ঋনযুদ্ধে পর্যুদস্ত এক বঙ্গবীর
ফজলুল বারী: নির্বাচনের মনোনয়নের প্রাথমিক বাছাই পর্বে বিশেষ কিছু ত্রুটি চোখে পড়েছে। যারা দেশের সংসদ সদস্য হতে চান একটি মনোনয়নপত্র তাদের অনেকে হয়তো ঠিকমতো পড়েননি অথবা প্রয়োজন মনে করেননি। প্রার্থীদের অনেকে আইনজীবীদের মাধ্যমে মনোনয়ন জমা দিলেও জায়গামতো নিজের স্বাক্ষরটিও ঠিকমতো দেয়নি। হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হবে এটি আমান উল্লাহ আমানদের ঘটনায় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। বাংলাদেশের নির্বাচন এলে মনোনয়নপত্র বাতিলের ঘটনায় পুরনো-মুখস্ত অযোগ্যতা হলো ঋন এবং বিল খেলাপি। চতুর প্রার্থীরা তাই নির্বাচনের আগেভাগে এ দুটি উপসর্গ থেকে সাফসুতরো হবার চেষ্টা করেন। একজন তা জ্ঞানত করেননা অথবা করেননি তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীর শ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর প্রতীক এসব অফিসিয়েল খেতাব আছে। কাদের সিদ্দিকী তার অফিসিয়েল খেতাবটি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের নাগরিকত্বকে কেন্দ্র করে ঘোষনা দিয়ে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি যেহেতু এখন বিএনপি-জামায়াত জোটের ঘনিষ্ঠ, যুদ্ধাপরাধীদের দিগন্ত টেলিভিশনে কাজ করেছেন তাই সেই খেতাব ত্যাগের বিষয়টি আর নিজের থেকে বলেননা। সম্প্রতি নাগরিক টিভিতে কাদের সিদ্দিকীর উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইল এলাকায় বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্যে কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবীর এবং বাঘা সিদ্দিকী হিসাবে পরিচিতি পান। তাঁর খেলাপি ঋন নিয়েও ওই অনুষ্ঠানে আলোচনা হয়। সেখানে ঋনজনিত কারনে তাঁর মনোনয়ন বাতিল করা হলে এর পরিণতি সম্পর্কে হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘এক মাঘে শীত যায়না’!
সুদেআসলে কাদের সিদ্দিকীর খেলাপি ঋনের পরিমান দশ কোটি টাকার বেশি। কাদের সিদ্দিকী যেহেতু এই ঋন পরিশোধের আর কোন চেষ্টা করেননা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে তাঁর ঋনের বিষয়টিকে কুঋন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় এই বিষয়টিকে বলা হয় অর্থনৈতিক দেউলিয়া। যাদেরকে অর্থনৈতিক দেউলিয়া হিসাবে ঘোষনা করা হয় তারা নিজের নামে একটি ফোনও আর নিতে পারেননা। অর্থনৈতিক দেউলিয়ার ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজড করা হয়। এমন ব্যক্তি ব্যাংক কার্ড-ক্রেডিট কার্ড সহ সব ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেনের যোগ্যতা হারান। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাতো দূরের বিষয়।
কাদের সিদ্দিকীর এসব খেলাপি ঋন, সোনার বাংলা কোম্পানি খুলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার অনেকগুলো সেতুর ঠিকাদারী কাজ নিয়ে এর একটি সেতুর কাজও সম্পূর্ন না করে টাকা তুলে নেয়া, এসব নিয়ে জরিমানা সহ নানাকিছুর সবিস্তার রিপোর্ট করেছিল প্রথম আলো। পত্রিকাটি যেহেতু এখন শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি চাইছে, কাদের সিদ্দিকীও শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি চান তাই এই রিপোর্টগুলোর আর কোন ফলোআপ করা হয়না। ঋনখেলাপি হবার কারনে নির্বাচন করতে পারবেননা এটা কাদের সিদ্দিকী জানতেন। তাই আগেভাগে ঘোষনা দিয়ে রেখেছেন সারাদেশ ঘুরে তিনি শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির নির্বাচনী প্রচারনার কাজ করবেন। তাঁর মনোনয়ন বাতিলের পর বলেছেন তিনি এর বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন। নির্বাচন কমিশন বলেছিল আদালতে তারা বাধা দিতে পার্টি হতে আসবেনা। দেখি নির্বাচন কমিশন কথা রাখে কিনা। কাদের সিদ্দিকী জানেন আদালতে গেলে তার বিপক্ষে কোর্টে আসবে ব্যাংক। তাই নিজের আসনে এরমাঝে তার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকীকে প্রার্থী করেছেন।
নাগরিক টিভির অনুষ্ঠানে কাদের সিদ্দিকী বলেছেন বর্তমান আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর দল নয়। শেখ হাসিনার দল। ড কামাল এবং তিনিই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ধরে রেখেছেন ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ধারন করে থাকলে ড কামাল এবং তার রাজনৈতিক দলের এমন করুন অবস্থা কেনো এ প্রশ্নটি সেখানে অবশ্য ভদ্রতাবশত তাকে করা হয়নি। উল্লেখ্য বাংলাদেশের কোথাও ড কামালের দলের কোন গনভিত্তি নেই। আর কাদের সিদ্দিকীর দলটি টাঙ্গাইলের এক দুটি আসন ভিত্তিক একটি আঞ্চলিক দল। এখন আবার এককভাবে নির্বাচন করে তার দলের সংসদে যাবার অবস্থা নেই বলে তিনি বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন। আর ড কামালের গনফোরামের বাংলাদেশের কোথাও একটি ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউপি সদস্যপদে জয়ী হবার মতো ভোটব্যাংক নেই। নাজুক বিএনপির এখন তিনি মুরব্বি। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা তার মিশন বলেও বিএনপি জামায়াতের মতো তার লোকজনকেও ধানের শীষ প্রতীক দিতে রাজি হয়েছে।
টিভি অনুষ্ঠানটিতে তাঁকে অস্থির চিত্ত বলায় এর নাখোশ জবাব দিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘বেঁচে আছিতো, তাই আমাকে এখন যা খুশি বলা সম্ভব’! কাদের সিদ্দিকীর নানাকিছু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তিনি শুধু অস্থির চিত্ত নন তাঁর নানাকিছু নিজস্ব ‘আমিত্ব’ গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাঁর মাধ্যমে এই ‘আমিত্ব’র সৃষ্টি হয়। কারন আর দশজন মুক্তিযোদ্ধার চাইতে তাঁর প্রচার ভালো হয়েছে অথবা এ ব্যাপারে তিনি আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধার অনেক কীর্তি আমরা তাদের প্রচার নির্লিপ্ত ভূমিকা-স্বভাবের কারনে জানিনা অথবা তারা থেকে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে আবার ভারতে গিয়ে কাদের সিদ্দিকীর ‘আমিত্ব’ আরও বাড়ে। আবার দেশে ফিরে তাঁর অস্থির চিত্ত ও ‘আমিত্ব’ তাকে বেশিদিন আর আওয়ামী লীগে থাকতে দেয়নি অথবা তিনি থাকতে পারেননি।
কাদের সিদ্দিকী তখন ভারত থেকে দেশে ফেরার পর তাকে আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক করা না করা নিয়ে মিডিয়ায় লেখালেখি হচ্ছিলো। একটা রিপোর্টের জন্যে তখন মোহাম্মদ নাসিমের মন্তব্য নিতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনের সাধারন সম্পাদক হবার মতো অবস্থা কাদের সিদ্দিকীর হয়নি। উল্লেখ্য তোফায়েল আহমদ, মোহাম্মদ নাসিমের মতো নেতাকে শেখ হাসিনা দলের সাধারন সম্পাদক করেননি। সাধারন সম্পাদক হয়েছেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং এখন ওবায়দুল কাদের। ‘আমিত্ব’ অস্থির কাদের সিদ্দিকী সে অপেক্ষার লোক ছিলেননা। এখনকার কাদের সিদ্দিকীতো ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপ! শেখ হাসিনার চাইতে বেশি বঙ্গবন্ধু প্রেমিক! আলাদা দল করার পর মিডিয়ায় থাকতে তিনি সারাবছরই নানাকিছু করেন! এখানে বসে পড়েন, ওখানে শুয়ে পড়েন! একটা ঘটনা বলি। একবার কোন একটি দাওয়াতে আমরা ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক সখিপুরে গেছি। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। বিএনপির কী একটার ঘটনার প্রতিবাদ করতে সখিপুরে তিনি একটি প্রতিবাদ করছিলেন। ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক এসেছে খবর পেয়ে তিনি রাস্তায় শুয়ে পড়েন। কিন্তু যখন জানতে পারেন এই সাংবাদিকরা কোন রিপোর্টের কারনে না, দাওয়াত খেতে এসেছেন তখন আবার উঠে পড়েন।
মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের দল আওয়ামী লীগে থাকলেননা। কিন্তু দেশের জন্যে বঙ্গবন্ধুর জন্যে তাঁর ত্যাগ ধুয়েমিছে দিলেন ছোটখাটো লোভের অর্থনৈতিক কেলেংকারিতে! নতুবা সোনার বাংলা নামে কোম্পানি খুলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার এতোগুলো সেতুর কাজ নিয়ে সেগুলো কাজ সমাপ্ত না করে বিল তুলে নেবেন কেনো? তার অপকীর্তির এসব অসমাপ্ত-অর্ধ সমাপ্ত সেই সেতুগুলো দীর্ঘদিন এলাকায় এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। লোকজন সেগুলো দেখিয়ে বলতো কাদের সিদ্দিকী কাজ না করে এগুলোর টাকা খেয়ে ফেলেছে! ব্যাংক থেকে ঋন নিলে তা শোধ করতে হয়। ব্যাংক ঋন নিলে তা পরিশোধের সময় সুদও শোধ করতে হয়। শোধ না করলে সেই ঋন সুদ সহ শুধুই বাড়ে। এ নিয়ম দেশের সবার জন্যে সমান। কাদের সিদ্দিকীর এমন খেলাপি ঋনের অংক দশ কোটি ছাড়িয়েছে। কাদের সিদ্দিকী তা শোধ করেননা। শোধ করবেননা। সারাবছর তিনি বড় বড় কথা বলে বেড়ান। বড় কথার মুখ আছে তাঁর মতো মুক্তিযোদ্ধার। কারন এ দেশটার জন্যে তিনি যুদ্ধ করেছেন।
কিন্তু সরকারি কাজের ঠিকাদারি নিয়ে কাজ না করে আর দশটা চোরের মতো বিলের টাকা তুলে নিয়ে যাবেন, ব্যাংক ঋন নিয়ে শোধ করবেননা এসব নিশ্চয় কোন মুক্তিযোদ্ধার কাজ নয়। এসব বড় বেমানান কাদের সিদ্দিকীর মতো মুক্তিযোদ্ধার ইমেজের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের কাছে বিষয়টি অস্বস্তিকর। কাদের সিদ্দিকীর মনোনয়ন আইনত বাতিল হবে এটি সবার মতো তিনিও জানতেন। নতুবা সব ঋনখেলাপিকে নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে। অথচ এবার তাঁর মনোনয়ন স্বাভাবিক বাতিল হয়ে গেলে তিনি বলেছেন, ‘এই সরকার তাকে কোন নির্বাচন করতে দেবেনা’, ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে তিনি আর কোন নির্বাচনে অংশ দেবেননা’ ইত্যাদি! কাদের সিদ্দিকীর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার মুখে এসব কেমন কথা? বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসলে ঋনের টাকা শোধ ছাড়াই তাকে নির্বাচন করতে দেবে? বেআইনিভাবে? ঋনযুদ্ধে এমনই পর্যুদস্ত জেরবার একাত্তরের বঙ্গবীর! আরও লোক হাসানোর আগে বুঝি কাদের সিদ্দিকীর নিজের মুখখানা বন্ধ করা দরকার। প্লিজ।
Related Articles
Don’t Fear Mistakes
We all make mistakes. We are imperfect and vulnerable to making mistakes. Whatever our social standing is, we all make
সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের পথে
সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে “একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা” অর্জনের পথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা গত শনিবার ৩রা সেপ্টেম্বর সিডনির বিশেষ পর্যটনকেন্দ্র খ্যাত
আমি সব পাব, সব খাব: কাব্যহিংসা যখন কবিহিংসা
অজয় দাশগুপ্ত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন একটা বিষয় বেশ বাজার পেয়েছে দেখলাম। কবির লড়াই। সাধারণত এসব বিষয় খুব একটা গুরুত্ব