আমাদের মোনাজাতউদ্দিন

আমাদের মোনাজাতউদ্দিন

ফজলুল বারী: আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাংবাদিকদের কাছে মোনাজাতউদ্দিনের নাম-খ্যাতি শুনি। আমাকে তাদের অনেকে বলেন আমার কাজটা নাকি অনেকটা মোনাজাতউদ্দিনের মতো। পার্থক্য শুধু মোনাজাতউদ্দিন যানবাহন ব্যবহার করেন। আমি করিনা। ওই সময়ে আমি রংপুর যখন পৌঁছি তখন মোনাজাত ভাই’র খোঁজ করি। কিন্তু তিনি তখন রংপুরে না থাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। মোনাজাত ভাই’র সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ঢাকায় বিচিন্তা অফিসে। ৪১/২ দিলু রোডের সেই অফিসেই থাকতাম আমি। মোনাজাত ভাই আমাকে বলেন তিনি আমাকে দেখতে এসেছেন। কারন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাংবাদিকদের কাছে তিনি আমার কথা শুনেছেন। তাঁর সেই কথায় আমার চোখে পানি চলে আসে। যিনি আমার স্বপ্নপুরুষ সাংবাদিক তিনিই নাকি দেখতে এসেছেন আমাকে! আমি মোনাজাতউদ্দিনকে বলি, আমি তাকে আজ খাওয়াবো। আমরা সব রিপোর্টাররা তখন অফিসেই খাই। আমার সম্পাদক মিনার মাহমুদ আমাকে বলেন, আপনি মোনাজাত ভাইকে খাওয়াতে পারবেননা। কারন মোনাজাত ভাই যে কড়া বিষ খান তা আপনি দিতে পারবেননা। কড়া বিষটা কী তা আমি জিজ্ঞেস করিনা। আরেকদিন দেখা হবে কথা হবে বলে মিনার মাহমুদের সঙ্গে বেরিয়ে যান মোনাজাতউদ্দিন। সেই প্রথম দেখা।

মোনাজাত ভাই’র সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় মূলত প্রিয় প্রজন্ম অফিসে। ৭৬ সেগুনবাগিচার নীচতলায় বিশাল এক পাঁচকক্ষের অফিসে আমাদের প্রিয় প্রজন্ম অফিস। পত্রিকাটির প্রান পুরুষ প্রভাষ আমিন, রোকন রহমান, নঈম তারিকরা মূলত অফিসে থাকেন। এখানেও প্রতিদিন বাজার-রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। শুধু প্রিয় প্রজন্মের কর্মীরা না, ঢাকার অনেক সাংবাদিক-রাজনৈতিক কর্মীরাও অনেকে এখানে দুপুরে খেতে আসতেন। অফিস ভবনের মাঝখানটায় বড়সড় হলরূম। সেখানেই ডাইনিং কাম মিটিং টেবিল। ঢাকা এলে মোনাজাত ভাই দিনের বেশিরভাগ অংশ এই টেবিলটার দখল তাঁর কর্তৃ্ত্বে রাখতেন। সংবাদ অফিস কাছেই। তাই এখানেই বসে তিনি লিখতেন। আর শিক্ষকতা করতেন সাংবাদিকতার। প্রিয় প্রজন্মের কর্মী বাহিনীর সাংবাদিকতার শিক্ষক ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। আরেকজন ছিলেন। তিনি তখনও অতোটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। কিন্তু তাঁর ভিতরের আগুনছটা তখনি আমরা টের পেতাম। প্রিয় প্রজন্মের মাঝের দুটি পাতার কর্তৃ্ত্ব নিয়ে তিনি বের করতেন ‘অনু প্রজন্ম’। পত্রিকার ভিতর পত্রিকা! অনু প্রজন্মের সম্পাদক ছিলেন তিনিই। তিনি সঞ্জিব চৌধুরী। দলছুটের গায়ক হিসাবে তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা পান তাঁর অকাল মৃত্যুর পর। ভোরের কাগজের মেলা’ যেটি পরে  তুমুল জনপ্রিয় হয় এর ভিত্তি ছিল ‘অনু প্রজন্ম’।

প্রিয় প্রজন্মের জনপ্রিয় অংশ ছিল প্রিয় প্রজন্ম পার্লামেন্ট। রাজনীতিকরা এই পার্লামেন্টে এসে তুলোধুনো হতেন প্রিয় প্রজন্ম বাহিনীর প্রশ্নবানে। পার্লামেন্টের পুরো কার্যক্রম ছাপা হতো পত্রিকায়। সে জন্যে তুলোধুনো রাজনীতিকরা আর দ্বিতীয়বার এখানে আসতে চাইতেননা। মোনাজাতউদ্দিন, সঞ্জিব চৌধুরীও থাকতেন প্রিয় প্রজন্ম পার্লামেন্টে। মাঝে মাঝে এমন সরল প্রশ্নও তিনি করতেন যেন আজই সাংবাদিকতায় এসেছেন। এমন শিশু সুলভও ছিলেন আমাদের বিশাল দুই মানুষ মোনাজাউদ্দিন এবং সঞ্জিব চৌধুরী। আর্থিক কারনে প্রিয় প্রজন্ম বন্ধ হয়ে গেলে ভেঙ্গে যায় আমাদের সেই সংসার। এরপর আমি এখানে সেখানে অনেকদিন লিখেছি। এরমাঝে সাপ্তাহিক খবরের কাগজে মিডিয়া নিয়ে লিখতাম নিয়মিত।

 শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলের নেত্রী। একবার তাঁর সঙ্গে আমরা দহগ্রাম-অঙ্গারপোতা গেলাম। তিন বিঘা করিডোরের কারনে দহগ্রাম-অঙ্গারপোতা তখনও বিচ্ছিন্ন জনপদ। শেখ হাসিনার সেই বহরে তাঁর গাড়ির পিছনের গাড়িতেই ছিলাম আমি সহ কয়েক সাংবাদিক। বহরের শেষের দিকের একটি গাড়িতে ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। শেখ হাসিনা যাবেন এই খবর পেয়ে ভারতীয় বিএসএফ আগেই করিডোরের গেট খুলে রেখেছিল। বিএসএফ সেখানে শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দিতে চায়। নেত্রী গাড়ি থেকে নেমে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন তিনি ফেরার সময় গার্ড অব অনার নেবেন। তাঁর পিছনের গাড়িতেই থাকায় এই তথ্যটির আমরা সামনাসামনি স্বাক্ষী। কিন্তু মোনাজাত ভাই অনেক পিছনের গাড়িতে থাকায় আসল ঘটনা সম্ভবত বুঝতে পারেননি।

তাঁর পত্রিকায় এ নিয়ে তাঁর রিপোর্টের শিরোনাম হয়, ‘তিন বিঘা করিডোরের গেট বন্ধ থাকায় আটকে গেলো শেখ হাসিনার গাড়ির বহর’। মিডিয়ার এসব ভুল ক্রটি নিয়ে আমি লিখতাম খবরের কাগজে। মোনাজাত ভাই’র এই ভুল রিপোর্ট নিয়ে আমি খবরের কাগজে লিখেছিলাম। তিনি গুরু আমি শিষ্য। এ যেন আমার গুরুমারা বিদ্যা! শিষ্যের এই ভূমিকা হয়তো পছন্দ করেননি মোনাজাত ভাই। ওই ঘটনার পর তিনি অনেক দিন আমার সঙ্গে কথা বলেননি।

দৈনিক সংবাদের মোনাজাতউদ্দিনকে বেশি বেতনে জনকন্ঠ নিজের টিমে নিয়ে আসে। জনকন্ঠে থাকতেই তিনি ফেরি দূর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু মোনাজাত ভাই সংবাদে যেমন স্বচ্ছন্দ ছিলেন জনকন্ঠে সে রকম ছিলেননা। জনকন্ঠের চরিত্রের কারনে তাঁর রিপোর্ট খুব কম প্রথম পাতায় ছাপা হতো। রংপুরের সাংবাদিক আমান-উদ-দৌলা ছিলেন জনকন্ঠের কূটনৈতিক সংবাদদাতা। মোনাজাত ভাই তাঁর তখনকার কষ্ট শেয়ার করতেন আমান ভাই’র সঙ্গে। একবার আমান ভাইকে এক চিঠিতে লিখেন, ‘আর কিভাবে লিখলে আমার রিপোর্ট জনকন্ঠের লিড নিউজ হবে’?

মর্মন্তুদ এক ফেরী দূর্ঘটনায় মোনাজাতউদ্দিনের হঠাৎ মৃত্যু হলে জনকন্ঠ থেকে ডাক পাই আমি। পত্রিকার প্রানপুরুষ উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানকে রিপোর্টিং মিটিং’এ বলা হয় মোনাজাতউদ্দিনের শূন্যস্থান নাকি আমিই পূরন করতে পারবো। ১৯৯৬ সালের ১১ মে আমি যোগ দেই জনকন্ঠে। যোগ দিয়েই আমাকে রিপোর্টিং’এ পাঠানো হয় ঢাকার বাইরে। কিন্তু তখনই টের পাই মোনাজাতউদ্দিনের কষ্টের মাত্রা। দেশে তখন নির্বাচনী ডামাঢোল। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। সেই সময় ঢাকার বাইরে এক সপ্তাহ কাটাবার তখন একদিন তোয়াব ভাইকে ফোন করে বলি, নির্বাচনের রিপোর্ট করতে আমি ঢাকায় ফিরতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে আবেদন মঞ্জুর হয়। ঢাকায় ফিরিয়ে এনে কখনো শেখ হাসিনা-কখনো খালেদা জিয়ার বহরের সঙ্গে আমাকে পাঠানো হতো। মোনাজাতউদ্দিনের শূন্যস্থানে যোগ দিলেও আমি এভাবে চলে আসি পত্রিকাটির মেইন স্ট্রিম রিপোর্টিং’এ।

 বিভিন্ন সময়ে ইস্যু ভিত্তিক আমাকে ঢাকা বা দেশের বাইরেও পাঠানো হতো। যেমন মৌলভীবাজারের মাগুরছড়ার গ্যাসক্ষেত্র দূর্ঘটনার পর আমি সেখান থেকে টানা তেরদিন রিপোর্ট করেছি। টানা তেরদিন আমার রিপোর্ট তখন জনকন্ঠে লিড হয়েছে। আবার মাগুরছড়া থেকে ফেরার পর আমাকে পাঠানো হয়েছে মিশরে-জর্দানে। ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে উত্তাল এক পরিস্থিতি চলছিল। আবার ইরাক থেকে ফেরার পর ইলিশের রিপোর্ট করতে পাঠানো হয় চাঁদপুরে।

এভাবে সব সময় মেইন স্ট্রিমের মূল রিপোর্টের পিছনে ছুটে আমি প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় থাকতাম। আমি আমার প্রিয় প্রজন্ম রিপোর্টারদের বলি, সব সময় হাল চলতি আলোচিত মূল রিপো র্টের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবে। তোমাদের রিপোর্ট কেউ একসেস বা বাদ ফেলে রাখতে পারবেনা। কিন্তু এভাবে কাজ করে গেলেও আমরা কেউ মোনাজাতউদ্দিন হতে পারিনি। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোন মোনাজাতউদ্দিনের সৃষ্টি হয়নি। কারন মোনাজাতউদ্দিন হাঁটতেন কাদামাটির রাস্তায়। এখন সে রকম কাদামাটির রাস্তা খুব বেশি নেই। আমরা নাগরিক রিপোর্টাররা কাদামাটির রাস্তাও এড়িয়ে চলতে পটু। মোনাজাতউদ্দিন তাঁর জায়গায় তাই আজও অদ্বিতীয়। আজ ১৮ জানুয়ারি আমাদের প্রিয় মোনাজাতউদ্দিনের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মোনাজাত ভাই। না ফেরার দেশে ভালো থাকুন। খুব ভালো একজন সৎ পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন আপনি।


Place your ads here!

Related Articles

ধর্ষক শাফাতের বাবা, থানার ওসিও আসামী করা হোক বনানীর ধর্ষন কান্ডের মামলায়

ফজলুল বারী: বনানীর অভিজাত হোটেলে ঢাকার তিন ধনীর দুলালের ধর্ষনকান্ড নিয়ে এখন হৈচৈ চলছে দেশে। এরা জন্মদিনের আনন্দ উপভোগ করতে দামী

স্বদেশে “শহীদ মিনার” – প্রবাসে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” কেন

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেরুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” এই গানের আবেগ জড়িত সূর আর ‘শহীদ মিনার’ যেন বাংলাভাষা

Dramatist, Novelist Journalist Anisul Huq visits Canberra

When many amongst us were longing for a qualitative change in our audio-visual entertainment arena almost clogged with low-quality, cheap

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment