অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের ঈদ

অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের ঈদ

ফজলুল বারী: প্রিয় প্রজন্মদের অনেক প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ার ইনবক্সে। ভাইয়া আপনাদের ঈদ কবে? গরু কিনেছেন? ঈদের ছুটি কয়দিন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব লিখবো এখানে। মজা পাবেন। কারন ঈদ নিয়ে প্রবাসী জীবনে এমন কিছু আনন্দ-কান্না আছে যা দেশের অনেক মানুষের ধারনার বাইরে। যেমন এ লেখা যখন লিখছি সিডনিতে ১১ আগষ্ট রোববার। আমার বাংলাদেশি বন্ধু-বান্ধবের অনেকে আজ এখানে ঈদ উদযাপন করেছেন। কিন্তু আমার ঈদ সোমবার। এই ভিন্নতার বাস্তবতা আছে। বাংলাদেশের মতো অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানরাও দ্বিধাবিভক্ত। একপক্ষ ঈদ করেন চাঁদ দেখে। আরেকপক্ষ ঈদ করেন সৌদি আরবকে অনুসরন করে। অস্ট্রেলিয়ায় পৃথিবীর দু’শ দেশের মানুষ আছেন। মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আরব। তাদের বেশিরভাগ লেবানিজ বংশদ্ভূত। এরা কখনোই রোজা-ঈদের জন্যে চাঁদের খোঁজে আকাশের দিকে তাকাননা। সৌদি আরবকে অনুসরন করে রোজা শুরু-দুই ঈদ উদযাপন করেন। এদের প্রতিবেশী অথবা সংশ্লিষ্ট মসজিদ-মাসালার বাংলাদেশিরাও ঈদ করেন আরবদের সঙ্গে। তবে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান থেকে আসা মুসলমানদের বেশিরভাগ ঈদ করেন চাঁদ দেখে। তবলিগ জামাত সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপ চাঁদ দেখার খবর, নামাজের সূচি অনলাইনে বা এসএমএস’এর মাধ্যমে যার যার ঘনিষ্ঠদের জানিয়ে দেন। এই চাঁদ দেখনেওয়ালাদের সিংহভাগের ঈদ সোমবার। তবে বরাবর চাঁদ দেখে ঈদ করেন এমন অনেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিও এবার ছুটির দিন বলে রোববার ঈদ করে ফেলেছেন। তাদের যুক্তিও অকাট্য। ঈদুল আযহা তিনদিন ধরে উদযাপন করা যায়।

এবার কুরবানির পশু প্রসঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ার শহরাঞ্চলের কোথাও কোন পশুর হাট বসানো বা প্রকাশ্যস্থানে পশু জবাই করা যায়না। পরিবেশ রক্ষায় আইন বড় কড়া। পশু বিক্রি-জবাই হয় খামারে। কুরবানির পশু। এসব খামারের  অবস্থান শহরাঞ্চল থেকে বহুদূরে। এরজন্য আমরা কুরবানির টাকা জমা দেই মাংসের দোকানে। মাংসের দোকানি ঈদের দিন তাদের হাতে জমা কুরবানির অর্ডারের ফর্দ ও টাকাপয়সা নিয়ে খামারে চলে যান। সেখানে কুরবানির পশু ক্রয়-জবাই, আইনানুগ প্রক্রিয়াজাতকরন শেষে মাংস কেটে প্যাকেট করে বিলির জন্যে দোকানে নিয়ে আসেন। এরপর ফোন বা এসএমএস’ এর মাধ্যমে কুরবানিদাতাদের মাংস সংগ্রহের জন্যে দোকানে যেতে বলেন।

এরজন্যে আমরা কেউ কুরবানির পশু দেখিনা। এখানকার শহরাঞ্চলের খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়ে জীবিত গরু-ছাগল-ভেড়া এসব পশু হাঁস-মুরগি-কোয়েল এসব পাখি দেখেছে। এদেশে পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরন ব্যয়বহুল। পরিবহন দূষনের আশংকায় পশু জবাই, চামড়া পৃথকীকরনের সঙ্গে সঙ্গে নাড়ি-ভূড়ির সঙ্গে চামড়াও ধংস করে দেয়া হয়। এরজন্যে আমাদের কুরবানির পশুর চামড়া বলে কোন যোগ-সংযোগ নেই। এদেশে পশু জবাই-চামড়া পৃথকীকরনের পর মাংস নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হিমায়িত করে এর রোগ-জীবানু ধংস করা হয় বলে কুরবানির মাংস পেতেও আমাদের বেশ অপেক্ষায় থাকতে হয়।

সিডনির লাকেম্বা-ওয়ালি পার্ক-পাঞ্চবল-ব্যাংকস টাউন-গ্রীনএকর-ইয়াগুনা এসব অস্ট্রেলিয়ার মুসলিম প্রধান এলাকা। এসব এলাকার মুসলিম মালিকানাধীন মাংসের দোকানগুলোয় এবারে গরুর প্রতিভাগের জন্যে ২০০-২২০ ডলার পর্যন্ত কুরবানির অর্ডারের বিপরীতে দাম রাখা হয়েছে। ভেড়া প্রতিটি ১৫০-২০০, ছাগল প্রতিটির জন্যে ২২০ ডলার পর্যন্ত দাম রাখা হয়। কিছু দাতব্য সংস্থা আফ্রিকার দেশগুলোতে কুরবানির ব্যবস্থা করে। অনেকে ৬০-৯০ ডলারে এসব দাতব্য সংস্থার মাধ্যমেও কুরবানি দেন।

ওইসব দেশের দরিদ্র মানুষজনের মধ্যে বিলি করা হয় এসব কুরবানির মাংস। প্রচলিত সংস্কৃতিতে কুরবানির মাংস তিন ভাগ করা হয়। এর এক ভাগের মাংস বিলি করতে হয় দরিদ্র মানুষজনের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়ায় সে রকম দরিদ্র মানুষ না থাকায় দরিদ্রদের ভাগের মাংসের মূল্য নির্ধারন করে এর সমুদয় টাকা আমরা বিলির জন্যে দেশে পাঠিয়ে দেই। এমনিতে আমরা কুরবানির টাকা পাঠিয়ে দেই দেশে। এখানে গরুর একভাগ অথবা একটা ছাগল বা ভেড়া কুরবানির জন্যে দোকানে টাকা জমা দেই। কুরবানির বড় অংশটি দেশে দেয়া হয় বলে প্রায় এক কোটি প্রবাসীর কুরবানির অর্থ এভাবে যায় গ্রামীন অর্থনীতিতে। অস্ট্রেলিয়ার কুরবানির একটি অংশের টাকাও যায় গ্রামে। কুরবানির মাংসের যে ভাগ স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের সে অংশও বিলি করা এসব দেশে কঠিন। কারন সবাই এখানে কাজ-ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত। অনেক ক্ষেত্রে এসব মাংসও রান্না করে রেখে যাকে যখন পাওয়া যায় তাকে নিয়ে এসে খাইয়ে দিতে হয়।

সব মিলিয়ে কুরবানি বৃত্তান্ত বলে আমরা বাংলাদেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশে যা জানি এসব দেশের বাস্তবতার সঙ্গে এর কোন মিল নেই। এসব দেশে পশু জবাই হয় খামারের মিট প্রসেসিং সেন্টারের যন্ত্রে। মন্ত্র পড়ে যন্ত্র। বাংলাদেশের মতো দেশে যেভাবে রাস্তাঘাটে পশু জবাই হয় এসব দেশে তা কল্পনায় ধারনারও বাইরে। আবার এসব দেশেও অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে খামারে গিয়ে নিজের হাতে কুরবানি দেন। কিন্তু এরসংখ্যা খুবই অনুল্লেখ্য। সহস্রে একজন হতে পারে। জীবন যেখানে যেমন।

এবার ঈদের ছুটি প্রসঙ্গ। খ্রিস্টান প্রধান এদেশে ধর্মীয় ছুটি বলতে ক্রিসমাস এবং ইস্টারের ছুটি। ধর্ম নিরপেক্ষ এই দেশ ঈদের ছুটিও দিতে চায়। মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ঈদের একটি দিন ঠিক করে জানাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু মুসলিমরা যেহেতু ঐক্যবদ্ধ না, কেউ চাঁদ দেখে কেউ সৌদি আরবকে অনুসন করে ঈদ করেন বলে ছুটির জন্য কোন সর্ব সম্মত দিন দেয়া যায়না বলে ঈদের কোন অফিসিয়েল ছুটিও নেই। স্কুলে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের মৌখিকভাবে ঈদ উপলক্ষে কোথাও দু’দিন, কোথাও তিন দিন স্কুলে না আসলেও চলবে বলে দেয়া হয়। কিন্তু এমন ছুটি নেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে কারনে ছাত্রছাত্রীদের অনেকের ঈদের দিনও ক্লাস-পরীক্ষা থাকে। এমন ছাত্রছাত্রীরা সকালের প্রথম জামাতে ঈদের নামাজ পড়েই ছোটেন ক্লাস-পরীক্ষার উদ্দেশে।

 অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ সিডনির লাকেম্বার ওয়ানজি রোডের বড় মসজিদ। কাউন্সিল-পুলিশে অনুমতি নিয়ে এ মসজিদের লাগোয়া ওয়ানজি রোডে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার আর কোথাও এভাবে রাস্তার ওপর নামাজের জামাত হয়না। এ উপলক্ষে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে পুলিশ। ঈদের আগের রাত থেকে রাস্তাটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। লেবানিজ মুসলিম নিয়ন্ত্রিত অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম কাউন্সিল যেহেতু সৌদি আরবকে অনুসরন করে ঈদ উদযাপন করে সে কারনে বাংলাদেশি মুসলমানদের এখানে নামাজ পড়ার সুযোগ হয় কম। লাকেম্বা-ওয়ালি পার্কের মাসালা ছাড়াও ওয়ালি পার্ক লাগোয়া প্যারি পার্কে মূলত হয় বাংলাদেশি-ভারত-পাকিস্তানি মুসলিমদের মূল ঈদের জামাত। বৃষ্টি থাকলে এ জামাত প্যারি পার্কের ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়ায় সারিহিলস-মিন্টোসহ সিডনির নানা এলাকায় হয় ঈদের জামাত।

অস্ট্রেলিয়ায় এমনিতে ছুটিছাটা কম। কাজের সংস্কৃতির এই দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী চাকুরেরা বছরে চার সপ্তাহের ছুটি পান। এরসঙ্গে আছে বার্ষিক নয় দিনের অসুস্থতাজনিত ছুটি। যার যার কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় রিপ্লেসমেন্ট থাকলে সে কারনে মুসলিম কর্মচারীরা বার্ষিক ছুটি থেকে অথবা সিক কল দিয়ে  ঈদ উপলক্ষে ক্যাজুয়াল ছুটি চেয়ে নেন।

এদেশের সিংহভাগ লোক কাজ করেন অস্থায়ী ভিত্তিতে অথবা ঠিকাদারের অধীনে। এক্ষেত্রে কাজ করলে মজুরি, কাজ না করলে কোন মজুরি নেই। জীবন এখানে খুবই ব্যয়বহুল। সংসার চালাতে সপ্তাহে কমপক্ষে হাজার ডলার আয় থাকা চাই। এরমাঝে সিংহভাগকে দেশে টাকা পাঠাতে হয় দেশে। ছাত্রছাত্রীদের নিজের চলার ব্যয় জোগাড়ের পাশাপাশি জমাতে হয় টিউশন ফীর টাকা। তাই ঈদ হোক বা যাই হোক কেউ সহজে কাজের শিফট মিস করতে চাননা। এরজন্যে এমন সিংহভাগ ঈদের নামাজ পড়েই ছোটেন কাজের উদ্দেশে। মনে করুন কেউ কাজ করেন নাইট শিফটে। সকালে কাজ শেষে বাসায় ফিরে ছোটেন নামাজে। এরপর বাড়ি ফিরে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার ছোটেন কাজের উদ্দেশে। এরমাঝে প্রায় সবাই একটু সময় করে দেশে মায়ের সঙ্গে বা স্বজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

অস্ট্রেলিয়ায় যারা পড়াশুনা করতে আসেন তারাই এদেশে আমার প্রিয় প্রজন্ম। গত এক যুগে এমন দেড় সহস্রাধিক প্রিয় প্রজন্ম ছাত্রছাত্রীদের প্রথম সংগ্রামের দিনগুলোয় একজন বন্ধু একজন বড়ভাই বা একজন অভিভাবকের ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট থাকার ব্যক্তিগত একটি গৌরব আছে। ঈদের দিন এই প্রিয় প্রজন্মদের নিয়ে আমাদের একটি গেটটুগেদার হয়। প্যারি পার্কে ঈদের নামাজ শেষে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে যাই লাকেম্বার ২ কিগ স্ট্রিট নর্থের প্রিয় তুলি ভাবীর বাসায়। এই মহিয়সী মায়ের পুরো নাম রোকসনা চৌধুরী তুলি। তাঁর স্বামী আমাদের প্রিয় আনোয়ার ভাই। বাংলাদেশের দোহারে এই দম্পতির বাড়ি। এদেশে তাদের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। এই মা প্রতিবছর দুই ঈদে আমার এসব শতাধিক প্রিয় প্রজন্মদের জন্যে ঈদের রান্না করেন। তার বক্তব্য তিনি তার ছেলেমেয়েদের জন্যে রান্না করেন ঈদের বিশেষ সব খাবার। কিন্তু সিডনিতে পড়তে আসা এই ছেলেমেয়েদেরতো এখানে মা নেই। প্রিয় তুলি ভাবী প্রিয় আনোয়ার ভাই তাই প্রতি ঈদের দিন আমার এই প্রিয় প্রজন্মদের মা-বাবার ভূমিকা নেন। বিদেশে কারো বাসাবাড়িতে কোন কাজের লোক নেই। সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। আর্থাইটিজের সমস্যায় তুলি ভাই এমনিতেই নিজেই চলেন কষ্টে। কিন্তু কোন ঈদে তার ভালোবাসার কোন মিস নেই। এমন ভালোবাসা কান্না আনে। চোখ ভিজায়। প্যারি পার্কের নামাজ শেষে এবারও আমরা যাবো প্রিয় তুলি ভাবী-আনোয়ার ভাইর বাসায়। এইতো আমাদের ঈদ।


Place your ads here!

Related Articles

সামারে একদিন: পর্ব -১ ওয়াসিম খান পলাশ প্যারিস থেকে

এখানে প্রায় সবাই সামারকে উপভোগ করার আপ্রান চেষ্টা করে । সামার আসে খুব অল্প সময়ের জন্য। দেখতে দেখতে দিন, সপ্তাহ

চৈতালী ত্রিপুরা এখন অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে

Pallab Rangei: অনেকটা নীরবে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের সুহৃদ সহযোদ্ধা চৈতালী ত্রিপুরা। স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য স্বপরিবারে পাড়ি জমালেন

Why do foreign diplomats speak in our domestic affairs?

Bangladesh is in the grip of a political crisis because the ruling and the opposition parties are unable to reach

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment