বহে যায় দিন – একবার যেতে দে না আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়
> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >
।। চার ।। একবার যেতে দে না আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়
১৯৯১ সালের জুলাই মাসে সবকিছু উপেক্ষা করে এই ক্যানবেরার পাট চুকিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম দেশে । উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকায় ফিরে গিয়ে আমার স্ত্রী ও আমি দু’জনে দুটো চাকুরী পাবো এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করবো ।
ঢাকায় ফিরে আমার স্ত্রী এবং আমি চাকুরী নামক সোনার হরিণ খুঁজতে থাকি সম্ভাব্য সকল জায়গায়। প্রায় সাত বছর এখানে এই ক্যানবেরাতে থাকায় অনেক সম্পর্ক ফিকে হয়ে গেছে, যেমন শীতের সকালে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পরে ফিকে হয়ে যায় ভোরের নরোম রোদ । তাছাড়া এই সময়ে চেনা মুখ অচেনা হয়ে গেছে । এমন কি আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব সবার সঙ্গে যোগাযোগের সুতোও মলিন হয়ে গেছে । যাকে বলে, “আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড ।’
তবুও আমার স্ত্রী এবং আমি মাঝে মাঝে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পুরোনো ডিপার্টমেন্টে যেতাম । এখানে বলা আবশ্যক যে, আমার স্ত্রী উইনরক ইন্টারন্যাশানেল-এর স্কলারশীপ নিয়ে অষ্ট্ৰেলিয়ান ন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করার জন্য ক্যানবেরায় আসার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক ছিলেন । আমরা স্যারদের রুমে বসে গল্প করতাম, আলোচনা করতাম নানান বিষয়ের উপর। খোঁজ-খবর নিতাম ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক/শিক্ষিকার ঘাটতি নিয়ে। তাছাড়া অন্যান্য অনেক জায়গায় খোঁজ-খবর নিয়েছিলাম । কোথাও কোথাও আবার বায়োডাটা দিয়েছিলাম ।
একদিন আমি ডিপার্টমেন্টে এক সিনিয়র স্যারের রুমে বসে গল্প করছিলাম। রুমে তখন অন্য কেউ ছিলো না। এ-কথা সে-কথা বলার এক ফাঁকে স্যার জানতে চাইলেন আমার প্ল্যান কি ? আমি সরাসরি স্যারকে বললাম, “এই মুহূর্তে একটা চাকুরী খুব দরকার ।”
স্যার একটু নড়েচড়ে বসলেন । তারপর বললেন, ‘ডিপার্টমেন্টে কোনো পার্মানেন্ট পজিশন নেই । তবে অস্থায়ী একটা পজিশন ক্রিয়েট করে সেই পজিশনটা তোমাকে দিতে পারি । তবে একটা কন্ডিশন । তা হলো তোমাকে টিচার পলিটিক্সে ইভলভ হতে হবে।’
আমি কিছুটা চমকে, থমকে গিয়েছিলাম । সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো একপাল বনা ঘোড়া প্রচন্ড শব্দ তুলে দৌড়ে চলে এলো মাথার মধ্যিখানে । আর সেই ক্ষুরের শব্দে মাথাটা আমার ভীষণ ঝিমঝিম করছিলো । কপালের দু’পাশের শিরা দু’টো বাউন্সিং বলের মতো লাফাচ্ছিলো।
এক মিনিটের মতো সময় নিয়ে আমি নিজেকে যতোটুকু সম্ভব স্বাভাবিক করে বললাম,
“স্যার, আপনি তো ভালো করেই জানেন আমি ছাত্র জীবনে একটু আধটু রাজনীতির সঙ্গে
জড়িত ছিলাম । এক সময় শহীদুল্লাহ হলে ইলেকশনও করেছি এবং ইলেকটেডও হয়েছি । তবে রাজনীতির সাথে কোনোদিনও নিজেকে গভীরভাবে জড়াইনি কিংবা রাজনীতিকে আপন করে নিতে পারিনি । যেদিন রাজনীতির কুৎসিত চেহারা আমার সামনে বেরিয়ে এলো, সেদিন থেকেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি । তারপর আর কোনোদিনও রাজনীতি আমাকে গভীরভাবে কাছে টানতে পারেনি ।
কিছুক্ষণ স্যার কি যেনো ভাবলেন মুখটা গম্ভীর করে । তারপর বললেন, “তবে টিকে থাকার জন্য এদেশে রাজনীতি হলো জীবনের একটা অংশ । বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যেমন ভাত-কাপড় আর বাসস্থানের প্রয়োজন, ঠিক তেমনই এগুলো পাবার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন । এখানে রাজনীতি বাদ দিয়ে জীবন চলে না, চলতে পারে না । রাজনীতিবিহীন জীবন বিদেশে চলে । কেনোনা অই সব দেশের সাধারণ জনগনের জন্য রয়েছে সরকার। আমাদের দেশে সরকার আছে নিজেদের জন্য, জনগণের জন্য নয় । ”
“তবুও স্যার ছাত্র হিসেবে রাজনীতি করা যায়, কিন্তু শিক্ষক হয়ে ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি করা বোধহয় উচিত নয় । সরি, আমি পারবো না।” বলেই জবাবের অপেক্ষা না করে কোনোরকম সালাম জানিয়ে প্রায় এক দৌড়ে বেড়িয়ে আসি রুম থেকে। আমার সারা শরীর তখনও শিরশির করে কাঁপছিলো । একবার ফিরেও তাকাইনি ।
সেই সময় অনেকে আমাদের আশার বাণী শুনিয়েছেন, শুকনো ঠোটের ফাঁকে চুক চুক শব্দ করে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন, আবার কেউ মুখের ওপর সরাসরি না-ই করেছেন । ফ্রাশটেশন নামক ঘুণপোকা যখন আমাদের দু’জনকেই নিঃশব্দে কুরে কুরে খাচ্ছিলো, তখনই আমরা ভেবে-চিন্তে ডিসিশন নিই আবার সপরিবারে ফিরে আসবো ক্যানবেরায় । এক সপ্তাহের মধ্যে ইমিগ্রেশনের ফর্ম এনে ফিল-আপ করে জমা দেবার পর মাস দেড়েকের ভেতর কোনো ঝুট ঝামেলা ছাড়াই আমাদের ইমিগ্রেশন হয়ে যায় ।
সেই সময় আমার এক কাজিন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন জাদরেল সিনিয়র মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি বর্তমানেও মন্ত্রী আছেন । প্রধান মন্ত্রীর ডান হাত বলা যায় অনায়াসে । সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে পর আমি একদিন আমার বড় ভাইকে, যিনি সেই সময় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন এবং এখনও আছেন, বললাম যে আমরা ইমিগ্রেশন নিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছি অস্ট্রেলিয়ায় । উনি শোনার পর খানিকটা সময় কিছু একটা ভাবলেন । তারপর গলার স্বরটাকে ভারী করে বললেন, “তোমার চাকুরীর প্রয়োজন, আমাকে বলোনি কেনো ?
সেই মুহূর্তে আমি যেনো পোকায় খাওয়া ফলের মতো টুপ করে গাছ থেকে পড়লাম । ব্যথা পেয়েছিলাম বড় ভাইয়ের কথায় । আমি জানতাম, উনি নিজে অথবা কাজিনকে দিয়ে যেকোনো জায়গায় আমাদের দু’জনকেই দু’টো চাকুরী দিতে পারেন । আমি কিছু না বলে মাথা নীচু করে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করেই বললাম, ‘আমাদের চাকুরীর দরকার নেই । কেনো না, যেখানে সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকুরী পাওয়া যায় না, পেতে হলে ধরাধরি করতে হয়, সেখানে চাকুরী করার ইচ্ছে নেই।’
বড় ভাই গোল গোল চোখ তুলে কয়েক মিনিট অবাক তাকিয়ে দেখলেন আমাকে, যেনো এই প্রথম আমাদের পরিচয় । এক সময় আস্তে করে শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বোঝো।”
আমরা জানি অনিশ্চিয়তার জীবন থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছি । তবুও আমাদের হৃদয়ের গভীরে শেকড়ের টান যে আলগা হয়ে যাচ্ছে, আমরা তা স্পষ্টই টের পাচ্ছিলাম । সেদিন আমি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় কাউকেই বলতে পারেনি, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাবো।’
এই অধ্যায়ের নামকরন করেছি ‘একবার যেতে দে না আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয় । সেই সুযোগ পেয়েছিলাম । কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আর নিজের বিবেকের কাছে পরাজিত না হয়ে শেষতক ধরে রাখতে পারিনি । অথবা খানিকটা ঘুরিয়ে বলা যায়, আমাকে ধরে রাখতে দেয়নি । তাইতো আবার ফিরে এসেছি এই ক্যানবেরায় ।
(চলবে)বহে যায় দিন
আফজল হোসেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >
Related Articles
Excellence in dancing – Arpita Shome Choudhury
Dance, the supreme art form which skillfully embodies the three primary ingredients- BHAVAM, RAGAM and THALAM fascinated her right from
পচিঁশে ফেব্রুয়ারী- ঘটনা বিশ্লেষন
পচিঁশে ফেব্রুয়ারী। দেশে একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল। কাপুরুষ ঘাতকেরা কেড়ে নিলো একঝাক সোনালী সন্তান। ছেলে হাড়া মায়ের আহাজ়ারী দেখি,
মেলবোর্নের চিঠি – ২
মেলবোর্নের চিঠি – ১ বাংলাদেশে আমার চাকরী জীবন, ছাত্র অবস্থা এবং পরবর্তী সব মিলিয়ে প্রায় এক যুগ। দেশ ছেড়ে আসার