অগ্রগণ্য। সারা দেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১,২৫০ জন মানুষ বাস করে, ঢাকা শহরে এই সংখ্যাটা হলে ৪৫,০০০, কোনো ধরণের স্বাস্থ্যসূচকেই এই সংখ্যাটা নিরাপদ হতে পারে না। পৃথিবীর দুর্দিনে, এই কোরোনাকালে জনসংখ্যার এই ঘনত্ব আরো ঋণাত্মক ভূমিকা পালন করছে কারণ এই ধরণের ঘনত্ব নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব রাখতে সাহায্য করে না।

সারা দেশের বায়ু দূষণের মাত্রা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ, বর্তমানে ঢাকা শহরে মেট্রো ও উড়াল পথ নির্মাণে এই সংখ্যা চরমভাবে মাত্রা ছাড়াচ্ছে, এমনকী মার্চ এপ্রিলের লক ডাউনের সময় সারা পৃথিবীতে যখন বায়ু দূষণের মাত্রা কমে এসেছিল, বাংলাদেশে সেরকম উল্লেখযোগ্যভাবে দূষণ কমে নি। মধ্যবর্তী আয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের অগ্রসরমান অর্থনীতির জন্য চাই নতুন শিল্প, কিন্তু সেই শিল্প থেকে বর্জ্য যেভাবে অপরিশোধিতভাবে জনবসতি ও প্রকৃতির মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে তাতে সামগ্রিকভাবে দেশের ক্ষতিই হচ্ছে। আশুলিয়ার বড় রাস্তার জলাধারের রঙ দেখলেই সেটা বোঝা যাবে। একইভাবে ট্রেনে আসতে আসতে দুপাশে প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি দেখলে গা শিউরে ওঠে। বর্তমান বিশ্বে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপদ্রব একটা বড় সমস্যা যা কিনা খাদ্যজ উদ্ভিদেও দেখা দিতে পারে।

মধ্যআয়ের দেশে উন্নত হতে হলে কেন পরিবেশকে পিছনের সিটে বসতে হবে এই নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু আমরা জানি সাময়িকভাবে যে দ্রুত উন্নতি আমরা করতে চাইছি তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর দিতে হবে। এছাড়া আমাদের ভাবতে হবে যে instrumental value – যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি ছাড়াও পরিবেশের একটা intrinsic value আছে। সেজন্য পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে সামগ্রিকভাবে, শুধুমাত্র যে অংশগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে সেগুলো নয়। এই প্রেক্ষাপটটিকে বোঝার জন্য চাই শিক্ষা ও পরিণত সুশীল সমাজ।

civil society বা সুশীল সমাজ কথাটি ইদানীংকালের আবিষ্কার নয়। এমনকী অ্যারিস্টোটলও কথাটি ব্যবহার করেছেন। জার্মান দার্শনিক গিওর্গ হেগেলের ভাষায় – সুশীল সমাজের মধ্যে গুণ ও কাকতালীয় ব্যাপারের সমাবেশ ঘটে, যেখানে মানুষের সমস্ত যুক্তি ও অনুভূতির মেলা বসে। একটি সংগঠিত সুশীল সমাজ সরকার ও ব্যক্তির মধ্যে আদান প্রদানের মাধ্যম হতে পারে। দুঃখের বিষয় বর্তমান সময়ে এই ধরণের সমাজ সারা পৃথিবী জুড়ে কর্তৃপক্ষের সাথে একটা বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছে। কোনো কোনো জায়গায় তাদের দোষারোপ করা হচ্ছে যে, তারা global eliteএর স্বার্থ দেখছে এবং স্থানীয় মানুষের কথা ভাবছে না। এই ধরণের কথা স্বাভাবিকভাবেই বৃহত্তর সমাজকে পরিবেশ আন্দোলনের ব্যাপারেও এক ধরণের দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়।

অসংঠিত সুশীল সমাজ হলে কী বিপদ হতে পারে সেটা বর্তমানের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত চার বছরের অভিজ্ঞতার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। ট্রাম্প কর্তৃপক্ষ গত পঞ্চাশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে যে সমস্ত পরিবেশগত আইন ছিল ধীরে ধীরে তা ধ্বংস করছে। গাড়ীর তেল খরচের দক্ষতা থেকে আরম্ভ করে কারখানা থেকে বর্জ্যের জলের পরিমাণ এই সব ব্যাপারেই আইনকে শিথিল করা হয়েছে, সরকারি সংরক্ষিত বনকে তেল ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ আহরণের জন্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এই ধরণের deregulationকে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সুশীল সমাজ সেখানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারিনি। এই ভূমিকা না রাখার ব্যাপারটা বর্তমানে ভাইরাসের ব্যাপারে আমেরিকার ব্যর্থতার মধ্যেও প্রকটিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে ২০২১ সনে নতুন কর্তৃপক্ষ গত চার বছরের পরিবেশবিরোধী আইনগুলোকে বাতিল করতে সক্ষম হবে।

অনেকে পরিবেশ আন্দোলনকে একটা ফ্যাশনও মনে করেন, তারা ভুলে যান পরিবেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে পরিবেশকর্মীরা স্থানীয় স্বার্থের রোষানলে পড়েন। Global Witness নামে একটি watch dog group আছে, তাদের websiteএ পরিবেশ কর্মীদের নিহত হবার একটা তালিকা থাকে, ২০১৭তে এই সংখাটা ছিল ২০০। বিশ্বে প্রতি দুদিনে অন্তত একজন করে পরিবেশ কর্মীকে হত্যা করা হচ্ছে। যদিও এই তালিকাতে মূলত মেক্সিকো, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, ভারত ও ফিলিপিনো পরবেশ কর্মীদের নাম পাওয়া যায়, আমরা জানি বাংলাদেশেও পরিবেশ কর্মীরা নানান ধরণের হয়রানির স্বীকার হন। বাপা ও অন্যান্য পরিবেশ সংগঠকেরা এটা ভাল জানেন, তাঁরা উন্মুক্ত কয়লাখনি, সুন্দরবনে কয়লা বিদ্যুৎ কারখানা বা সিলেটে খাসি জমি দখল এসব বন্ধের আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁরা প্রতিকূল পরিবেশের স্বীকার হয়েছেন।

র‍্যাচেল কারসন তাঁর নীরব বসন্ত বা silent spring বইতে লিখেছিলেন যে মার্কিন দেশের বিরাট অঞ্চল জুড়ে এখন বসন্ত আসে পাখীদের প্রত্যাবর্তন ছাড়াই। তাই উষাকাল থাকে অদ্ভুতভাবে নীরব যা কিনা একসময় থাকত পাখির কলতানে মুখরিত। হঠাৎ পাখির এই যে নীরবতা, রঙ, সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যর এই অপসারণ তা এসেছে আমাদের অজান্তেই, আমরা বুঝতেই পারিনি প্রকৃতি কখন বদলে গেছে। 

র‍্যাচেল কারসনের এই বিখ্যাত বই মার্কিন দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশকের ব্যবহার কেমন করে ক্ষেত খামার, পানীয় জল, জীব বৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং সরাসরি মানুষের ওপর আঘাত হেনেছে তা লিপিবদ্ধ করেছে। এই কাজের পরে মার্কিন দেশে কীটনাশক ব্যবহারের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হয়। একটি বই কেমন করে দেশের নীতি পরিবর্তনের ইন্ধন হতে পারে কারসনের বইটি সেটার উদাহরণ। বাংলাদেশের পাখির ডাক কি আমরা এখন শুনতে পাই? নাকি দূষণে আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ তার তীক্ষ্ণতা হারিয়েছে, পাখি যে ছিল সেটাই ভুলে গেছি। এই বিষাদ সংবাদের মধ্যে আলোর রেখাটা হল বাপার সঙ্গে সংযুক্ত কিছু পরিবেশকর্মী এখনো পাখি সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।  

আমি BEN ও বাপার সঙ্গে আছি গত ২০/২২ বছর, আমার এখ্নও মনে পড়ে সেই ক্ষণের কথা যখন ১৯৯৮ সনে ড. নজরুল ইসলাম ফোনে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন BEN এর সাথে যুক্ত হবার জন্য। এত বছরে পরিবেশ আন্দোলন কী সফলতা অর্জন করেছে? নদীরক্ষা, বায়ু দূষণ বা প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কিছু জয় অর্জিত হলেও সামগ্রিকভাবে পরিবেশের অবক্ষয় যে রোধ করা যায় নি তা আমরা জানি। একটি সমস্যা হল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে পরিবেশ সম্পর্কে যথেষ্টভাবে সচেতন করা সম্ভব হয় নি, আর যাদের সচেতন করা গেছে তাদের অনেকেই মনে করে পরিবেশ রক্ষা শুধু পরিবেশকর্মীদের দায়িত্ব। তাই আগামীতে শুধু বিশেষ ইস্যুতে নয়, বরং বৃহত্তর পটভূমিতে জনসাধারণকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করাকে পরিবেশ আন্দোলনের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করতে হবে, এই প্রসঙ্গে সুশীল সমাজের একটি ভূমিকার কথা আগে উল্লেখ করেছি। পরিবেশ বাঁচানোর নতুন উপায় আগামীতে আমরা খুঁজে নিতে পারব আশা করি।
  
—————————-
দীপেন ভট্টাচার্য, লেখক ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র 

                        


Place your ads here!

Related Articles

4th International Conference on Bangladesh Environment

4th International Conference on Bangladesh Environment (ICBEN-4) – December 26-27, 2020 (in virtual mode) The Fourth International Conference on Bangladesh

সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে…

দিলরুবা শাহানা: গল্পটা সেজানের নয়, রিদ্ভারও নয়। চব্বিশ বছর পর সেজান দেশে ফিরেছে। রিদ্ভাকে নিয়েই সে এসেছে। তবুও গল্প তাদের

Message from Gary Caine, Indigenous Leader, Australia to BEN, BAPA and PriyoAustralia

Welcome – Welcome – Welcome … to everybody in attendance here now in the 4th International Conference for the BEN

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment