অস্ট্রেলিয়ার হ্যালোইন সম্প্রীতি
![অস্ট্রেলিয়ার হ্যালোইন সম্প্রীতি](https://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2018/11/দলবেঁধে-চলছে-ক্যান্ডি-সংগ্রহ--890x395_c.jpg)
হ্যালোইনের উৎস বা ইতিহাস কি সেই বিষয়ে আমার ধারণা খুবই কম তবে অস্ট্রেলিয়াতে যেভাবে হ্যালোইন পালন করা হয় সেটাকে আমার কাছে পারস্পরিক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ মনে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর থেকেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ধরে রাখার পাশাপাশি এই দেশীয় সংস্কৃতিতে আমাদের বাচ্চাদের গড়ে তুলতে। আসলে আপনি যদি সংস্কৃতিমনা হন তাহলে আপনার সব দেশের সংস্কৃতির প্রতিই এক ধরণের মমত্ববোধ কাজ করবে এবং আপনি চাইবেন নিজেকেও সেই সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত করতে।
প্রথম বছরে আমাদের পর্তুগিজ বাড়িওয়ালি আমার ছেলে এবং মেয়ের জন্য হ্যালোইনের পোশাক কিনে এনে দিয়ে বলে গেলো প্রতিবছর আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে হ্যালোইন পালন করি চাইলে তোমার বাচ্চাগুলোকেও আমাদের সাথে দিতে পারো।
আমরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। তারপর অক্টোবরের ৩১ তারিখ বিকেলে উনি উনার ছেলেমেয়েকে হ্যালোইনের পোশাকে সাজিয়ে আমাদের মেয়েকেও সাজিয়ে দিলেন এবং নিজেও হ্যালোইনের পোশাকে সাজতে ভুল করলেন না। তারপর দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। উনারা সারা পাড়াময় ঘুরেঘুরে প্রত্যেকটা বাড়ির দরজায় টোকা দিয়ে “ট্রিক অর ট্রিট” বলে ক্যান্ডি সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। আমার ছেলে তখনও হাঁটা শুরু করেনি তাই আমি বাসাতেই থেকে গেলাম। একটু পরে এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে এসে আমাদের দরজায়ও টোকা দিয়ে “ট্রিক অর ট্রিট” বলল। আমরা সাথে সাথে দরজা খুলে তাদের সবাইকে ক্যান্ডি দিয়ে দিলাম। ওদেরকে দিতে যেয়ে আমাদের সামান্য কয়টা ক্যান্ডি শেষ হয়ে গেলো। এই বাচ্চাগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় নেই তবে তারা যে আমাদের প্রতিবেশী সেটা বুঝতে পারলাম। এবং হ্যালোইনের উছিলায় তাদের সাথে ভাবের আদানপ্রদান হয়ে গেলো। ক্যান্ডি পাওয়ার পর ওদের চোখে এক ধরণের ছেলেমানুষি আনন্দ খেলা করছিলো দেখে মনে হচ্ছিলো কেন যে আমরা আরো ক্যান্ডি কিনে আনলাম না।
একদল চলে যাওয়ার পর আরো এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে আসলো একইভাবে “ট্রিক আর ট্রিট” বলে কিন্তু তখন আমাদের বাসায় আর ক্যান্ডি অবশিষ্ট নেই তাই তাদেরকে শুরুতে দুঃখিত বললাম। ক্যান্ডি নেই শুনে ওদের প্রত্যেকের মন এতটাই খারাপ হলো যে দেখে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি কেঁদে দিবে। তখন আমার গিন্নি বললেন আমাদের বাসায় পপকর্ন আছে ওদের জিজ্ঞেস কর নিবে কি না? আমি ওদেরকে সেটা জিজ্ঞেস করতেই ওরা খুবই খুশি হল এবং বলল তাড়াতাড়ি দাও। এইবার আমাদের হ্যালোইনটা অনেক মজার হয়ে গেলো কারণ সবাই ক্যান্ডি দেয় কিন্তু তোমরা পপকর্ণ দিলে। তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। তখন আমি বললাম আমি কি তোমাদের সাথে আমার ছেলেকে নিয়ে একটা সেলফি তুলতে পারি। ওরা বলল অবশ্যই। আমি ওদের মাঝখানে দাঁড়াতেই ওরা বিভিন্ন রকমের ভয়ের পোজ দেয়া শুরু করলো সেটা দেখে রায়ান ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এভাবে ওদের বিদায় করে দিয়ে আমরা আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম দলেদলে ছেলেমেয়েরা হ্যালোইনের সাজে সারা পাড়াময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছিলো একটা বিকেলের জন্য যেন পাড়াটা ভূতেদের পাড়া হয়ে গেছে। সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়িওয়ালি তাঁর দলবল নিয়ে ফিরে এলো। ফিরে এসেই তাহিয়া খুশিতে চিৎকার শুরু করে দিলো। আর দেখাতে লাগলো ও অনেক ক্যান্ডি পেয়েছে। ওর হ্যালোইন ব্যাগ প্রায় ভরে গেছে ক্যান্ডিতে। তারপর সে সেই ক্যান্ডি আমাদের সবার মাঝে ভাগ করে দিলো এবং বলল পাড়ার সবাই খুবই ভালো, সবাই অনেক ক্যান্ডি দিয়েছে এমনকি যাদেরকে চিনি না তারাও অনেক ক্যান্ডি দিয়েছে।
গত দুবছরের ন্যায় এবারও আমরা হ্যালোইন পালন করেছি। গত বছর আমরা নতুন একটা পাড়াতে একটা নতুন বাসাতে উঠেছি তাই এখানেও তেমন কাউকে চিনি না। সেটা শুনে তাহিয়ার বান্ধবী জেইনার মা বলল এটা কোন ব্যাপারই না কারণ আজ হ্যালোইন। সবাই সবার বাড়িতে নক করে “ট্রিক অর ট্রিট” বলে ক্যান্ডি চাইতে পারে। মেয়ে আগেরদিন বলে দিলো বাবা আগামীকাল একটু তাড়াতাড়ি এসো আমরা সবাই মিলে ক্যান্ডি সংগ্রহ করতে যাবো কিন্তু ট্রেনের দেরি হওয়াতে আমারও ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। বাসায় যেয়েই তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে তাহিয়া জেইনাদের বাসায় চলে গেলো তারপর সেখানে জেইনার মা ওদেরকে ভূতের সাজে সাজিয়ে দিলো। আর ছোট্ট রায়ান ভূতের পোশাক পরে সারা বাসময় দৌড়ে বেড়াতে লাগলো। সবকিছু দেখে ছোট্ট জাহিয়া হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালো।
একটু পরেই তাহিয়া, জেইনা আর জেইনার মা বেরিয়ে গেলো ক্যান্ডি সংগ্রহ করতে। সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো দেখে আমি ভেবেছিলাম ওরা হয়তো কোন ক্যান্ডিই পাবে না কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে ওরা বালতি ভর্তি করে ক্যান্ডি নিয়ে বাসায় ফিরলো। ফিরেই তাহিয়া বলল বৃষ্টি না এসে গেলে আমরা আরো ক্যান্ডি সংগ্রহ করতে পারতাম। আমি মজা করে বললাম আকাশ তোমাদের দেখে ভয় পেয়ে কেঁদে দিয়েছে তাই বৃষ্টি চলে এসেছে। কথাটা শুনে তাহিয়া হা হা করে হেসে দিলো তারপর সে ক্যান্ডি ভাগ করতে লেগে গেলো। সন্ধ্যা ভাবি বললেন তোমাদের বাসায়ও অনেকে এসেছিল ক্যান্ডি নিতে কিন্তু তোমরাতো কেউ বাসায় ছিলে না তাই ওদেরকে ডেকে আমরা ক্যান্ডি দিয়ে দিয়েছি।
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর বাচ্চারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করে এই সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত এই হ্যালোইন উৎসবে। প্রবাসী বন্ধুদের সবাই প্রায় হ্যালোইন পালনের ছবি পোস্ট করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে। সেটা দেখে মনেহল ফেসবুকটাও যেন একটা দিনের জন্য ভূতেদের ফেসবুক হয়ে গেছে। আমার বন্ধু আশিকের ছেলে আয়ান আর ইথানও বেরিয়েছিলো ক্যান্ডি সংগ্রহে। লাবণ্য ভাবি তার ফেসবুকে লিখেছেন আয়ান বলেছে এটা ওর জীবনের বেস্ট একটা দিন।
অস্ট্রেলিয়ায় হ্যালোইন উপলক্ষে বিভিন্ন প্রকারের মেলারও আয়োজন করা হয়। সেখানে সবাই ভূত সেজে ঘুড়াঘুড়ি করে। কে কত ভালো ভূত সাজতে পেরেছে তার উপর পুরস্কারও দেয়া হয়। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো সবাই বিভিন্ন রকমের ভুতের পোশাকে নিজেকে সাজাই। এছাড়াও বাড়িগুলোকেও ভূতের বাড়ির একটা সাজ দেয়ার চেষ্টা চলে। হ্যালোইন বিষয়টা ভূত কেন্দ্রিক হলেও এটা আমার কাছে অস্ট্রেলিয়ার পারস্পরিক সম্প্রীতির একটা অনন্য উদাহরণ মনেহয় কারণ এদিন পরিচিত অপরিচিত সবার বাসাতেই হানা দিয়ে ক্যান্ডি চাওয়া যায় “ট্রিক অর ট্রিট” বলে।
![Md Yaqub Ali](https://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2017/12/Yaqub-Ali-150x150.jpg)
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
অরিত্রি ও লেখকের জন্মদিন
আজ ২৩শে ডিসেম্বর। অরিত্রি এবং তার মত ছোট আরও অনেক সোনামনিদের একজন প্রিয় মানুষের জন্মদিন। হ্যা অরিত্রির একজন প্রিয় মানুষ
NAIDOC Week
নেইডক সপ্তাহঅস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় অভিবাসীদের বাসভূমি বা ল্যান্ড অব মাল্টিকালচারাল সোসাইটি। যদিও ১৬০৬ সালে ডাচ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম ইয়্যানজ এবং ১৬৯৭
Research Paper on Dhaka Transport
ঢাকার যাতায়াত ও অন্যান্য সমস্যার একটি নিশ্চিত সমাধান (প্রথম পর্ব) ভূমিকাঃ ঢাকা শহরের যানবাহন সমস্যার সমাধান কি আদৌ সম্ভব ?
Love your writing Yaqub vai.. Always fun to read..