চালের দাম নিয়ে মন্ত্রীকে চালান করুন

চালের দাম নিয়ে মন্ত্রীকে চালান করুন

ফজলুল বারী: চালের দাম নিয়ে বিশেষ একটি পরিস্থিতি চলছে দেশে। মোটা চালের দাম ৭০ টাকায় পৌঁছেছে। ওএমএস’র চালের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ টাকা করেছে সরকার। চালের গুদামে গুদামে অভিযান থেকে শুরু করে সব মিলিয়ে দেশজুড়ে চলছে অস্থির-অসন্তোষের পরিস্থিতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যে যাই বলুক আমরা সব সময় মনে হয় এটি একটি আবহাওয়া নির্ভর অর্থনীতি। আবহাওয়া অনকুল ঠিক থাকেতো ফসল ভালো হয়তো সবকিছু বিলকুল ঠিক। আবহাওয়া ঠিক না থাকলে খাদ্যে স্বনির্ভরতা থেকে শুরু করে সব গল্পই গড়বড় হয়ে যায়। এবার প্রথমে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওরের সব ফসল তলিয়ে যাওয়া, এরপর প্রলয়ংকরী বন্যায় বাংলাদেশের পরিশ্রমী কৃষকদের ফসল সব চুবিয়ে ধুয়ে নিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি বুঝে ঠিকমতো চাল আমদানির আগাম ব্যবস্থা করতে না পারাটা খাদ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতা। এখন চালের গুদামে গুদামে হানা দিচ্ছেন, এর দায় নিয়ে খাদ্যন্ত্রীর গদিটা দেখেননা? আমার ক্ষমতা থাকলে তাই করতাম। আপনি খাদ্যমন্ত্রী খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ ফেলে সারাদিন এটা সেটা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান আপনার ব্যর্থ নেতৃত্বে চালের দাম যে সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে তা দেখেননা মিঃ কামরুল ইসলাম খান? এসব দেখে শুনে আপনার মাঝে কোন লজ্জা-অনুতাপও কী হয়না? লোকজন অবশ্য বেহায়া হয়ে গেলে কিন্তু এসবের উর্ধে চলে যায়। ক্ষমতায় থাকলে অবশ্য চালের দাম কত বাড়লো না বাড়লো এসব এদের স্পর্শ করতে পারেনা।

চালের দাম নিয়ে কিন্তু এই সরকারের প্রথম দিন থেকেই নানান আলোচনা-বিতর্ক চলে আসছে। এটি অবশ্য বাংলাদেশের সব সরকারের বেলাতেই হয়। সরকার ভালো না খারাপ এর অন্যতম সূচকের নাম হলো গিয়ে চালের দাম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর পরাজিত বিএনপি বলা শুরু করলো আওয়ামী লীগ এখন ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াক দেখি। আওয়ামী লীগের নেতারা জবাব দিতে থাকলেন ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা আমরা বলিনি। সেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই দেশের তালিকাভূক্ত নিম্ন আয়ের মানুষজনকে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর প্রশংসনীয় প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল। বাজারে দাম বাড়লে ওএমএস’এ চাল পাওয়া যাচ্ছিল ১৫ টাকা কেজিতে। সেটি এক লাফে দ্বিগুন অর্থাৎ ৩০ টাকা কেজি করে সরকার স্বীকার করলো চালের বাজারের সংকট সত্য। বাজারে গড়পড়তা মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা মানে ৪০-৫০ টাকা কেজিতে মোটা চাল পাওয়া নিয়েও অবস্থা মোটামুটি সহনীয় ছিলো। কিন্তু এতদিনের সবকিছু এই মূহুর্তে পন্ড। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না বুঝে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতার গল্পটি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পাছে লোকে কিছু বলে এমন নানান দুশ্চিন্তায় খাদ্যমন্ত্রীর টিম চাল কিনতে বেরিয়েছে দেরিতে।

এরমাঝে আবার বাংলাদেশের মানুষের নানান পছন্দ আছে! আতপ চাল না সেদ্ধ চাল! ধান সেদ্ধ করতে বাড়তি খরচ লাগে। তাই সারা দুনিয়ায় সেদ্ধ চালের দাম বেশি। বা আতপ চাল যেভাবে স্বল্প সময়ের নোটিশে পাওয়া সম্ভব সেদ্ধ চাল সেভাবে সময়মতো পাওয়া সম্ভব না। সেদ্ধ চালের ভাত বাড়ে বলে এটি দেশের সিংহভাগ মানুষের পয়লা নাম্বারের পছন্দ। বাংলাদেশের সিলেট-চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ ছাড়া আর কেউ আতপ চালে অভ্যস্তও না। তাই আতপ চাল না সেদ্ধ চাল এটিও এখন ইস্যু। প্রতিপক্ষ বলা শুরু করেছে ‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার অতঃপর দেশের মানুষকে আতপ চাল খাওয়াতেও বাধ্য করেছে!’

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের বেশিরভাগ পরান্নজীবী, ইতর শ্রেনীর। তাই এদের মুখে হিতাহিতজ্ঞানের কোন লাগাম নেই। সরকারে না থাকলে এখানে কথাবার্তার লাইসেন্সও লাগেনা। অথচ মানুষকে সাহায্য করতে একটি সভ্য দেশে সব রাজনীতিক সহ দায়িত্বশীলদের ভূমিকাটা সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাজনীতিকদের এই দায়িত্বটা বেশি। এই অবস্থায় কিছু লোকজন দায়িত্বহীনভাবে দূর্ভিক্ষের গল্পও ছড়াচ্ছেন। বাংলাদেশে কিন্তু দূর্ভিক্ষ আর হবেনা। কারন এত পরিশ্রমী সংগ্রামী মানুষ এখন অনেক দেশেই নেই।

অস্ট্রেলিয়ার চালের বাজারের কিছু তুলনামূলক তথ্য এখানে দিচ্ছি। অস্ট্রেলিয়ায় যে সব আতপ বা সেদ্ধ চাউল হয়, থাইল্যান্ড-চীন থেকে যেসব আতপ বা সেদ্ধ চাল আমদানি হয়ে আসে এসব আতপ-সেদ্ধ চালে আমাদের
বাংলাদেশের লোকজন অভ্যস্ত না। আর এসব দেশের লোকজন আমাদের দেশের মতো প্লেট অথবা গামলা ভর্তি ভাতও খায় না। অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশিরা যে সব চালের ভাত খেয়ে অভ্যস্ত তা মূলত ভারত-পাকিস্তান থেকে আসা বাসমতি রাইস। কেজি ২ ডলার বা এরও বেশি। অস্ট্রেলিয়ান ২ ডলারে যদি বাংলাদেশের ১২৮ টাকাও ধরা হয়, ১২৮ টাকার কেজিতে চাল কী বাংলাদেশের লোকজনের খাওয়া সম্ভব? ৭০ টাকা কেজিতেইতো কথার কিল মাটিতে পড়ছেনা। নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। সেই মানুষজনকে ১২৮ টাকা কেজিতে সেদ্ধ চাল খাওয়াতে বললে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে?

আওয়ামী ফেসবুকারদের অনেকের কাজ হলোতে সবকিছুতে ঠিক আছে ঠিক আছে বলা। চালের মূল্যবৃ্দ্ধি নিয়েও এরা বলে যাচ্ছেন দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আরে বাবা ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে সেটি সত্য। কিন্তু ৪০-৫০ টাকার চাল ৭০ টাকায় কিনতে গেলে সেই ক্রয়ক্ষমতা থেকে যে বাড়তি টাকাগুলো বেরিয়ে যায়, নিম্ন আয়ের সে মানুষজন তাদের জরুরি আরও অনেক কিছু কিনতে পারেনা এটা যে ভোটের বাক্সে ক্ষত সৃষ্টি করে সে বিষয়টি কী সব ঠিক আছে ঠিক আছে গল্পে আড়াল করা সম্ভব? এসব মানুষজনের আক্রোশ বাড়ায়। এরমাঝে কিন্তু দেশের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের পকেট থেকে চাল বাবদ বাড়তি কয়েকশ কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী পোস্টারের লাল দাগের একটি লাইন হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষকে সত্তুর টাকায় চাল খাওয়াতে বাধ্য করেছে। এটাকেও যদি সবকিছু ঠিক আছে বলনেওয়ালারা দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে প্রচার চালান তাহলে কিন্তু আগামীতে খবর আছে। তেতে আছে কিন্তু বেশি দামে চাল কিনতে গিয়ে পুঁজি হারানো বা তুলনামূলক কম খাওয়া লোকজন। আপনি পদ্মা সেতু বানান আর মেট্রো রেল বানান তাতে এই মানুষজনের বড় কোন প্রতিক্রিয়া হয়না। প্রতিক্রিয়া হয় চালের দামে।

এর আগে একবার এই খাদ্যমন্ত্রীর আমলনামায় খাবার অযোগ্য পচা গম আমদানির রেকর্ড আছে। এবার বাজারের এই অগ্নিমূল্য অস্থির সময়ে থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছে খাবার অযোগ্য দুই জাহাজ চাল! খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সতর্ক থাকায় এই চাল বাজারে নামতে না পারায় আরেক কেলেংকারি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সময়ে যদি আমদানি করা দুই জাহাজ চাল বাজারে নামতে পারতো তাহলে তা মানুষকে উপকার দিতো। এখন বাজার নিয়ন্ত্রনে দায়িত্বশীলদের তথা খাদ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার জন্যে তাকে জবাবদিহি না করে চালের গুদামে গুদামে হানা দেবার ঘটনা ভালো নিউজ হচ্ছে ঠিক, কিন্তু আখেরে এর ফলাফল ভালো হয়না। কারন শুধু এখন না সব সময় চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে এই ব্যবসায়ীদেরই সহযোগিতা লাগবে। হাওর ডুবি-বন্যায় ফসল ধংস না হলে কিন্তু চালের বাজারের এই অস্থির অবস্থা সৃষ্টি হয়না।

ব্যবসায়ীদের সিংহভাগ সব সময় মানুষকে বিশেষ পরিস্থিতিতে জিম্মি করে মুনাফা লুটে। তা চাল ব্যবসায়ী হোক আর পরিবহন ব্যবসায়ী যেই হোকনা কেনো। এবং খোঁজ নিলে আরও যে দুর্গন্ধ বেরুবে তাহলো এই ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ সরকারিদলের লোক। এই মূহুর্তে বিএনপির ব্যবসায়ীদের সে সাহস নেই বা বিরোধীদলের ব্যবসায়ীদের সে সাহস থাকেনা। কারন কে হায় ঝামেলায় জড়িয়ে পুলিশকে টাকা দিতে অথবা র্যাবের হাতে জীবন খোয়াতে ভালোবাসে। চাল নিয়ে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি, মানুষের পকেট চুষে নেবার দায় খাদ্যমন্ত্রীর। উনাকে খাদ্যমন্ত্রী করা হয়েছে নিজের মূল কাজ ফেলে প্রেসক্লাব-রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অখ্যাত অথবা বিশেষ চিহ্নিত সংগঠনের সভায় বক্তৃতাবাজি করে বেড়াবার জন্যে নয়। তার ব্যর্থতার দায় ভোগ করতে হবে সরকারকে-শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনা যদি এমন মানুষকে দূর্ভোগে কাঁদানো দু’একজন মন্ত্রীকে মাঝে মাঝে ফায়ার করতেন, শাস্তির ব্যবস্থা করতেন, ছেটে ফেলে চালান করে দিতেন তাহলে মানুষ খুশি-হ্যাপি হতো। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হচ্ছে লতিফ সিদ্দিকীর মতো ছেটে ফেলার নজির দেশে খুব একটা নেই। চালের অগ্নিমূল্য, মানুষের পকেট খালি করায় জড়িতকে ধরে বিদায় করে একটা নজির করুন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী।


Place your ads here!

Related Articles

Trial of Alleged War Criminals and Abettors

The term “war criminal” is a generic term. It refers to a person who allegedly committed any of the three

People’s Power in Pakistan

Ordinarily one connects Pakistan’s politics with military coups. However, this time what occurred in Pakistan on 16th March was for

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment