দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি
সরকারী চাকুরীতে যোগদান করলেই না কি বাড়ি, গাড়ি বিনামূল্যে পাওয়া যায়? বাড়ি তখনও পায় নাই, তবে আমার নামে একটা গাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়। গাড়ি বরাদ্দের চিঠি হাতে পাওয়ার পর আমি তেমন একটা খুশি হই নাই, কারণ সরকারী গাড়ি যেমনই হোক না কেন, আগের চাকুরিগুলার অভিজ্ঞতা থেকে ড্রাইভার সম্মন্ধে কিছুটা ধারণা থাকাতে সরকারী ড্রাইভার কিভাবে নিয়ন্ত্রন করবো সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। দুরুদুরু বুকে সহকর্মিদের উৎসাহে একটা ক্যামেরা নিয়ে গেলাম গাড়িটা দেখতে। প্রথম দর্শনেই সত্যি কথা বলতে আমার মোটেও পছন্দ হয় নাই। কারণ, গাড়িটার গায়ের বর্ণ শ্বেতশুভ্র হলেও তার গায়ের বিভিন্ন ক্ষত তার বয়সের একটা ধারণা দিচ্ছিল। ড্রাইভার সাহেব একজন মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, চোখে চশমা, মুখভর্তি পান আর সারা মুখে স্মিত হাসি। তাকে দেখে এবং তার কথা শুনে ভালোই লাগলো, আসলে সব ড্রাইভারতো আর খারাপ হয় না?
চার চাকা বুঝে পাওয়ার পর এতে আরোহণের জন্য প্রথমদিকে আমাকে এবং সহকর্মি রকিবকে বেশ কসরত করতে হয়েছিল, তবে আমরা দুজনই যেহেতু মেদহীন শরীরের অধিকারী তাই আমাদেরকে তেমন একটা বেগ পেতে হয় নি। গাড়ির দরজাটা ৪৫ ডিগ্রী (কেন ৪৫ ডিগ্রী সেটা পরে বলছি) খুলে, শরীরটাকে ১৩৫ ডিগ্রী বাকিয়ে প্রথমে মাথাটাকে গাড়ির মধ্যে গুজে দেয়া। তারপর সামনের সিটে ঠেস দিয়ে দিয়ে শরীরটাকে ঘড়ির কাটার বিপরীতে ঘুড়িয়ে গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। আর যে জায়গাটাতে পা দিয়ে এই কর্মকান্ডটা করতে হয় সেই জায়গাটা খুবই ঝুকিপূর্ণ, সামান্য এদিক সেদিক হলেই পা ফসকে আপনি পপাতধরনিতল হবেন তা একেবারে অবধারিত।
একদিন আমার রিপোর্টিং বস আমাদের গাড়িতে চড়তে যেয়ে এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আর একবার আমার এক জুনিয়র সহকর্মি গাড়িতে উঠতে যেয়ে মাথায় খেলেন এক গুতা। আর একবারতো আমার সহধর্মিনী গাড়িতে উঠতে যেয়ে পুরোপুরি আটকে গেলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি আর কখনই এই গাড়িতে উঠবেন না। আমি আর রকিব কখনই এই সমস্যায় পড়ি নাই কারণ, আমরা ছিলাম এর নিয়মিত আরোহী।
গাড়িতে চড়ে অফিসে আসা যাওয়া শুরু হয়ে গেলো একসময়। কিন্তু অফিস থেকে ফেরার সময় ড্রাইভার দেখি সাথে সবসময়ই একজন কমবয়সী তরুণ একটা ছেলেকে রাখে, আর অফিসে শেষ হওয়ার সাথে সাথেই অফিস থেকে বেরুতে বলে। আমি মনে করেছিলাম দুরের রাস্তা, হয়তো সে কারণেই সে তাড়াতাড়ি করে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো, কয়েকদিন পরে। একদিন দেখি ছেলেটা নাই, সে বলল, স্যার আজ আপনারা বাসে করে চলে যান। আমরা বললাম, কেন আপনার শরীর খারাপ। সে বলল না। এরপর আমার কাছে এসে কানেকানে বললেন, স্যার আমি রাতের বেলাই ভালো দেখতে পায় না? তাই ছেলেটাকে সাথে রাখি। উনার কথা শুনেতো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড়। বলে কি ব্যাটা! সহকারী রাখার আরো একটা কারণ ছিল, সেটা হচ্ছে গাড়িটার মাঝে মাঝেই স্টার্ট বন্ধ হয়ে যেতো। তখন সহকারী নেমে যেয়ে ধাক্কা দিতো।
এইবার আসি গাড়ির অবস্থা বর্ণনায়। আমি সাধারণত ঢাকার মধ্যে কোন ভ্রমণে ঘুমায় না কিন্তু যেহেতু এখন আর ঘুমায়ে থাকলেও নির্দিষ্ট স্টপেজ ছেড়ে যাওয়ার কোন ভাবনা নেই তাই অফিসে আসার পথে একটু ঘুমিয়ে নেয়ার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। যেই না সিটের উপরের অংশে মাথা রেখে একটু ঘুমোবার প্রস্তুতি নিচ্ছি অমনি সিটের মাঝামাঝি থেকে মনেহল কেউ যেন আমাকে কোন সুচালো বস্তু নিয়ে গুতো দিচ্ছে। ব্যাপার কি? ঘুম বাদ দিয়ে সিটের শরীর হাতড়াতে থাকলাম, কিছুই পেলাম না। আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম এবং একইভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলাম। এইবার ব্যাপারটা বুঝলাম, সিটের উপরের বাড়তি অংশের অপর প্রান্ত যেটা সিটের মধ্যে প্রবেশ করানো। উপরের অংশে মাথা হেলান দেয়ার ফলে লিভারের সুত্র মেনে নিচের অংশ আমার পিষ্ঠদেশে চাপ প্রয়োগ করে ভারসাম্য রক্ষা করছে।
গাড়িটা যখন কালসি দিয়ে যেয়ে ফ্লাইওভার এর উপর দিয়ে যেতো, তখন এমন জোরেজোরে শব্দ করতো, মনেহত যেন আমরা গাড়িতে না হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছি। এবং সেখান থেকে আমার গাড়িটার নাম হয়ে গেলো “হেলিকপ্টার”। আর বারবার মনেহত এই বুঝি গাড়িটার সবকিছু খসে পড়বে। সেই কথাটাও মনেহয় সৃষ্টকর্তা উপরে বসে শুনছিলেন, তাই মিটিমিটি হেসে সেটাও একদিন পূর্ণ করে দিলেন। একদিন অফিসে আসার পথে তালতলা কেবলই পার হয়েছি আমরা। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ কানে এলো। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, স্যার বুঝতে পারছি না। আমি আর রকিব তখন পিছনে তাকালাম। দেখি একটা কালো বস্তু আমাদের গাড়ি বরাবর পিছনে পড়ে আছে। ড্রাইভার গাড়ি সাইড করে সেটা আনতে গেলো, কাছে আনার পর দেখি গাড়ির পিছনের বাংকারের অর্ধেক অংশ।
একদিন রকিবকে আমতলিতে ড্রপ করে আমি উত্তরার দিকে রওয়ানা দিয়েছি মাত্র, হঠাৎ মুড়মুড় শব্দ। পিছনে তাকিয়ে দেখি, গাড়ির দরজা দুটো খুলে কোনমতে ঝুলে আছে। শব্দের কারণে রকিবও গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর ও দ্রুত গাড়ির দিকে ছুটে এসে বলল, ভাই আমি ধাক্কা দিচ্ছি আপনি ভিতর থেকে টেনে ধরেন। আমি কোনমতে টেনে ধরে দরজা দুটোকে আবার আগের জায়গায় দাড় করিয়ে দিলাম। বনানী ফ্লাইওভারে ওঠার আগে আবার একই ঘটনা ঘটলো, ড্রাইভারকে বললাম, দড়ির মত কিছু থাকলে দেন, বেঁধে রাখি। উনি করুণ সুরে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, স্যার কিছু নাই তো। এরপর উত্তরা পর্যন্ত আমি সিটের উপর ১৮০ ডিগ্রী কোণে বসে দরজা দুটো ধরে রেখেছিলাম।
একদিন প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে অফিস থেকে ফিরছি, গাড়ির মধ্যে থেকে এমন জোরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো যে, আমার কাছে মনেহচ্ছিল যেন আমি আসলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছি। ব্যাপার কি দেখতে আবার গাড়ির পিছনে নজর দিলাম, দেখি গাড়ির ছাঁদ বেয়ে বৃষ্টির সমস্ত পানি অঝোর ধারায় গাড়ির মধ্যে পড়ছে। একটু পরে দেখি সেই পানি আমার জুতার তলা ভিজিয়ে দরজা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে গাড়ির ওয়াইপার ঠিকমত কাজ করছে না, দু এক বার মোছার পর সেটা নিচের দিকে এসে স্থির হয়ে গেলো। ড্রাইভার সাহেব, হাতটা বের করে কোনমতে আবার সেটাকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনলো। এমন দুবার করার পর পুরো ওয়াইপারটা খুলে গাড়ির বনেটে পড়ে গেলো। তারপর সেটা ড্রাইভার সাহেব কুড়িয়ে নিয়ে গাড়ির মধ্যে রেখে দিল। তারপর সারা রাস্তা আমি আর রকিব হেল্পারের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। এখানে উল্লেখ্য যে আমাদের গাড়িটাতে একটা পাশেই শুধু ওয়াইপার ছিল।
এইবার আসি দরজার ঘটনায়। গাড়িটার দরজা কখনই আমরা পুরোপুরি খুলতাম না আসলে বলা উচিৎ আমরা পুরোপুরি খুলতে পারতাম না। ৪৫ ডিগ্রী খোলার পর কোথাও এক জায়গায় সে আটকে যেতো আর “ক্যাকক্যাক” টাইপের ভয়ংকর শব্দ করতো। এই শব্দ শুনেই আমরা আর বেশি খুলার সাহস পেতাম না। তবে একদিন ভুলে একটু জোরে চাপ দেয়ার পর বুঝলাম আসল ব্যাপারটা কি? এরপর আর দরজা লাগে না তো লাগেই না। পরে ড্রাইভার সাহেব অনেক কারিকুরি করে সেটাকে লাগাতে পেরেছিলেন।
অনেক আগে ইংরেজি একটা ছবি দেখেছিলাম, “দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি” যেটা আমার দেখা অন্যতম হাস্যরসের ছবি। এই গাড়িটা আমাকে প্রতিনিয়ত সেই ছবির নায়কের গাড়িটির কথা মনে করিয়ে দিত। এবং আমি আপনমনেই হেসে উঠতাম। শেষের তিন মাস গাড়িটা গ্যারেজে আটকা পড়ে ছিল, তাই জীবন থেকে হাস্যরসের একটা উপাদানও হারিয়ে গেল। অফিসের শেষদিন গাড়িটাকে অফিসিয়ালি হস্তান্তর করলাম, মনের গোপন কোণে করুণ সুর বেজে উঠলো। দুঃখ একটাই শেষবেলায় গাড়িটার সাথে আর দেখা হয় নাই।
অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর বাধ্যতামূলকভাবেই একটা চারচাকা কিনতে হয়েছিল। যদিও সেটা চালিয়ে কর্মস্থলে আসা হয় না। হঠাৎ একদিন আমার বর্তমান কর্মস্থলের পিছনের রাস্তায় দেখলাম একটা গাড়ি পার্ক করে রাখা। অবিকল আমার সরকারি অফিসের গাড়ির মত দেখতে তবে অনেক চাকচিক্যময়। সাথে সাথে একসঙ্গে সব স্মৃতি মগজে এসে ভিড় করলো। আর আমি যেহেতু একটু বেশিই সংবেদনশীল মানুষ তাই এই গাড়িটা আমাকে অনেক বেশি স্মৃতিকাতর করে দিল। সাথে সাথে আমি গাড়িটার ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে রকিবকে আর আমার সেই জুনিয়র সহকর্মিকে ট্যাগ করে দিলাম। এরপর একে একে আসতে শুরু করলো হাজারো মন্তব্য। আসলে আমরা যেখানেই যায় সেখানেই একটা পরিচিত পরিবেশ খুজে ফিরি। এই গাড়িটাও হঠাৎ করে আমাকে মনেকরিয়ে দিল দেশের কথা, দেশের গাড়ির কথা, বৃষ্টির কথা।
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
আবুল বাজানদারের চিকিৎসা সংগ্রাম
ফজলুল বারী: একাত্তর টিভির একাত্তর জার্নালে শুক্রবার রাতে বৃক্ষ মানব আবুল বাজানদারকে আবার নিয়ে আসা হয়েছিল। এরজন্য প্রিয় ফারজানা রূপা
রবিবারের মধ্যে করোনা রোগীদের জাহাজকে অস্ট্রেলিয়া ছাড়তে হবে
ফজলুল বারী: অস্ট্রেলিয়ায় করোনা ভাইরাসের এপিক সেন্টার হয়েছে রুবি প্রিন্সেস নামের একটি প্রমোদতরী। এই এক জাহাজ থেকে ছড়িয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যক
এই মেধাবীরা ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ অফিসার হয়ে কী করবে?
বাংলাদেশের মেধাবী নতুন প্রজন্ম বহুদিন পর আন্দোলনে এসেছিল। আমি সব সময় তরুনদের সুযোগ দেবার পক্ষে। এবারের তরুনদের আন্দোলনটি অবশ্য ছিল
নিজের সম্পর্কে অসাধারণ বিবরণ
অসংখ্য ধন্যবাদ।
যেমন আপনার সব লেখাতেই হই তেমনি এটি পড়েও প্রীত হলাম। তবে কথা হচ্ছে আপনার ডেরাইভারটা মনে হয় ভালোই ছিল। নইলে এই জাতীয় লেখার একটা বড় অংশ ডেরাইভারদের দখলে থাকে।
আপনি ঠিকই বলেছেন, ড্রাইভার ভদ্রলোক আসলেই ভালো ছিলেন। ড্রাইভারদের মধ্যে সচরাচর এমন ভালো মানুষ দেখা যায় না। অসংখ্য ধন্যবাদ সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্য।