সম্রাটের দরবারের সামনে থমকে যাওয়া অভিযান!

সম্রাটের দরবারের সামনে থমকে যাওয়া অভিযান!

ফজলুল বারী: কথা ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান হবে। এ কথা দেয়া হয়েছিল নৌকার নির্বাচনী ইশতেহারে। জিরো টলারেন্স! ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদকের নজিরবিহীন পদচ্যুতির মাধ্যমে এটি আসলে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অভিযান হয়ে যায়। চাঁদার ভাগ আনতে বোকারা জাবির ভিসির বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিল! আর ক্যাসিনো কান্ড আবিস্কারের পর ক্যাসিনো-জুয়া-সিন্দুক ভর্তি টাকা পাবার পর খালেদ ভূঁইয়া-জি কে  শামীম-লোকমানদের ধরা হলেও ক্যাসিনো গুরু সম্রাটের গায়ে হাত দিতে কেনো কেঁপে উঠলো রাষ্ট্রের হাত! গুরুর নাম সম্রাট সে কারনে?  এরমাঝে দশদিন পেরিয়ে গেলেও একজন ক্যাসিনো জুয়াড়ি গডফাদারকে গ্রেফতার করা নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের অতো রাখঢাকের কারনই বা কী? এই মূহুর্তে দেশজুড়ে এটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। অনেকেই টাকার ভাগ পেয়েছেন সে জন্যে? পর্দার ওপাশ থেকে আবার সামনে চলে আসছে ‘দরবেশ চাচা’ আর ‘সেলিম ভাই’র দ্বন্দ্বের বৃত্তান্ত! রোববার রাত পর্যন্ত তথ্য হচ্ছে  রাজধানীর বনানীর একটি বাড়িতে অবস্থান করছে সম্রাট। সবাই সবকিছু জানে। এরপরও অপেক্ষা! দেশের সবকিছু যে করবেন প্রধানমন্ত্রী! আর সবার কাজ কী ঘোড়ার ঘাস কাটা! এর আগে প্রায় সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে যেতো সম্রাট। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তার সিঙ্গাপুর যাতায়াতটি শুধু বন্ধ আছে।

তার মুরিদরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মহামান্য সম্রাটের’ নানান মহিমা বিতরন করছে! প্রচার করা হচ্ছে তার সম্রাট নামটি নাকি বঙ্গবন্ধুর দেয়া! তার আব্বু পুরনো আওয়ামী লীগার ইত্যাদি। বড় হয়ে সেই ছেলে যদি দানব হয়ে দাঁড়ায়, ক্যাসিনো জুয়াড়ি চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ গডফাদার হয়ে উঠলে কী তার গায়ে হাত দেয়া যাবেনা? যেখানে এই অভিযানের উদ্যোক্তা খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের সভায় বলেছেন তিনি ও তাঁর বোন শেখ রেহানা তাদের জাকাতের টাকা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দেন, আর বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে সম্রাট পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছে! সেই চাঁদাবাজ সম্রাটের দরবারের সামনে দেশজুড়ে প্রশংসিত একটি অভিযান থমকে দাঁড়িয়ে থাকে কেনো?

গেন্ডারিয়ার পেশাদার জুয়াড়ি এনু-রূপনের লুকানো কাড়ি কাড়ি টাকা উদ্ধার করা হলো, কিন্তু তাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া দেয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খানকে যদি কিছু বলতে শরম পান, তাহলে সরকারের বিপুল প্রশংসার এই অভিযানে যে কালিমা লাগে। সত্যিকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান করতে গেলেতো দরবেশ চাচা,  নূর আলী সহ আরও অনেককে এড়িয়ে চলা যাবেনা। ধরা পড়বেন অনেক মন্ত্রী-এমপি। ঢাকার ক্যাসিনোগুলো থেকে প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা করে চাঁদা সংগ্রহ করতেন মিরপুরের সালাহউদ্দিন! এই টাকার ভাগ অনেকের কাছে যেতো। এই সালাহউদ্দিন কে তা দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জানেন। কারন সালাহউদ্দিন তার ছেলের বন্ধু। কাজেই ক্যাসিনো কান্ড অনেকের কাছে হঠাৎ আবিষ্কার মনে হলেও এটি কোন হঠাৎ কান্ড নয়।

এবার ঢাকার ক্যাসিনো শিল্প বিকাশের কাহিনী সবার সঙ্গে শেয়ার করি। ঢাকায় প্রথম ক্যাসিনো চালু হয় কলাবাগান স্পোর্টিং ক্লাবে। আইনে ক্যাসিনো শব্দটি নেই। ইন্ডিপেন্ডেন্টস টেলিভিশনের এক সাংবাদিক প্রথম অনলাইন গেমসের নামে প্রথম ক্যাসিনোর লাইসেন্স নেন। এর নাম ছিল ক্রিস্টাল ১৮৬ ডটকম। পুরানা পল্টনের প্রিতম জামান টাওয়ারে সম্রাটের ক্যাসিনোয় নারকোটিক্স বিভাগ অভিযানে গিয়েছিল ২০১৮ সালে। সেখানে অভিযানকারীদের মাথায় অস্ত্র ধরা হয়েছিল। সিসিটিভির ফুটেজ থেকে ছবি নিয়ে সে ছবি তারা দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে দেখিয়েছে। তিনি উল্টো সেখানে অভিযানে যাওয়া নিয়ে ভৎসনা করাও হয়। কিন্তু এ নিয়ে পরে নানা তৎপরতা শুরু হলে পরে সেটি বন্ধ করে দিতে হয়।

পরবর্তীতে সম্রাট নেতৃত্বে চলে আসলে গোপনে নিরাপদে চলতে থাকে সব ক্যাসিনো। ফকিরাপুল ইয়াংস ক্লাবে খালেদের ক্যাসিনো, মোহামোডানের ক্যাসিনো ছাড়া ঢাকার আর সব ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক ছিল সম্রাট। পেশাদার খুনি হিসাবে খালেদের পুরনো পরিচিতির কারনে সম্রাট খালেদকে ভয় পেতো। মোহামেডানের ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক লোকমান বিসিবির সভাপতি পাপনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়াতে তাকেও ঘাটাতোনা সম্রাট। তবে সব ক্যাসিনোর প্রশাসনিক নিরাপত্তার বিষয়টি সম্রাট দেখতো বলে সে হয়ে ওঠে সব ক্যাসিনো জুয়াড়িদের গুরু। এক ঢাকা মোহামোডান ক্যাসিনোতেই পয়তাল্লিশ জনের একটি ভিআইপি তালিকা আইন শৃংখলা বাহিনী সবার ফোন নাম্বার সহ পেয়েছে যাদের  একেকজন প্রতিদিন জুয়ার পিছনে বিশ লক্ষ টাকার বেশি ব্যয় করতেন! এই একটি তালিকা ধরে ঢাকার পুরো ক্যাসিনো ব্যবসার পিছনে প্রতিদিনের টাকাকড়ির একটি ধারনা পাওয়া গেছে। ডিএমপির সাবেক একজন গুরুত্বপূর্ন কর্মকর্তার অংশগ্রহন অথবা অবগতি ছিল নানাকিছুতে। মজার বিষয় তার নেতৃত্বেই ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়।

গত বছর তিন ধরে ঢাকা মহানগর যুবলীগ আর ক্যাসিনো ব্যবসার নিয়ন্ত্রন একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়। যুবলীগ নিয়ন্ত্রন দেখভাল করেন শেখ সেলিম। তার ভগ্নিপতি তথা আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের রেখা আপার স্বামী ওমর ফারুক চৌধুরী। রেখা আপা এবং তার ছেলে অভি অনেকের প্রিয় একটি চরিত্র। এখন সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যুবলীগের নিয়ন্ত্রন নিতে চান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছ থেকে পাঁচকোটি টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা থেকে প্রধানমন্ত্রী সম্রাটের ওপর নাখোশ। প্রধানমন্ত্রীর অসন্তুষ্টি যুবলীগের নানা কর্মকান্ড নিয়ে। সালমান এফ রহমান এই সুযোগটা নিতে চান। যুবলীগ কার নিয়ন্ত্রনে থাকবে এই দ্বন্দ্ব থেকেও থমকে আছে সম্রাটের গ্রেফতার।

ক্যাসিনো কান্ডের আন্ডারওয়ার্ল্ড আর বিপুল টাকা লেনদেনের বিষয়ে খালেদ ভূঁইয়া, জিকে শামীম, লোকমানের গ্রেফতার আর গেন্ডারিয়ার নগর আওয়ামী লীগের নেতা এনু-রুপনের লুকনো বিপুল অর্থ উদ্ধারের ঘটনায় অনেকের টনক নড়েছে। খালেদা জিয়ার সাবেক দেহরক্ষী, পাপনের বন্ধু ক্যাসিনো লোকমানতো একাই  অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংকে মাত্র ৪১ কোটি টাকা সরিয়েছে। আর কে কতো এমন বহু ৪১ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছে তাদের কিভাবে ধরা হবে বা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, সে প্রশ্ন অনেকের। অস্ট্রেলিয়ার একজন ব্যাংকারের সঙ্গে আলাপ করে ধারনা হয়েছে, বিদেশে টাকা পাচার এখন কত সহজ! যে কেউ সিঙ্গাপুর নেমেই একটা  ব্যাংক একাউন্ট খুলতে পারে। নির্ধারিত ফী দিয়ে একাউন্ট ট্রান্সফারের মাধ্যমে সে টাকা পাঠানো যায় অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংক একাউন্টে। অস্ট্রেলিয়ার এসব ব্যাংকের শাখা সিঙ্গাপুরেও আছে। বাংলাদেশের সাধারন মানুষজনের বৈদেশিক মুদ্রা কেনা-সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা অনেক। পাপনের বন্ধু লোকমানরা জানে কার সঙ্গে বা কিভাবে গেলে তাদের লাগেজ চেকও হয়না।  ক্যাসিনো নিয়ে দেশ জুড়ে এত হৈচৈ হচ্ছে অথচ বিদ্যমান আইনে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সুযোগ নেই। জুয়ার শাস্তি পাঁচশ টাকা জরিমানা। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের জামিন করাতে এরমাঝে আইনজীবীদের লাইন লেগেছে।

বাংলাদেশে মদ-জুয়া বিরোধী গালগল্প যখন করা হয় তখন হাসি পায়-রাগ হয়। কবে বাংলাদেশে মদ-জুয়া বন্ধ ছিল? বাংলাদেশের কোন শহরে-গঞ্জে কোন মদ পাওয়া যায় না? নিষিদ্ধ সামগ্রীর প্রতি আকর্ষন মানুষের সহজাত প্রবনতা। বিশেষ করে তরুন-যুবকদের। বহুবছর আগে একবার নেত্রকোনায় সরেজমিন রিপোর্ট করতে গেলে বলা হয়, নেত্রকোনার নেশার জগতের গাজা খায় বেশি, ফেন্সিডিলের খায় কম। কারন গাজার দাম কম, ফেন্সিডিলের দাম বেশি। আমি আবার দেশের বিভিন্ন জনপদে গেলে নাগরিক জীবনের নানা দিক নিয়ে রিপোর্ট করতাম। এভাবে সারা বাংলাদেশ জুড়ে গাজার মার্কেট ভলিয়্যুম নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ভালো বলতে পারবেন। ইয়াবা আসার পর পরিবহন ঝুঁকি সহ নানা সমস্যায় ফেন্সিডিলের সরবরাহ-ব্যবহার কমেছে। ইয়াবা বানিজ্যের ভলিয়্যুমটাও সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন।  বাংলাদেশের ইয়াবাখোররা এর বাজারটি এরমাঝে কলকাতা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে। নেশার বাজারটি রমরমা বলেই দেশের একজন সাবেক এমপির নামইতো হয়ে গেছে ইয়াবা বদি। এই বদনামে তাকে মনোনয়ন দেয়া না যাওয়ায় তার বেগমকে এমপি বানিয়ে সাম্রাজ্যটি রক্ষা করা হয়েছে। অথচ যে সব দেশে মদ বৈধ সে সব দেশের মানুষ ইয়াবার নামও জানেনা।

মদ-বার বেআইনি করে রেখে দেশজুড়ে মদের অবৈধ বাজারটির সংরক্ষন করা সম্ভব হচ্ছে। ভালো হচ্ছে পুলিশের রোজগারও। প্রতিদিন যত মানুষ বাসে-ট্রেনে-বিমানে কলকাতা যায় তারা এই সুযোগে এক-আধটু গিলতেও যায়। একেকজন বৈধ-অবৈধভাবে, ক্রেডিট কার্ডে কত ডলার নিয়ে যায় এই ভলিয়্যুটাও বিশাল। দেশেবিদেশে বাংলাদেশিদের বেশিরভাগ হালাল মাংসের ব্যাপারে যতোটা সতর্ক, সুবিধামতো মদ-বিয়ার গেলার ব্যাপারে ততটা নির্লিপ্ত! শুকরের মাংস হারাম। মদ গেলার সময় সেটি মনে না রাখলেও চলে। দেশের সচিবালয় ভবনসহ নানান গুরুত্বপূর্ন ভবন নির্মানের ঠিকাদার জি কে শামীম যখন তার ড্রয়ার থেকে টাকার বান্ডিল বের করে দিচ্ছিল তাকে মোটেই বিচলিত মনে হয়নি। কারন শামীমকে যারা ধরতে গেছে তাদের সদর দফতর নির্মানেরও ঠিকাদার সে। কোর্টে নেবার সময় তার পরনে নতুন জামা ছিল। এটাও সম্ভবত উপহার হিসাবে পাওয়া। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে আইন না থাকায় আটককৃতদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, মদ রাখা এসব অপরাধে মামলা দেয়া হয়েছে। দেশের মানুষ ভিন্ন কোন ইস্যুতে ব্যস্ত হয়ে গেলে এরা জামিনে বেরিয়ে যাবে। দেশের মানুষের মূল আগ্রহ কিন্তু দুর্নীতি বিরোধী অভিযান কবে শুরু হবে তা নিয়ে। কারন শুধু রাজনীতিকরাই বাংলাদেশের একমাত্র দুর্নীতিবাজ না। এখন যে সব বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে তাদের সবাই কিন্তু ফেরেস্তা না। 


Place your ads here!

Related Articles

Quarantiny – Chapter 4 – Day 1

Chapter 4 – Day 1 – Friday 17 April 2020 “The best part about tough time,it is not static, it

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াঃ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন মোটামুটি ভালো হয়েছে

ফজলুল বারী: আওয়ামী লীগের মনোনয়ন মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে দেশের রাজনীতির রিপোর্টার এবং দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক হিসাবে আমার ধারনা এটিই চূড়ান্ত

“একুশে’র চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন” মাতৃভাষার বিশ্বপরিবার-এর প্রবর্তন (বিশ্বভাতৃত্ব ও সম্প্রীতির ভিত্তি)

“আমার ভাষা, তোমার ভাষা; বাংলা/(মাতৃ)ভাষা, বাংলা/(মাতৃ)ভাষা”। “মোদের গড়ব, মোদের আশা; ও   আমার/(আ-মরি)বাংলা ভাষা”। দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে স্বাধীনপ্রাপ্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ

1 comment

Write a comment
  1. নকিব রহমান
    নকিব রহমান 30 September, 2019, 00:43

    চমৎকার সাহসী লিখা বারী ভাই!

    Reply this comment

Write a Comment