সেনাবাহিনীকে নিয়ে ডক্টর কামালদের খোয়াব!
ফজলুল বারী: নানান স্ববিরোধিতা বাংলাদেশের ভঙ্গুর গনতান্ত্রিক রাজনীতিতে! রাজনীতিবিদরা ভোটে নির্বাচিত হয়ে পাঁচবছর দেশ চালায়। অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দেশ চালাক বা সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা নিক এটা চায় না। কিন্তু ভোট এলেই বিরোধীদল চায় অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার! বিচারিক ক্ষমতা সহ সেনাবাহিনীর মোতায়েন চায়! কিন্তু সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা আসলে কী, এ দাবি একটি বেসামরিক প্রশাসনের দেশের সংবিধান অনুমোদন করে কিনা, এ নিয়ে এদের বেশিরভাগ লোকজনের ধারনারও অভাব আছে। এর পরিণতি নিয়ে এ লেখায় লিখবো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ে করুণ সব অধ্যায় আছে। এই বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে জেনারেল জিয়া-এরশাদ বিএনপি-জাতীয় পার্টি নামের দুটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। সেনাবাহিনীতে একেরপর এক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন জিয়া। এরপর আবার জিয়াও নিহত হয়েছেন সেনা সদস্যদের হাতে। বাংলাদেশের কিছু লোকজন আত্মতুষ্টি পেতে বলার চেষ্টা করে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্য। তাহলে সেই কথিত বিপদগামী সদস্যদের বিদেশে প্রাইজ পোষ্টিং দেয়া হয়েছিল কেনো? আইন কেনো পাশ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবেনা? শেখ হাসিনার দেশে প্রবেশ কেনো আটকে রেখেছিলেন জিয়া? দেশে আসার পরও কেনো শেখ হাসিনাকে ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বার সড়কের পিত্রালয়ে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলোনা? না এখানে স্বীকার হচ্ছে জিয়াও সেই কথিত বিপদগামী সেনা সদস্যদের অংশ? জিয়াকে হত্যার পর কিভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল জেনারেল এরশাদ? শুধু ক্ষমতা দখল নয়, ক্ষমতায় টিকেছিল ৯ বছর?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের সর্বশেষ ঘটনা ঘটে ২০০৭ সালে ১/১১’র সময়। এখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে জেনারেল ইব্রাহিম নামের এক নেতা আছেন। বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে তিনি এবার নির্বাচনও করছেন। আমার মনে আছে ১/১১’র আগে একটি টিভি অনুষ্ঠানে জেনারেল ইব্রাহিম আকুল আহবানে সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলছিলেন প্লিজ আপনারা আসুন। দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করুন। ১/১১’র পর সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেছিলেন ডক্টর ইউনুস। জেনারেল ইব্রাহিম, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ, মনসুর এরা সবাই ছিলেন এ খেলায়। ডক্টর কামাল আজকাল অনেক বড় বড় কথা বলেন। কিন্তু তখন বলেছিলেন সেই সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত অগনতান্ত্রিক সরকার অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে! কিন্তু পরে এদের সবার মোহভঙ্গ ঘটে। কারন একে একে সবাই বুঝতে পারেন সেনাবাহিনী নিজের জন্যে ক্ষমতায় আসে। অন্য কারো জন্যে নয়। জেনারেল মঈনও তখন বেশি বেশি আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান বলতে থাকেন।
১/১১’র আগে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু আগে গ্রেফতার করা হয় শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রধান সারির সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। শুধু খালেদা জিয়া না, তার দুই ছেলে তারেক-কোকো-ফালু-গিয়াস উদ্দিন আল মামুনদেরও গ্রেফতার করা হয়। চিকিৎসার কথা বলে দেশ ছাড়তে হয়েছে তারেক-কোকোকে। শুরু হয় বিরাজনীতিকরনের এক বিশাল যজ্ঞ। জেনারেল জিয়া যেমন ক্ষমতার দন্ড হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স!’ ডক্টর কামাল-ব্যারিষ্টার মইনুলগংও ছিলেন ১/১১ সরকারের বিরাজনীতিকরন প্রয়াসের সমর্থক।
কিন্তু তখন সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের বাধা আসে। এরজন্যে জেনারেল মঈন আর আলু খাওয়ার আবেদন বেশিদিন চালাতে পারেননি। যেমন জেনারেল এরশাদকেও শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রতাহারের কারনে গন আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছিল। ক্ষমতালোভী জেনারেলদের কারনে জনমনের বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও অভ্যন্তরীন ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কারন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নানা ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীর শ্রেষ্ঠদের সবাই সেনা সদস্য। বীরউত্তম, বীর প্রতীকদের বেশিরভাগ সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী-পুলিশ সদস্যরা আজ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ন অংশ। কারন বাংলাদেশে এখন সেনা শাসন না, সিভিল প্রশাসন ক্ষমতায়।
আজকের বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী ভিন্ন উচ্চতায় আসীন। শুধু জাতিসংঘ বাহিনীতে নয়, দেশেও গুরুত্বপূর্ন নানাকিছুর অংশীদার। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বিডিআর বিদ্রোহের সুযোগে ভিন্ন একটি চেষ্টা হয়েছিল। সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। আগে সেনাবাহিনী শুধু ফৌজি ফ্লাওয়ার মিলের ময়দা, মোজা এসব তৈরি করতো। আর্মি ইঞ্জিনীয়ারির কোর এখন দেশের প্রধান সব ভৌত অবকাঠামো নির্মানে জড়িত। হাতির ঝিল প্রকল্প তাদের সৃষ্টি। পদ্মা সেতু সহ নানা অবকাঠামো নির্মানের সঙ্গে জড়িত এখন আর্মি ইঞ্জিনীয়ারির কোর। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মালিকানায় এখন ব্যাংক, পাঁচতারকা হোটেল সহ নানান অর্থকরী প্রতিষ্ঠান আছে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবনমানেরও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সাভারে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি সহ নানান দুর্যোগ সামাল দিতে তাদের পেশাদারিত্ব দেখেছে দেশের মানুষ। জাতিসংঘ বাহিনীতে কোন একজন সদস্য যেতে পারলে একেকজন বৈধভাবে কত অর্থের মালিক হয়ে দেশে ফিরতে পারেন, এটি ওয়াকিফহালরা জানেন। অবকাঠামোগত নানান উন্নয়ন ঘটেছে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর। দেশে গনতান্ত্রিক শাসন থাকায় এসব সম্ভব হয়েছে।
এবার নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনকে কেন্দ্র করে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা ঘটেছে! ডক্টর কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল যে বিবৃতি দিয়েছেন এর পিছনে কী কোন উস্কানি আছে? না রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা-অসারতা? মাহমুদুর রহমান মান্না দিয়েছেন আরেক উস্কানি! সোমবার ঢাকায় এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মান্না বলেছেন, ক্ষমতাসীন সরকার নাকি দেশের বিভিন্ন বাহিনীকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে পক্ষে টানার চেষ্টা করছে! এর আগে এক টিভি অনুষ্ঠানে ঐক্যফ্রন্টের নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেনা প্রধানের বিরুদ্ধে অসত্য দেন। আইএসপিআরের প্রতিবাদের মুখে পরে তিনি একাধিকবার মাফ চান। এই তিনটি ঘটনা ইঙ্গিত দেয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবির পিছনে ডক্টর কামালদের ভিন্ন কোন খোয়াব থাকতে পারে। অতএব কান্ডারি হুশিয়ার! বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশের সকল পক্ষকে আবেদন করছি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর চলতি অনন্য সাধারন উচ্চতাকে কেউ খাটো করার অপচেষ্টা করবেননা।
Related Articles
মদিনা সনদ ও হযরত ওমর (রা.)র সেকুলারইজম এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ভেবেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি ও প্রবাসী বাঙালী চেতনা নিয়ে এবার লিখবো। সুন্দর হেমন্তে আমরা যারা বিদেশে আছি তাঁরা কতটা বাঙালী চেতনায়
21st Century “Kunta Kinte”! Chapter 1 : The realisation!
21st Century “Kunta Kinte”! Introduction: Revealing the “untold”! Chapter 1: The realisation! Migration among mankind is nothing new. Human migration
বইপড়া ও আমার প্রান্তিক জীবন
শিকড় মানেই তো এক প্রান্ত। তবু এই প্রান্তিক শিকড়ই জীবনকে খোরাক জোগায় ও সমৃদ্ধ করে। ১৯৭৯ সালের শরৎকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের