পাসপোর্ট সারেন্ডারকারী একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যূ

ফজলুল বারী: বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা মারা গেছেন। ভিন্ন মতাবলম্বী হলেও আমেরিকা থেকে তাঁর লাশ আনতে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার। এটি সরকারের প্রশংসনীয় উদারতা। কারন সাদেক হোসেন খোকার দল তাদের সাবেক মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার ক্ষেত্রে এই উদারতা দেখায়নি। সাদেক হোসেন খোকার মতো মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান ভূঁইয়াও ক্যান্সারে মারা যান। ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ায় তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। মৃত্যুপথযাত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া একজন বিএনপি নেতা হিসাবে মরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী সাবেক মহাসচিবকে দলে ফেরাতে রাজি হননি খালেদা জিয়া। ওই অবস্থায় দলবিহীন অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যু হয়। আর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যু হলো বাংলাদেশের পাসপোর্টবিহীন অবস্থায়। কারন আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে তিনি তাঁর পাসপোর্ট মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে সারেন্ডার করেছিলেন। যা তিনি, তাঁর পরিবার এবং দল গোপন করেছিলেন।
ক্যান্সারের কাছে পরাজিত সাদেক হোসেন খোকা যখন মৃত্যুপথযাত্রী তখনই প্রকাশ পায় তিনি একজন রাষ্ট্রবিহীনও! তাঁর সবুজ পাসপোর্টটি নেই! দীর্ঘদিন ধরে তিনি আমেরিকায় ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর যে পাসপোর্ট নেই এটা এতদিন বিএনপি বা সাদেক হোসেন খোকার পরিবার প্রকাশ করেনি কেনো? তাহলেতোও এখন তার পাসপোর্ট নিয়ে শোরগোল হচ্ছে তখনও তা হতো। একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা যিনি দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছেন তাঁর পাসপোর্ট থাকবেনা কেনো? আসল তথ্য হলো আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে রাষ্ট্রবিহীন ঘোষনা করেছিলেন। কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে গেলে তাকে তার পাসপোর্ট সমর্পন করতে হয়। সাদেক হোসেন খোকার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে প্রটেকশন ভিসা প্রাপ্ত হিসাবে তিনি নিজেই সেখানে একটি ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পেতেন। সেটি না পাওয়ায় তাঁর দেশে ফেরার উপায় নিয়ে পরিবারের পক্ষে হতাশা প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু আসল তথ্য গোপন করে বিএনপিপন্থীরা এখন তাঁর পাসপোর্ট নিয়ে শোরগোল তুলে ভালো করেননি। পাসপোর্ট ছাড়া যেমন কেউ কোন দেশে যেতে পারেনা তেমনই একটি বৈধ পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া কেউ কোন দেশে থাকতেও পারেননা। সাদেক হোসেন খোকার পাসপোর্টের মেয়াদের সঙ্গে তাঁর মার্কিন ভিসার মেয়াদও ফুরিয়েছে। ওই সময়ের আগেই তিনি পাসপোর্ট সমর্পন করে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। বিদেশে অবস্থানরত কেউ পাসপোর্ট হারালে তাকে পুলিশকে অবহিত করে একটি ইনসিডেন্ট নাম্বার নিয়ে নিকটস্থ হাইকমিশনে বা দূতাবাসে নতুন একটি পাসপোর্টের জন্যে আবেদন করতে হয়। আর মেয়াদোত্তীর্ন পাসপোর্টসহ আবেদন করতে হয় নতুন পাসপোর্টের জন্যে। সাদেক হোসেন খোকার পাসপোর্টের আবেদনের সঙ্গে এ বিষয়টি অনুসরন করা হয়নি। মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির পাসপোর্ট নিয়ে সৌজন্যবশত এ বিষয়টিও সামনে আনেনি সরকার। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক সাড়া দিয়ে বলেন সাদেক হোসেন খোকার পরিবার চাইলে তাঁর জন্যে ট্র্যাভেল ডকুমেন্টের ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশ সরকারের ইস্যু করা ট্র্যাভেল ডকুমেন্টেই দেশে তাঁর লাশ আসছে। কারন মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন দেশের পাসপোর্ট মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে সারেন্ডার করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা।
একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার দোষ বলা হয়না। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমিও সেভাবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের দূর্ধর্ষ দল ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম সদস্য ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। এই দলটিই প্রথম ঢাকায় ঢোকে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান রুমিও এই ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম সদস্য ছিলেন। কিন্তু সেই যে হুমায়ুন আজাদের অমর বচনঃ একজন রাজাকার সব সময় রাজাকার কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা সব সময় মুক্তিযোদ্ধা নাও থাকতে পারে। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে রুমির সহযোদ্ধাদের সবার মতো সাদেক হোসেন খোকাও রুমির মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আম্মা ডাকতেন। কিন্তু গোলাম আজমের ফাঁসির দাবিতে শহীদ জননী যখন গণআদালতের ডাক দেন তখন সেটি ঠেকাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাদেক হোসেন খোকার ভূমিকা যে বাংলাদেশ ভুলে যায়নি। সেই মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা মূলত তখন থেকেই একাত্তরের সহযোদ্ধাদের সঙ্গ ছেড়ে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নেন! নিজেকে তিনি মানিয়ে নেন হুমায়ুন আজাদের ফর্মূলায়! এরপরও তাঁর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ কিন্তু সব ভুলে একজন মুক্তিযোদ্ধার কফিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ কখনো কোন রাজাকারের কফিনের পাশে দাঁড়ায়না। রাজাকারের কফিনের পাশে শুধু দাঁড়ায় রাজাকার আর তাদের আন্ডাবাচ্চার দল।
বিএনপিতে যোগ দেবার পর মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা বিচ্যুতও সাদেক হোসেন খোকা। তাঁর যৌবনে তিনি যখন যুদ্ধে যান তখন সব মুক্তিযোদ্ধার নেতার নাম ছিল বঙ্গবন্ধু। প্রশিক্ষনের সময় সব মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর নামে শপথ নিয়েছেন। অপারেশনে যাত্রার আগে তারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দিয়ে যাত্রা শুরু করতেন। অপারেশন শেষে জয়ধবনি করতেন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন করে বাংলাদেশে তারা সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর সবাই মিলে তাঁকে করলেন জাতির পিতা। কিন্তু সেই জাতির পিতাকে হত্যার পর যে মুক্তিযোদ্ধারা খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন তারা যে পড়ে যান হুমায়ুন আজাদের ফর্মূলায়। এই মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা বিএনপিতে যোগ দিয়ে আপনার শ্লোগান হয়ে গেলো জয় বাংলা’র বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, এটি কী আপনার ভালো লাগতো? মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ভুলে অথবা এসবের বিরোধিতা করে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় থাকে কী করে? তার পরিচয়টি অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় হুমায়ুন আজাদের ফর্মূলায়। দূঃখিত সাদেক হোসেন খোকা। একাত্তরের ভূমিকার জন্যে আপনাকে আমরা ভালোবাসতাম। মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা বিরোধী ভূমিকার আপনাকে আমরা ভালোবাসতে বাধ্য নই। যে কোন ভালোবাসা কিন্তু মন থেকে আসে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরনের জন্যে আমরা মেয়র সাদেক হোসেন খোকার প্রশংসা করেছি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন ওই নামকরনের উদ্যোগটি সফল হয়নি। মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়নি সেই সব নামকরন। কারন ওই নামকরন অনুষ্ঠানের সামিয়ানার নীচেও মানুষ রাজাকারদের দেখেছে। রাজাকারদের রক্ষা কবজ দল হিসাবে যেহেতু বিএনপির জন্ম এবং বিকাশ সেখানে সাদেক হোসেন খোকার অংশগ্রহন একটি মোটাদাগের বিচ্যুতি। রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রাস্তার নামকরনের উদ্যোগ সফল হয়না। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান যেখানে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার রক্তের সঙ্গে মিশেছিল সেখানে প্রাণের শ্লোগান দুটি বর্জন করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। জাতির জনককে হত্যার পর তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে পুরনো ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষনের মাইক কেড়ে নিয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। এভাবে তিনি তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের অবমাননা করেছিলেন।
সবাই জানেন সাদেক হোসেন খোকা আমেরিকায় বেড়াতে যাননি। তাঁর সর্বশেষ শপথ ছিল শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এরজন্যে আমেরিকায় বসে তাঁর টেলিফোনে কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হয়। দেশে দুর্নীতির মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। কিন্তু ততোক্ষনে মরনব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে তাঁর লড়াই শুরু হয়ে যায়। ক্যান্সারের চিকিৎসা সারা পৃথিবীতে খুবই ব্যয়বহুল। আমেরিকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা কেন্দ্রে তাঁর সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয়েছে। তাঁর চিকিৎসার জন্যে কারও কাছে হাত পাততে হয়নি। এটি তাঁর জন্যে স্বস্তিকর। কারন তাঁর অনেক সহযোদ্ধার মতো একজন দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাঁর শেষ দিনগুলো অতিবাহিত হয়নি। আমেরিকায় তাঁর ভিসা স্ট্যাটাস যাই হোক তাঁর শেষ সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সরকার। পুরো বাংলাদেশ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। যার যা মূল্যায়ন হোক দিনশেষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা মুক্তিযোদ্ধার পাশেই দাঁড়ায়। একটা কষ্ট থেকে গেলো খোকা ভাই, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে আপনার উত্থান ঘটেছিল। পতন ঘটলো পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগানে! একাত্তরের যে কোন লড়াকু যোদ্ধার এমন আত্মস্বীকৃত পরিণতি বেদনার। অর্থনৈতিক কারনে বিদেশের নানা দেশে অনেকে নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট করেন। কিন্তু আপনিতো আর দশজনের মতো আমজনতা নন। আপনি একাত্তরের লড়াকু যোদ্ধা। এই যুদ্ধটা আমেরিকার বিরুদ্ধেও ছিল। সেই আমেরিকার কাছে সবুজ পাসপোর্ট সারেন্ডার করা অবস্থায় মারা গেছেন মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা। এমন পরিণতি দূর্ভাগ্য যাতে আর কোন মুক্তিযোদ্ধার জীবনে না আসে। ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়া স্বত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ দেশে আনতে সহায়তার জন্যে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
Related Articles
Diversity
Diversity is often preached as quite a simple process which simply requires an immigrant coming from a foreign land with
সবাই আমার ভালবাসা চায়
করিম আলী’র ডুব সাঁতার – সবাই আমার ভালবাসা চায় [করিম আলী’র ডুব সাঁতার – আমার নামে লেখা হলেও, কথা গুলো
এভরি ক্লাউড হ্যাজ এ সিলভার লাইনিং
আমার খুব পছন্দের একটি ইংরেজি ফ্রেজ হলো আমার আজকের লেখাটির শিরোনাম। সাদা বাংলায় বলা যায়, খুব খারাপ অবস্থার মধ্যেও থাকে
খুব ভালো লাগলো ??
অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম।