খালেদার মুক্তি প্যারোলে না জামিনে

খালেদার মুক্তি প্যারোলে না জামিনে

মুখে প্রতিদিন গরম গরম রাজনৈতিক বক্তৃতা দিলেও খালেদা জিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে নেপথ্যে একটি আলোচনা চলছে তা দলটির সাম্প্রতিক কিছু তৎপরতা আর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্যে দন্ডিত বন্দিনী বিএনপির চেয়ারপার্সনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসায় স্পষ্ট। বিএনপির শীর্ষ নেতারা এরমাঝে দু’বার খালেদা জিয়ার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করেছেন। সর্বশেষ মির্জা ফখরুল দেখা করেছেন একা। ওই সময়েই তিনি সর্বশেষ সরকারি প্রস্তাবটি নিয়ে খালেদার সঙ্গে আলোচনা করতে যান। বিষয়টি শুধুমাত্র খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্যে হয়তো এবার অন্য নেতাদের সঙ্গে নেননি বিএনপি মহাসচিব। অথবা সরকার শুধু তাকে একা দেখা করতে বলেছে অথবা একা দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। মির্জা ফখরুল দেখা করার পরদিনই খালেদা জিয়াকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্যে এই প্রথম জেলখানার বাইরে আনা হয়। বিএনপির রুহুল কবীর রিজভি বলেছেন, খালেদা জিয়াকে জোর করে হাসপাতালে আনা হয়েছে! কিন্তু খালেদাকে যারা চেনেন জানেন তারা মানবেন রিজভির বক্তব্য সঠিক নয়। খালেদাকে জোর করে কিছু করানো সহজ অথবা সম্ভব নয়। নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া তিনি কোন ওষুধ খেতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন।যদ্দুর জানা যাচ্ছে একটি পয়েন্টে শুধু এখনও মত পার্থক্য আছে উভয়পক্ষের।

আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব না এটি এরমাঝে বিএনপি স্বীকার করেছে। সরকারি প্রভাবে সুপ্রিমকোর্ট খালেদা জিয়ার জামিন বিলম্বিত করছে এটি মুখে বললেও, ভূয়া অভিযোগে খালেদা জিয়ার সাজা এটি তারা বেশি বেশি বলে চললেও দলের আইনজ্ঞরা জানেন সুপ্রিমকোর্টে আপীলেও তাদের সুবিধা পাবার সুযোগ কম। এই কথাগুলো বলে তারা আগেও মামলাটি খারিজের আবেদন নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কারন এই মামলার অভিযোগের শক্ত প্রমানাদি আছে। এতিমদের জন্যে বিদেশ থেকে আসা টাকা নিয়ম মাফিক প্রধানন্ত্রীর ত্রান তহবিলে জমা না করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পৃথক একাউন্টে স্থানান্তর করেছেন। এরজন্যে মইনুল রোডের বাড়ির ভূয়া ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। যেখানে খালেদা জিয়ার এতিম ছেলেরা থাকলেও সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ে রেজিস্ট্রিকৃত কোন এতিমখানা ছিলোনা। এতিমদের জন্যে আসা অনুদানের টাকাগুলো কোথাও এতিমদের পিছনে খরচ করা হয়নি। এখন টাকা ব্যাংকে আছে, তা সুদে আসলে কয়েকগুন হয়েছে বললেও আইনের কাছে পার পাবার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসা এতিমদের টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে জমা না করে অন্য কারো নামে ব্যাংকে জমা রাখার কথা ছিলোনা। কেনো এত বছরেও এতিমখানাটি হলোনা, এর কোন উত্তর নেই। এসবের ডকুমেন্টারি প্রমান দেখে তখনো সুপ্রিমকোর্ট মামলাটি খারিজের আবেদনে সাড়া দেয়নি।

আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিএনপির তরফে তুমুল রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। প্রশংসিত হয়েছে তাদের শান্তিপূর্ন আন্দোলন কর্মসূচি। এতে করে তাদের কর্মসূচিতে দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এটি আগামি নির্বাচনে তাদের জন্যে ইতিবাচক হবে। কিন্তু এখন তা সরকারের ওপর কোন চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। এর একটি কারন হতে পারে দেশের সাধারন মানুষ এখন আর যার যার জীবন সংগ্রামের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে আগ্রহী নয়। হরতাল জাতীয় কর্মসূচিতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখন একদম পছন্দ করেনা। কারন এতে তাদের দূর্ভোগ আর জীবন যাপনের ব্যয় বাড়ে।

আর আমাদের দেশের লোকজন মূলত রাজনৈতিক কর্মসূচি-নির্বাচন এসবে যেদিকে পাল্লা বেশি দেখে সেদিকে গিয়ে শেষ মুহুর্তে যোগ দেয়। নিজেদের জীবন সংগ্রামের নানাক্ষেত্রে তাদের অনেকে একেকজন পরাজিত মানুষ। হারু পাট্টি। রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিলে বা নির্বাচনের দিনে তারা জিততে চায়। সম্ভাব্য একটা হারু পাট্টির পক্ষ নিতে চায় না। এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে বিএনপি এমন কোন গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি যে সাধারন মানুষ তাদের সঙ্গে আজান দিয়ে যোগ দেবে। বিএনপি যে গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি এর আরেকটি কারন এর বয়স্ক নেতৃ্ত্ব। এদের বেশিরভাগ বয়স্ক এবং অসুস্থ। সংবাদ ব্রিফিং বা প্রেসক্লাব-রিপোর্টার্স ইউনিটির হলরুমের মধ্যে এরা বলেন ভালো। রাস্তার আন্দোলনে তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের সমকক্ষ নন। সরকার কর্মসূচিতে বাধা দেয়? অনুমতি দেয়না? আমাদের দেশের সরকারি দল এমন আচরন সব সময় করে। বিএনপিও সরকারে থাকতে এমনটি করেছে। আগামিতেও সরকারে গেলে তাই করবে। বিরোধীদলকে আদায় করে নিতে হয়। বিরোধীদলে থাকতে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বাধ্য করে আদায় করেছে। বিএনপি তা পারেনি।

মামলাটির ম্যারিট বুঝে মামলা চলাকালীন সময়েই খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যতভাবে পেরেছেন মামলাটিকে বিলম্বিত করেছেন। তাদের হয়তো ধারনা ছিলো এরমাঝে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে, তাই খালেদাকে শাস্তি ভোগ করতে হবেনা। কিন্তু তাই যখন হলোনা তখন হয়তো তারা খালেদাকে বুঝিয়েছিলেন শাস্তি হলেও আপিলের সময় জামিনও হবে। সাজা পাঁচবছর দেখে তারা জামিন প্রশ্নে আশাবাদীও ছিলেন। জামিন হাইকোর্ট দিয়েছিলও। কিন্তু সে জামিন সুপ্রিমকোর্টে আটকে গিয়ে বিলম্বিত হলে খালেদা এবং আইনজীবীরা নতুন চিন্তায় পড়ে যান। এরমাঝে আবার দুদক সাজা বাড়াবার আবেদন করেছে। বিলাতি আইনজীবী সম্পৃক্ত করেও তার গ্রহনযোগ্যতার সমস্যা আর বার কাউন্সিলের আইনে তার কোর্টে শুনানিতে অংশ নেবার সুযোগ না থাকায় বিষয়টি কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। জামিন অথবা মুক্তির প্রশ্নে আইনজীবীদের ব্যর্থতায় খালেদা জিয়ার অসন্তোষের বিষয়টিও এরমাঝে জানা গেছে। উকিল সফল না হলে মক্কেল অসুখী হবেন এটি অবশ্য একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

এরপর সম্ভবত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সমঝোতায় মুক্তির বিষয়টি চিন্তায় আসে। এরমাঝে মির্জা ফখরুল একবার উন্নত চিকিৎসার জন্যে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়া নিয়ে বক্তব্য দেন। ফখরুল বলেন খালেদা জিয়ার সব চিকিৎসাই বিদেশে হয়েছে। অন্তত ফলোআপের জন্যে হলেও তার বিদেশে চিকিৎসার জন্যে যাওয়া জরুরি। আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সঙ্গে সঙ্গে এই বক্তব্য গ্রহন করে বলেন মেডিক্যাল বোর্ড চাইলে সরকার খালেদার বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সুরটি এমন ছিলো যেন তারা চাইছেন খালেদা জিয়া দেশের বাইরে চলে যান! তখন বিএনপির পক্ষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ফখরুলের বক্তব্য সংশোধন করা হয়। এতে বলা হয় মুক্তির পর খালেদা সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি চিকিৎসা দেশে না বিদেশে করবেন। ওবায়দুল কাদের এরপর থেকে বলা শুরু করেছেন চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে জেলকোড অনুসারে। মোটকথা দুই পক্ষের বক্তব্যের সুর এখনো দু’রকম! বিএনপি চাইছে জামিনে মুক্তি। সরকার চাইছে চিকিৎসার জন্যে খালেদা জামিন নয় প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যেতে পারেন বিদেশে।

৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার মূল শারীরিক সমস্যাটি আর্থাইটিজজনিত। হাড়ের ক্ষয়রোগের ব্যথা-বেদনার এ সমস্যাটি নিরাময়যোগ্য নয়। চিকিৎসার মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রন বা রোগিনীকে কিছুটা আরাম দেবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এরজন্যে যে সব টেবলেট, ফিসওয়েল টেবলেট, ইনজেকশন অথবা থেরাপির ব্যবস্থা করা হয়, এরজন্যে বিদেশ যাবার দরকার নেই। এসব চিকিৎসা দেশেই সম্ভব। মানসিক দুশ্চিন্তায় থাকলে ব্যথা-বেদনার রোগ বাড়ে। খালেদা জিয়া জেলখানায় আছেন। জেলখানায় নিশ্চয় তার মানসিক স্বস্তি নেই। তাই তার সমস্যাটি বেড়েছে। এরসঙ্গে বার্ধক্যজনিত অন্য সমস্যাগুলোও তাকে কাবু করতে পারে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় বিদেশ তথা লন্ডনে গেলে স্বজন পরিবেষ্টিত পরিবেশে তার হয়তো শারীরিকভাবে কিছুটা ভালো কাটবে। জামিনে মুক্তি নিয়ে লন্ডনে গেলে তিনি সেখান থেকে রাজনীতিও করতে পারবেন। কিন্তু প্যারোলে গেলে তা পারবেন না। কারন প্যারোল মানেই শর্তসাপেক্ষে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি। শর্ত ভঙ্গ করলে প্যারোল বাতিল হবে। তিনি হয়ে যাবেন ফেরারী আসামী।

এখন প্রশ্ন হলো সরকার কেনো তার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশ গমন চাইছে? এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহন অথবা নির্বাচন করতে পারার সুযোগ কম। খালেদাকে দেশে রেখে খালেদাকে ছাড়া বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেবার সুযোগ কম অথবা দলটি এরমাঝে এ ব্যাপারে না সূচক অবস্থান নিয়ে রেখেছে। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায় এবং খালেদাকে ছাড়াই তাদের নির্বাচনে ভালো করার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এখন কী বিএনপি খালেদাকে ছাড়াই নির্বাচনে যেতে চাইছে? সরকারি দল কী মনে করছে নির্বাচনী ময়দানে খালেদা না থাকলে তারা ভালো করবে? পেন্ডুলামটি আপাতত এখানেই স্থির হয়ে আছে। জামিন ছাড়া সরকারি চিন্তার প্যারোল প্রশ্নে রাজি হওয়াটা বিএনপির জন্যে কঠিন। প্যারোল ছাড়া সরকার রাজি হবে, এমন অবস্থা এখনও সরকারের নেই। সবাই যার যার স্বার্থ দেখবে এটাই স্বাভাবিক। কারন কেউ এখানে রামকৃষ্ণ মিশন বা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের দফতর খুলে বসেনি। সরকার ও বিএনপির নেপথ্যের আলোচনার ফলাফল জানতে দেখতে তাই আমাদের আরও অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

ফজলুল বারী


Place your ads here!

Related Articles

রান ৪/৩৩: এমন ব্যাটিং দেখা হইতে ঘুম উত্তম

বাংলাদেশ ক্রিকেট গতকাল এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। মনের গহীন থেকে অভিনন্দন। মুশফিক আউট হবার পর একদলা হতাশা আর কষ্ট নিয়ে

এরশাদের জাতীয় পার্টি – নাচে গানে ভরপুর এক সম্পূর্ন রঙ্গিন দল

ফজলুল বারী: চলমান নানা ইস্যুর ব্যস্ততা অনেক দিন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে লেখার সময় করতে পারিনা। দেশে থাকতে আমার যে সব

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment