হিমু ভাবনা: সব কটা জানালা খুলে দাও না (ধ্রুপদ)

ডঃ মোহাম্মদ শহিদুর রশিদ ভূইয়াঁ ছিলেন শেরে বাংলা এগ্রিকালচার উনিভার্সিটির জেনেটিক্স ও প্লেন্ট ব্রিডিং এর প্রফেসর। উনি ফুল ও এর বিবিধ সৌন্দর্য নিয়ে একটা চমৎকার বই লিখেছিলেন। নাম “ পুষ্প কথা “. ফুলের মাহাত্য ও সৌন্দর্যে উনি খুব আন্দলিত ছিলেন। আবেগী ছিলেন। আমাদের জীবনে ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্যের অপরিহার্যতা উপস্থাপন করার জন্য উনি বইয়ের শুরুতেই আমাদের নবীজির একটা কথা কোট করেছিলেন। আমরা বোধকরি সবাই এই কথাটা ছোট বেলাতে শুনে এসেছি। আমাদের নবীজি বলে ছিলেন
“ জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিও ক্ষুদার লাগি
দুটি যদি জোটে
অর্ধেকে ফুল কিনে নিয়ো হে অনুরাগী “
হাসি -কান্না , আনন্দ- বিষাদ ইত্যাদি সব কিছুতেই আমরা ফুলের ব্যাপক আয়োজন দেখি। ফুল দুঃখের সময় দুঃখ লাঘবের উপাদান আর সুখের সময় আকণ্ঠ সুখের নিদির্শন। আমরা ব্যাপক সমারোহে ফুলের বাগান করি। গাছথেকে কেটে এনে তাজা ফুলে সাজাই ঘর। ফুলের বিবিধ রঙে মন হয় রঙিন , সুঘ্রাণে হয় বিভোর।
দুটো পয়সা জুটলে একটা দিয়ে খাদ্য কিনলাম আর অন্যটা দিয়ে ফুল কিনলাম। কিন্তু তিন , চার বা ভাগ্যক্রমে যদি ৫ পয়সা জুটে তবে তা দিয়ে কি করবো ? যদি বলি এর একটি পয়সা হয়তোবা আমরা খুব নির্দ্বিধায় খরচ করবো সংগীত , শিল্প ও সাহিত্যে চর্চাতে তবে কি খুব ভুল বলা হবে ?
ফুল যেভাবে আমাদের পরিবেশ ও মনের উপর প্রভাব ফেলে, গান ও কি তা করে না ? করে। তবে ব্যবধানটা হলো ফুল ধরা যায় , ছোঁয়া যায়। ফুলের ঘ্রান নেয়া যায়। আর গানটা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়।
আজ টেলর স্কুলের স্বল্পপরিসরের মিলনায়তনে ধ্রুপদের ১৪তম জলসা অনুষ্ঠান হলো। ধ্রুপদের সৃষ্টি সেই কিছুকাল আগে। সবসময় দাওয়াত পাই কিন্তু বিবিধ কারণে যাওয়া হয়ে উঠে না। এই অনুষ্ঠানের ও দাওয়াত পেয়েছি ক দিন আগে। যাবো কি যাবোনা দ্বিধায় ছিলাম। টুনির নিতান্ত ইচ্ছা ও আয়োজকদের পীড়াপীড়িতে যাওয়ার মনস্থ করলাম।
অনুষ্ঠান শুরু হলো। গান গাইলেন রোজানা আজাদ ও শাফিনাজ আমীন মুক্তি। আধুনিক , নজরুল , রবীন্দ্র মিলিয়ে বেশকটা গান হলো। হলো “জন্ম আমার ধন্য হলো “ প্রানো ভরিয়ে “ শুধু তোমার বাণী নয়গো “ আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন”। আরও হলো “ আমার হিয়ার মাঝে “ সকল গর্ব “ দৃষ্টি আমন্ত্রণ “ . গানের কোমল পরশ হৃদয়ে উষ্ণতা ছড়ালো। শরীর ও মনে আঁকড়ে থাকা ক্যানবেরার অগ্রগামী শীতকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলো।
মুক্তি এর পর গাইলো “ সব কটা জানালা খুলে দাওনা , আমি গাইবো গাইবো হৃদয়েরও গান “. হটাৎ কেমন যেন আমার সমস্ত অস্তিত্ব নাড়া দিয়ে উঠলো ! আমি বাকরুদ্ধ হলাম। এই গানটা শুনে শুনে আমি /আমরা সবাই বড় হয়েছি। বি. টি. ভির ৮ টার খবর , ১০ টার খবরের শুরুতে কত কত হাজার বার শুনেছি। কিন্তু কখনো গানটাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি কি? গানের কথা ও মানে কি মনকে একটুও নাড়া দিয়েছে ? না দেয়নি। মুক্তি যখন গাইলো
“চোখ থেকে মুছে ফেলো অশ্রু টুকু,
এমন খুশির দিনে কাদতে নেই. . .
হারানো সৃতির, বেদনাতে, একাকার করে মন রাখতে নেই. . .
ওরা আসবে চুপি চুপি,
কেউ যেন ভুল করে গেওনাকো মন ভাঙ্গা গান . . .”
তখন গলায় কেমন একটা দলা অনুভব করলাম। গানের উষ্ণ পরশে হৃদয়ের জমাট যত বরফ গলে চোখের কোন এসে ভর করলো। মুক্তি যুদ্ধের নাম নাযানা যত অচেনা শহীদদের জন্য আমার আবেগের বাঁধ ভেঙ্গে পড়লো। ক ফোটা উষ্ণ রোদন চশমার লেন্সকে করলো ঝাপসা। আলগোছে লোকচক্ষুর আড়ালে, খুব শান্তির্পনে চোখদুটো মুছে নিলাম। মনে মনে অভিসম্পাত দিলাম আয়োজকদের। উনারা অনুষ্ঠান চলাকালীন হলের আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। আলোর মধ্যে আনন্দের , সুখের , একেবারে র কোনো অনুভূতির অশ্রু কি ফেলা যায় ? কষ্টের কান্না হয় লোকারণ্য। সুখের কান্না , আনন্দের কান্না , কাঁচা কোনো আবেগের কান্না হয় আড়ালে , নিভৃতে !
মুক্তি ও রোজানা দুজনে মিলিয়ে ২৩ টার মতো গান করলো। সবগুলো গানই কম বেশি মন কে ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু বহু দিন পরে এই পান্ডব দেশে “ সব কটা জানালা খুলে দাও না “ আমার মনের দুয়ার খুলে দিয়েছে। মুক্তি যুদ্ধের শহীদের জন্য আবেগে মন আপ্লুত হয়েছে, শ্রদ্ধায় মাথা হয়েছে নত। মুক্তিযুদ্ধের যত শহীদের বিনম্র শ্রদ্ধা !
আমার বয়স বেড়েছে। এখন গান শুধুই তাল আর সুরের জন্য শুনিনা , শুনি কথার জন্যও। অনুভব করি হৃদয় দিয়েও।
গান হোক পরিবর্তনের হাতিয়ার।লাখো শহীদের রক্তে ভেজা উর্বর মাটিতে গনতন্তের সুদৃঢ় শিকড় প্রতিষ্ঠিত হোক।
অনুষ্ঠানের শিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রী ও কলাকুশলীদের দের একটা সুন্দর আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ। যদি বড় মাপের কোনো শিল্পী হতাম তবে কি আয়োজকদের উদ্দেশে গাইতাম
“হয়তোবা (ক্যানবেরার বাংলাভাষীদের ) ইতিহাসে তোমাদের নাম লিখা রবেনা ,
বড় বড় লোকেদের ভিড়ে , গ্যানী আর গুণীদের আসরে
তোমাদের কথা কেউ কবে না “
কিন্তু আমার মতো ছিন্নমূল হিমুরা , যারা বাংলা গান কে ভালোবাসে , দেশের কাদামাটির মাটির গন্ধে আকুল হয় , দেশের ভালোবাসায় আপ্লুত হয় তারা আপনাদের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাবে। চিরকাল !
“আজ আমি সারা নিশি থাকবো জেগে
ঘরের আলো সব আধার করে. . .
ছড়িয়ে রাখো, অত্তর গোলাপ, এদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে. . .
ওরা আসবে চুপি চুপি,
কেউ যেন ভুল করে গেওনাকো মন ভাঙ্গা গান . . .
সব কটা জানালা খুলে দাও না,
আমি গাইবো গাইবো বিজয়ের গান…
ওরা আসবে চুপি চুপি,
যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে) গেছে প্রাণ
সব কটা জানালা খুলে দাও না”
হিমু /ক্যানবেরা
৩০ মার্চ ২০১৯
Related Articles
প্রেক্ষাপটঃ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এবং “একুশে’র বিশ্বায়ন” (তৃতীয় পর্ব)
এসফিল্ড হ্যারিটেজ পার্কে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” নির্মাণের প্রস্তাবিত নির্ধারিত স্থান থেকে প্রায় একশ’ মিটারের মধ্যে মাতৃভাষা সংরক্ষণ বিষয়ক ব্যতিক্রমী
Why should Begum Khaleda and Sheikh Hasina talk to each other?
A series of articles have appeared in the newspapers recently on the proposed dialogue face- to-face between the two former
শাগানে, আমার শাগানে
সের্গেই ইয়েসেনিন্ (১৮৯৫-১৯২৫) মূল রুশ থেকে অনুবাদ দিলরুবা শাহানা (অনুবাদকের ভাষ্য: রুশ কবি সের্গেই ইয়েসেনিন রাশিয়ার রিয়াজন প্রদেশের এক সাধারন