রবিবারের মধ্যে করোনা রোগীদের জাহাজকে অস্ট্রেলিয়া ছাড়তে হবে
ফজলুল বারী: অস্ট্রেলিয়ায় করোনা ভাইরাসের এপিক সেন্টার হয়েছে রুবি প্রিন্সেস নামের একটি প্রমোদতরী। এই এক জাহাজ থেকে ছড়িয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যক কভিড নাইন্টিনের রোগী! অস্ট্রেলিয়ায় এই মহামারীতে এখন পর্যন্ত যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে এরমধ্যে ১৮ জনই রুবি প্রিন্সেসের যাত্রী। কিভাবে এক জাহাজ থেকে এতো করোনা রোগী ছড়ালো তা নিয়ে তদন্ত করছে অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের পুলিশ। আটক করা হয়েছে জাহাজের ব্ল্যাক বক্স। নেয়া হয়েছে নানান রাসায়নিক প্রমানাদি। পুলিশ বলেছে এই তদন্ত শেষ হতে পাঁচ মাস সময় লাগতে পারে। জাহাজটিকে আগামী রবিবারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার জলসীমা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জাহাজটির আপাতত গন্তব্য হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৫০ দেশের এক হাজারের বেশি ক্রু আছেন রুবি প্রিন্সেসে।
নিউজিল্যান্ডের নেপিয়ার ঘুরে গত মার্চে রুবি প্রিন্সেস যখন সিডনির আন্তর্জাতিক জাহাজ টার্মিনালে পৌঁছে তখন আঠার তলার প্রমোদতরী রুবি প্রিন্সেসে যাত্রী ছিলেন ২৭০০ জন। বিভিন্ন সময়ে এর ১৭০০’র মতো যাত্রী নেমেছেন সিডনিতে। তখন থেকেই এই জাহাজে থাকা অথবা জাহাজ থেমে নামলেই করোনা সংক্রমনে রুবির নাম আসছে অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায়। স্বপ্নের প্রমোদতরীর নাম দিনে দিনে ভিলেনে পরিণত হয়। আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশ এই জাহাজে থাকা যার যার দেশের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। তাদের একজন মার্কিন নারী স্বদেশে ফেরার পর মারাও গেছেন।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড অথবা ইউরোপ আমেরিকার বয়স্ক মানুষেরা ভ্রমনের জন্যে এমন প্রমোদতরীর পছন্দ করেন। বাংলাদেশের বয়স্ক লোকজন টাকা জমিয়ে হজে যান। আর এসব দেশের বয়স্করা জমানো টাকায় একবারের জন্যে হলেও যান ক্রুজে! উন্নত জীবন বিনোদনের সব কিছুই এসব প্রমোদতরীতে রয়েছে। লাইব্রেরি, জিম, সুইমিংপুল, পোকার মেশিন, ক্যাসিনো, জুয়া কী নেই এসব ক্রুজে! সঙ্গে আনলিমিটেড মদ সহ পছন্দের সব খানাপিনা।
আমাকে সত্তুর্ধো এক পেনশনার এক বৃদ্ধা একবার বলেছিলেন, এমন ক্রুজে উঠলেই তার নিজেকে রানী এলিজাবেথ মনে হয়। যে কোন কিছু চাইতেই বান্দা হাজির। কিন্তু মড়ার এই করোনা মহামারী যেহেতু বয়স্ক মানুষকেই বেশি পছন্দ করে, তাই এমন রুবির মতো প্রমোদতরীই যেন এর টার্গেট হয়েছে! রুবিরও নাম হয়ে গেছে করোনার জাহাজ। এক জাহাজ ভর্তি করোনা রোগী! রুবিকে নিয়ে ভীতি তৈরি হলে জাহাজটিকে সিডনি থেকে সরিয়ে একশ কিঃমিঃ দূরের পোর্ট কেম্বলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও জাহাজটি নিয়ে চলে হৈচৈ প্রতিবাদ।
রুবির লোকজন যাতে সেখানে না নামতে পারেন এ নিয়ে পাহারা বসায় পোর্ট কেম্বলার লোকজন। তারা বলেন তাদের হাসপাতাল ছোট। এতো করোনা রোগী সেখানে রাখার জায়গা নেই। কিন্তু যখন যিনি মুমুর্ষ হয়েছেন তাকেতো চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। মূলত রুবিকে পোর্ট কেম্বলার গভীর সমুদ্রে নোঙর করা অবস্থায় আটকে রেখে জাহাজটির করোনা ছড়ানোর ফৌজদারি তদন্ত করেছে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ। তদন্তে ধারনা হয়েছে জাহাজে খাবার সরবরাহকারী কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাধ্যমে করোনা নোঙর করেছে রুবিতে। এরপর তা ছড়ায় জাহাজের ক্রুদের মধ্যে। তাদের থেকে সংক্রমন হয় যাত্রীদের মধ্যে। সেই থেকে রুবি স্বজনহারাদের কান্নার নাম। অস্ট্রেলিয়ায় করোনায় মারা গেছেন ৬৩ জন। এর ১৮ জনই ছিলেন রুবির যাত্রী। এদের সবাই বয়স্কা নারী-পুরুষ।
উল্লেখ্য গত জানুয়ারিতে প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এই মহাদেশের সমাজ বহজাতিক। একেতো ব্রিটিশ কলোনী, এরপর আবার যে দেশে যুদ্ধ-গৃহযুদ্ধ ছিল, যে সব দেশে সমাজতন্ত্র ছিল সে সব দেশের লোকজন অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় পেয়েছেন। সে কারনে চীনা বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান বিস্তর আছেন অস্ট্রেলিয়ায়। ব্যবসা বানিজ্যের বড় অংশও চীনাদের হাতে। তেমন একজন চীনা বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান এক বৃ্দ্ধের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় করোনা পৌঁছতে সময় লাগেনি। কিন্তু এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সুসংগঠিত। তাই অস্ট্রেলিয়ায় করোনা টেস্টের হারও বিশ্বে সর্বোচ্চ। আড়াই কোটি মানুষের দেশে করোনা টেস্ট হয়েছে সাড়ে তিন লক্ষের বেশি মানুষের। এর ৯৮ শতাংশই নেগেটিভ এসেছে।
শুরুতে মাস্ক নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়ও সমস্যা হয়েছে। কারন সর্বশেষ দাবানলের ধোয়ার সময় দেশের এত মানুষকে মাস্ক ব্যবহার করতে হয়েছে যে তখনই এর মজুত ফুরিয়ে যায়। অতঃপর এই মাস্ক-পিপিই সংগ্রহে শুরুতে অস্ট্রেলিয়াকে হাপ্যিতাশ করতে হয়েছে। মূলত চীন পরিস্থিতি সামলে ওঠার পর সারা পৃথিবীর নানাজনের মতো করোনা যুদ্ধের উপকরনাদি সংগ্রহ অস্ট্রেলিয়ার জন্যেও সহজ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার নানা চাকরিতে প্রাথমিক চিকিৎসা সহ নানা প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক। এসব প্রশিক্ষনের মূল কথা আগে নিজেকে নিরাপদ রাখুন, পরে অন্যকে নিরাপদ করতে সহায়তা করুন। অস্ট্রেলিয়ার এসব প্রস্তুতি করোনা যুদ্ধের সহায়ক হয়েছে।
এ ছাড়া নার্সিং ও প্যারামেডিকসের কুড়ি হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীকে এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবার মূলধারায় নিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। আড়াই কোটি মানুষের দেশ হলেও এদেশের হাসপাতালগুলোর আইসিইউ সহ নানা সুযোগ সুবিধা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এখন যে এসবের সুযোগ সুবিধা আরো বাড়ানো হচ্ছে এসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও সুসংঠিত করার অংশ হিসাবেই দেখা হচ্ছে।
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া দু’জনের বেশি সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুই এখন বন্ধ। ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। মসজিদ-গির্জা সবখানে ঝুলছে তালা। সামাজিক দূ্রত্ব কড়াকড়িভাবে সবাই মানেন অথবা মানতে বাধ্য করা হয়েছে। এরজন্যে জরিমানা যাদের হয়েছে তাদের গুনতে হয়েছে ১৬৫২ ডলার। বিদেশ থেকে যে সব অস্ট্রেলিয়ান এখন দেশে ফিরে আসছেন তাদেরকে নিজ খরচে এখন বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারিন্টানে কোন একটি হোটেলে থাকতে হয়। এসব কড়াকড়ির কারনে নতুন সংক্রমন কমে এসেছে অস্ট্রেলিয়ায়। এখন দিনে নতুন রোগী পাওয়া যাচ্ছে ৫০ জনের কম। কিন্তু এরপরও বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে সামাজিক দূরত্বের কড়াকড়ি চলবে আরও চার সপ্তাহ। অস্ট্রেলিয়ায় এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে কোন বাংলাদেশি আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে আসা ছাত্রছাত্রীর সহ পঞ্চাশ হাজারের মতো বাংলাদেশি আছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
Related Articles
Analysis on AL BNP Local Election in Bangladesh
আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, শরিকদের মুচকি হাসি, বিএনপিতে আশার আলো !! চিটাগাঙয়ে- আওয়ামী লীগের বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দাড় করিয়ে
Dancing is my passion – Purabi Permita Bose
Purabi Permita Bose a very well-known person as a Bangladeshi traditional dancer in Sydney community. She got her first lesson
প্রিয় – অস্ট্রেলিয়ার নিকট থেকে একুশে সংকলন ২০১০ পেতে পারি কি?
প্রচারবিমুখতা আমার স্বভাবসিদ্ধ একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেশ -বিদেশে বিচরণ করি , পশ্চিমা শিক্ষায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলি