রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরাট বিজয়

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরাট বিজয়

ফজলুল বারী: আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে দেয়া প্রাথমিক আদেশে বাংলাদেশের অবস্থানের বিজয় সূচিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক আদালত তাদের অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছে। আদেশে আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলেছে, মিয়ানমার সরকার বেসামরিক রোহিঙ্গা নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক আদালত বলেছে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা চালাতে পারবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় দায়ী সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, গণহত্যার আলামত নষ্ট না করা, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় মিয়ানমার সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা চার মাস পরপর প্রতিবেদন আকারে আন্তর্জাতিক আদালতকে জানাতে হবে।  এমন চারটি  অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। এই আদেশের অপেক্ষায় যারা ছিলেন প্রথম পর্যায়েও তারা এতোটা আশা করেননি। গাম্বিয়াকে কৃতজ্ঞতা। আফ্রিকার ছোট দেশটি বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্যে ঋনী করে ফেললো।

 এসব আদেশের ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানের বিজয় হলো। বাংলাদেশকে এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চ্যানেলে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। আরেকটা সত্য বাস্তব যেন বাংলাদেশ ভুলে না যায়। তাহলো চীন-ভারতের সমর্থন পুষ্ট মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক আদালতের সঙ্গেও প্রতারনামূলক আচরন চালাতে পারে। এই মূহুর্তে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। কিন্তু ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে নেই। কারন ভারতের চলতি হিন্দুত্ববাদী সরকারের কাছে রোহিঙ্গারা মুসলিম। রোহিঙ্গাদের জন্যে ভারত বাংলাদেশকে চাল-তেল দিতে রাজি। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ দিতে রাজি নয়। চীনের সঙ্গে চমৎকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিরাজমান। কিন্তু বাংলাদেশের চাইতে মিয়ানমারকে অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি গুরুত্ব দেয় চীন। সে জন্যে আন্তর্জাতিক আদালতের শুনানি শুরুর আগ মূহুর্তে মিয়ানমার সফর করে  চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী তাদেরকে আশ্বস্ত করেন। আর আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশের আগ মূহুর্তে মিয়ানমার সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট। এসব কিন্তু কূটনৈতিক বার্তা দেয়। কাজেই আন্তর্জাতিক আদালতের অনুকূল অন্তর্বর্তী আদেশ স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের যেটা এখন মাথায় রাখতে হবে তাহলো,  রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও ঝুলে থাকতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশও ঠেলে-ধাক্কা দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করতে পারবেনা।

এবারে কিন্তু শুরুতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহন করতে চায়নি। কিন্তু জীবন বাঁচাতে পলায়নপর রোহিঙ্গা নারী-শিশু যেভাবে সমুদ্রে ডুবে মারা যাচ্ছিলেন, ওই অবস্থায় ওই ঢল প্রতিহত করা সম্ভব ছিলোনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নে রেজোয়ান সিদ্দিক ববির স্ত্রী বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক আবাসিক কর্মকর্তা। মূলত তিনিই শরণার্থীদের সীমান্তে গ্রহণ করছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনাকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন বিদেশে শরণার্থী জীবন কাটিয়েছেন শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা। তাঁদের সন্তানেরা শরণার্থী শিশু হিসাবেই বড় হয়েছেন। আর বাংলাদেশ নিজেই একটি শরণার্থী জাতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে শরণার্থী হন। এসব বিষয় বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় পেতে সহায়ক হয়।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘ একটি এলাকার পাহাড়-পরিবেশ ধংস হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের জীবন নানা সংকটের সম্মুখিন। সংকটের মুখে পড়েছে পর্যটন শিল্প। কিন্তু বিজ্ঞানী নিউটনের তৃতীয় সূত্র প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার মতো রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ বিরল আন্তর্জাতিক গুরুত্বের আসনে আসীন হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশ এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের কিভাবে আশ্রয় দিলো এটিও এখন আন্তর্জাতিক বিস্ময়ের বিষয়। আন্তর্জাতিক শান্তিবাদীরা নিয়মিত বাংলাদেশ সফরে আসছেন।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ এখন এমন কিছু আন্তর্জাতিক ফোরামে দাওয়াত পায় যা আগে কখনও পেতোনা। বাংলাদেশে ত্রান দুর্নীতি একটি মুখস্ত সত্য। বিধবা ভাতা-বয়স্ক ভাতা নিয়েও নিয়মিত দুর্নীতি হয়। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রান নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেনি! বাংলাদেশ এক্ষেত্রেও ভিন্ন এক দক্ষতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে ভূমিকা পালন করে দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ম্যানেজমেন্টেও পালন করছে একই দক্ষতার ভূমিকা।

লাখ লাখ বিপন্ন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে তাদের জীবনরক্ষার জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও কৃতজ্ঞতা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর সব উদ্যোগ ঠিক আছে। ভুল পদক্ষেপটি হলো বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে প্রত্যাবাসন শুরুর অলীক স্বপ্ন দেখেছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ভুল বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সাহেব অনুসরন করছেননা এটি ভালো দিক। গাম্বিয়া মামলা চালানোর কাজ করুক, বাংলাদেশের দরকার শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর কাজে গুরুত্ব দেয়া। যত বিশিষ্ট ব্যক্তি শরণার্থীদের দেখতে আসবেন তাদের বলতে হবে সঙ্গে কিছু নিয়ে যান। রোহিঙ্গারা যদি নিজে নিজে অন্য কোন দেশে চলে যেতে চায়, সে ব্যাপারেও সহযোগিতার পথ বের করতে হবে। এসব প্রতিটি পদক্ষেপে রাখতে হবে রোহিঙ্গা প্রতিনিধির অন্তর্ভূক্তি। কোন কিছু তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া যাবেনা। চাপিয়ে দিতে গেলে বাংলাদেশে এতোদিন যত ইতিবাচক কাজ করেছে সেখানে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। সে কারনে এখন থেকে বাংলাদেশের সব পদক্ষেপ হতে হবে আরও বেশি দক্ষ এবং পরিশীলিত।


Place your ads here!

Related Articles

Begum Zia: Are You Missing the Last Train for Democracy?

Dear Begum Zia, I stood up against the unethical minus activities that took place against you and Shaikh Hasina because

Migration (Ovibashon)

অভিবাসন বাংলাদেশিদের পরবাসী হওয়ার পেছনে নানা কারণ জড়িয়ে আছে। কারও বেলায় শুধু একটি কারণ, আবার অনেকের বেলায় একাধিক কারণ কাজ

Sunil’s passing; the legend will live on

These are sad days for Bangla literature, barely two months after the death of Humayun Ahmed we have to now

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment