বিশ্বব্যাংক – পদ্মা সেতু

বিশ্বব্যাংক – পদ্মা সেতু

ফজলুল বারী: পদ্মা সেতুর টেন্ডার দূর্নীতি ষড়যন্ত্রের বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ কানাডার আদালতে টেকেনি। সেখানকার আদালত সুনির্দিষ্ট অভিযোগবিহীন মনগড়া মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যে বড় একটি নৈতিক বিজয়। কানাডার আদালতের রায়টি আবার বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠকে ঝাঁঝ দিয়েছে! খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কারন অভিযোগটিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন সরকার কম নাস্তানাবুদ হয়নি। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছে বিশ্বব্যাংক। বিএনপি সহ সরকার বিরোধীরা, তাদের পক্ষ নেয়া নানা পক্ষ এরজন্যে সরকারকে দোষারোপ-গালমন্দ কম করেনি। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়েছে। এক রকম নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে এবং উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়, শাসকদলের মন্ত্রীরা বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু কান্ডের নেপথ্যে গুটি চালাচালির জন্যে ড মুহাম্মদ ইউনুসকে দায়ী করেছেন। যদিও বরাবর অভিযোগটি অস্বীকার করে আসছেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড ইউনুস। এর সবকিছুর উর্ধে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তটি হচ্ছে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানো স্বত্ত্বেও বাংলাদেশ দমে যায়নি। নিজস্ব উদ্যোগ-অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মানের সিদ্ধান্ত হয়। যে সেতু নির্মানের কাজ এগিয়ে চলেছে জোর কদমে। সম্ভবত এটি স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন সরকারের তরফের সবচেয়ে সাহসী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ চাইলে যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবং বাংলাদেশ সরকারের পদ্মা সেতু বিষয়ক সিদ্ধান্তটিও ছিল বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের জন্যে প্রথম চটেপাঘাত। কারন এর আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ বরাবর যে কোন বড় প্রকল্প হাতে বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়ে সব সময় ‘দাও প্রিয়, দাও প্রিয়’ করেছে। আর এবার উল্টো বলেছে ‘তুমি দিলা না দিলা এর পরোয়া করলাম না’! এমন সেতু আমরাই নির্মান করতে পারি।

উল্লেখ্য বিশ্বব্যাংক রামকৃষ্ণ মিশন বা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম জাতীয় কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান না। এটি দুনিয়ার অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। দুনিয়ার দেশে দেশে তারা যে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে এর বিনিময়ে তারা করে সুদের ব্যবসা। পদ্মা সেতু প্রকল্প তারা ঋন সুবিধা দিলে বাংলাদেশে তাদের আরেকটি বড় সুদের ব্যবসার দুয়ার খুলতো। যে কোন ব্যবসা দেখাশুনা করার জন্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় অফিসের মতো ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের অফিস, এখানেও তাদের হেড অফ মিশন তথা একজন আবাসিক প্রতিনিধি আছেন। বিশ্বব্যাংক যেহেতু দুনিয়ার দেশে দেশে মার্কিন স্বার্থের তল্পিবাহক তাই পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে প্রতিষ্ঠানটির সরে যাওয়াটাকে ওয়াশিংটন প্রশাসনের ইচ্ছার প্রতিফলন মনে করা হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঐতিহ্যগত কারনে যে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক ভালোনা তা জানতে বুঝতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদ্যার পন্ডিত হবার প্রয়োজন নেই। আমেরিকাকে সবকিছুতে হ্যাঁ বলেনা শেখ হাসিনার সরকার। আর বাংলাদেশে যেহেতু ড মুহাম্মদ ইউনুসকে মার্কিন স্বার্থের নাম্বার ওয়ান খাস লোক অথবা দালাল মনে করা হয়, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে যেহেতু ড ইউনুসের সম্পর্ক ভালো না, শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে চিরদিন জেলখানায় আটকে রেখে ড ইউনুস যেহেতু ওয়ান ইলেভেন ওয়ালাদের খাস বান্দা হিসাবে রাজনৈতিক দল গঠন, গ্রামীন ব্যাংকের মতো বাংলাদেশ সরকারেরও মালিক বনে যেতে চেয়েছিলেন তাই ড ইউনুসকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভিলেন ভাবাটায় ক্ষমতাসীনদের বেশি চিন্তা করতে হয়নি।
তার ভিলেনগিরি হয়তো সত্য অথবা হয়তো সত্য না। কিন্তু দেশের আমজনতা অথবা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে আম-পাবলিক ভেবেছেন-বিশ্বাস করেছেন পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাবার নেপথ্যের ভিলেন নাম্বার ওয়ান হলেন ড মুহাম্মদ ইউনুস। আবার পদ্মা সেতু প্রকল্পে টেন্ডার দূর্নীতি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ বিশ্বাস করেছেন দেশের বড় অংশের মানুষ! কারন তারা জানেন বাংলাদেশে সাধারন একটি সেতু বা কালভার্ট নির্মানেও প্রায় সবক্ষেত্রে দূর্নীতি হয়। প্রায় সবক্ষেত্রে দূর্নীতি অথবা ব্যক্তি বা দলীয় আনুগত্য-প্রভাব ছাড়া টেন্ডার পাওয়া যায়না অথবা বিলের পরিশোধ পাওয়া যায়না। সে কারনে পদ্মাসেতু প্রকল্পের টেন্ডার নিয়েও দূর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে বা হয়ে থাকতে পারে এমনটি ভেবেছেন দেশের বড় অংশের মানুষ। অভিযোগ আসার পর সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের গদিচ্যুতি, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার তৎপরতা ডাউনের ঘটনা এমন ধারনাকে আরও পোক্ত করে। কিন্তু কানাডার মতো দেশেতো শুধু কোন ধারনা দিয়ে কোন মামলা চলেনা। তাই এই মামলাও সেখানে টেকেনি।

কানাডার আদালতের বার্তাটি আসার পর এতদিন পদ্মা সেতু নিয়ে কাল্পনিক দূর্নীতির অভিযোগকে নিয়ে যারা সরকারকে গালমন্দ করেছেন তাদেরকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ছেলে ও তার তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়। এর একদিন পর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রবীন নেতা ও বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদও একই কথা বলেন। এরপর আইনমন্ত্রী বলেছেন বিশ্বব্যাংককে প্রধানমন্ত্রীর কাছ মাফ চাইতে হবে। আবার আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন উল্টো কথা। তিনি পদ্ম সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন না করা টাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উন্নয়নে কাজে লাগানো অনুরোধ করেছেন বিশ্বব্যাংককে। কাজেই কথাবার্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেনা? এখন আইনমন্ত্রীর কথা অনুসারে বিশ্বব্যাংক যদি মাফ না চায় তাহলে সরকার কী বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে? না তা উচিত হবে?

তবে বিশ্বব্যাংককে পুরো বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিতে হবে। কারন কানাডার আদালতের রায় বলে বিশ্বব্যাংক খুব ফালতু একটি কাজ করেছে। দূর্নীতি ষড়যন্ত্রের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ-ডকুমেন্টস থাকলেতো বিশ্বব্যাংক তা কানাডার আদালতেই তা জমা দিতো। সে রকম কোন সুনির্দিষ্ট ডকুমেন্টস নেই অথচ কোন একটি ধারনা অথবা গায়েবি অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংক যে একটি স্বাধীন দেশকে এ ধরনের কলংক দিয়েছে তাদের দেখাদেখি আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, কানাডার আদালতের সিদ্ধান্তের পর বিশ্বব্যাংকের অবস্থান-ভাবমূর্তি কী দাঁড়ালো এ নিয়ে তাদের একটি ব্যাখ্যা দিতেই হবে। আমার ধারনা সে ব্যাখ্যায় তাদের একটি ‘সরি’ অথবা দূঃখপ্রকাশও থাকবে।

কানাডার আদালতের সিদ্ধান্তের পর বিএনপি দলটির ল্যাংড়াপনাও আরও কদর্যভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই দলটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলো, আবার ক্ষমতায় যেতে চায় কিন্তু তারা প্রতিক্রিয়াটি দেখালো কিভাবে? একটা কাল্পনিক মিথ্যা অভিযোগে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান যে দেশের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করেছে এ কথা বলে এর নিন্দা করলে তাতে বিএনপি দলটির গ্রহনযোগ্যতা বাড়তো না কমতো? এই দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মুখপাত্র রিজভি সাহেব যে প্রতিদিন এত কথাবার্তা বলেন বেশি কথা বললে এর গভীরতা থাকেনা উল্টো দেশের মানুষের কাছে যে তারা ফালতু হন তা কী তারা টের পান?

বিশ্বব্যাংককে এই মূহুর্তে বড় একটি প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য দেখে তাকে তুলনামূলক বাস্তববাদী মনে হয়েছে। কারন তিনি জানেন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে টাকা না দিলেও বাংলাদেশের অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের ঋনের সুদের হারও তুলনামূলক অনেক কম। বিশ্বব্যাংক মুখ ঘুরিয়ে নেবার পর ভারত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে যে সব ঋন নেয়া হয়েছে সে সবের সুদের হার অনেক বেশি। এসব ঋন-সুদ সবকিছু বাংলাদেশের জনগনকে শোধ দিতে হবে। বাংলাদেশের কর কাঠামোর আমুল সংস্কারের মাধ্যমে এমন ব্যবস্থায় যাওয়া উচিত যাতে বিশ্বব্যাংক বা কারো দ্বারস্থ হতে না হয়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি বছর গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময় গ্রীন স্লিপ-পিংক স্লিপ নামীয় ইনসুরেন্স, ফিটনেস সার্টিফিকেট জাতীয় খাতে এদেশের প্রতিটি গাড়ির মালিককে বাংলাদেশের টাকায় দেড় লাখের বেশি টাকা গুনতে হয়। এসব অর্থের বেশিরভাগ যায় নতুন সড়ক নির্মান, সড়ক ব্যবহার, মেরামত রক্ষনাবেক্ষন খাতে। বাংলাদেশের প্রাইভেট কার যাদের আছে তাদের কাছ থেকে বার্ষিক এই পরিমান টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা গেলে, জাতীয় করকাঠামোর আমুল পরিবর্তন করে, আইনভঙ্গের শাস্তি হিসাবে উচ্চহার জরিমানা নির্ধারন-আদায়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে সরকারের আয় আর্থিক সঙ্গতি বাড়বে। তখন বিশ্বব্যাংক জাতীয়দের কাছে হাত পাততে বা তাদের অবজ্ঞা-অপমানের কোন কথা শুনতে হবেনা।


Place your ads here!

Related Articles

Fundraising Dinner donation amount: Thanks from BAAC EC 2013-14

Dear Community Members, BAAC is proud of the Bangladeshi Canberra community for overwhelming responses and the active donation through participating

Saving the rice of Bangladesh from extinction; it is 11th hour

From the foothills of the Himalayas to the shores of Sundarbans and the beaches of Teknaaf is situated one of

দেশে ফিরতে পারেন এনআরসির শিকার বাংলাদেশীরাও

ফজলুল বারী: আমার এ লেখার শিরোনামটি দেখে অনেকে চমকে যেতে পারেন। বিরক্তও হতে পারেন। আমি আমার লেখার প্রশ্নে যুক্তি দেবো।

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment