সম্বর্ধনা নেয়া বন্ধ করুন

সম্বর্ধনা নেয়া বন্ধ করুন

ফজলুল বারী: জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশন থেকে দেশে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছে অথবা তিনি সম্বর্ধনা নিয়েছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি সফলভাবে জাতিসংঘে উপস্থাপনের কৃতজ্ঞতা জানাতে এই সম্বর্ধনা!বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের অবস্থার প্রেক্ষিতে এ ধরনের সম্বর্ধনা দেয়া-নেয়া তথা পথেঘাটে কোন সভা-মিছিলের কথা শুনলেই ভয় করে। এমনিতে ঢাকা সহ দেশের বড় শহরগুলোতে প্রকট যানজটে নাগরিকদের মূল্যবান অনেক কর্মঘন্টার অপচয় হয়। যেদিন ঢাকায় কোন সভা-মিছিল থাকে সে দিন এই দূর্ভোগের বিষয়টি আরও চরমে পৌঁছে। বাংলাদেশে আবার রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর চলাচল উপলক্ষে তাদের নিরাপত্তার কথা বলে নির্দিষ্ট কিছু রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। একবার কোন একটি পথ কিছু সময়ের জন্যে বন্ধ করলে এর রেশ ধরে সারা শহরজুড়ে যানজট চলে সারাদিন। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী প্রায় বিভিন্ন দেশে যান। নানা ইস্যুতে তারা বিবেকের মতো কথা বলেন। কিন্তু আর কোথায় এভাবে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর চলাচল উপলক্ষে সাধারন মানুষজনের চলাচল বন্ধ করে তাদেরকে দূর্ভোগে ফেলা হয় সেটি তাদের অজানা নয়। সারাদিন তারা জনগনের মঙ্গলের কথা বলেন। কিন্তু মানুষের পথ বন্ধ করে দিয়ে কার মঙ্গল হয় সে কথাগুলো তারা বলেননা অথবা তা বলার মতো মুখ তাদের নেই।

এবার প্রধানমন্ত্রীকে সম্বর্ধনা দেবার সিদ্ধান্ত শুনে এর বিপক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছি। আমার কথা, কোন একটি মিলনায়তন বা ঘরের মধ্যে যতখুশি সম্বর্ধনা নিন। কিন্তু তা কোন অবস্থাতে মানুষের পথ বন্ধ করে নয়। ঠিক দেখবেন খালেদা জিয়া যেদিন দেশে ফিরবেন সেদিন তাকেও বিএনপি সম্বর্ধনা দিতে চাইবে। কী উপলক্ষে সম্বর্ধনা? চোখে-পায়ে সফল অস্ত্রোপচারের জন্যে? ছেলেদের পরিবারের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোর জন্যে? এবং তা মানুষের পথ আটকে মানুষকে কষ্ট দেয়া? বাংলাদেশে চলমান এসব অপসংস্কৃতি বন্ধ করত হবে। রাজনীতিকরা ভালো কাজ করলে মানুষ সম্বর্ধনা দেয় ভোটে। কিন্তু সম্বর্ধনার নামে মানুষকে কষ্ট দিলে যানজটে বসে ত্যক্তবিরক্ত মানুষজন যখন গালি দেয় সে সম্বর্ধনায় লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। আমি নগন্য মানুষ। তাই আমার কথা শাসকগোষ্ঠীর কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। মানুষের দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের সম্বর্ধনার উদ্যোগ বাতিল করেছেন। কিন্তু এবার তিনি তা বাতিল করেননি। এরমানে সম্বর্ধনাটি তিনিও চেয়েছেন!

এবার সম্বর্ধনার সিদ্ধান্তের পর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক, সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাস্তায় নয়, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নেত্রীকে সম্বর্ধনা দেবে। এতে করে কোন যানজট বা মানুষের ভোগান্তি হবেনা! দেশের দায়িত্বশীল লোকেরা যদি এভাবে কান্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলেন! ঢাকার ইঞ্জিনীয়ার্স ইনস্টিটিউট বা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে যদি একটি রাজনৈতিক সভা হয় সেটির লোকজন মিছিল করেই সেখানে যায়। যানবাহন তখন যানজটে আটকে থাকে মিছিলের পিছনে! অথবা পুলিশই রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়। এবারেও তাই হয়েছে। বিমান বন্দর সড়কের নানা পয়েন্টে লোকজন উড়ে যায়নি। মিছিল করেই গেছে। টেলিভিশনে দেখলাম বিভিন্ন পয়েন্টে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মীরা শ্লোগান দিচ্ছে। কিছু নেতাকর্মী হাঁটাচলা করছে রাস্তার ওপর। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই! প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থে রাস্তার যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিমান বন্দরের গোল চত্বরেরও আগে। তাতে লাভ কি হলো? মানুষতো কষ্ট পেলো যানজটে আটকা পড়ে।

মুমুর্ষ একটি শিশুকে নিয়ে একটি এম্বুলেন্সকে রাস্তায় আটকের নিউজ ছাপা হয়েছে একটি জনপ্রিয় অনলাইনে। সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তা তার বসের কাছ এম্বুলেন্সটির ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়েছিলেন। নির্দেশনা এসেছে প্রধানমন্ত্রী না যাওয়া পর্যন্ত একটি গাড়িও যাবেনা। এ কেমন অমানবিক পুলিশ! যে একটি রোগীসহ এম্বুলেন্স আটকে রাখার নির্দেশনা দেয়! বাচ্চাটি যদি সেখানে মারা যেতো তাহলে কী প্রধানমন্ত্রীর গৌরব বাড়তো?

শুধু সম্বর্ধনা না, মানুষের পথ বাধাগ্রস্ত করে এমন সভা-মিছিল বন্ধে বাংলাদেশপ রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নেবার এখনই সময়। প্রেসক্লাবের সামনে বা যে কোন জায়গায় রাস্তা বন্ধ করে বা মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বিধ্নিত করে এমন সব ধরনের মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। মিছিল সমাবেশ আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার মানলাম। কিন্তু আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার বহাল রাখতে আপনি আরেকজনের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারেননা। এটা এনার্কি। সভা যত খুশি মিলনায়তনে করুন। কিন্তু সেটি যেন রাস্তায় স্বাভাবিক যান চলাচলে কোন ব্যাঘাত না ঘটায়। প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিজে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সভা করছেন। সেটিকে কেন্দ্র করে রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বিএনপিকে সভা করার অনুমতি দিচ্ছেননা। বিএনপি সমাবেশ করছে তাদের নয়াপল্টনের অফিসের সামনে। তাতে লাভ কী হচ্ছে? রাস্তাতো বন্ধ হচ্ছে। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু রাস্তা আটকে জনসভাকে কেন্দ্র করে মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে এটা কী দলটির কান্ডারিরা একবারও ভাববেননা? এসব অবিবেচক অমানবিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়া রুখতে হবে। প্রেসক্লাবের সামনে হোক যে কোন জায়গায় হোক পুলিশের আগাম অনুমতি ছাড়া কোন সভা-মিছিল করতে দেয়া যাবেনা। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা কোন রকম স্বেচ্ছাচারিতাকে । সময় বদলেছে। দুনিয়াজুড়ে প্রতিবাদের ধরনও বদলেছে। সময়জ্ঞান যাদের নেই রাজনীতি করতে কেউ তাদের হাতেপায়ে ধরেনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি অনুরোধ, অনেক কিছুতো করলেন এবং করছেন, আপনার যাতাযাত উপলক্ষে রাস্তা বন্ধ করার জুলুম বন্ধের উদ্যোগ নিন। এতে মানুষের জুলুম হয়। পারলে কর্মসূচি সব আপনার অফিসে নিয়ে আসুন। প্রয়োজনে শহরের ভিতরে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের জন্যে ছোট কোন হেলিকপ্টার ব্যবহার করুন। কিন্তু মানুষের পথ বন্ধ করার সংস্কৃতি বন্ধ করুন। মানুষের পথ আটকানো বন্ধ করা গেলে বাংলাদেশের কর্মপাগল মানুষজন আরও সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে। এতেতো দেশেরই লাভ। অর্থনীতির সূচক বলুন বা যাই বলুননা সবই তখন শুধু উপরের দিকে উঠবে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে চায়। উন্নত দেশগুলোর সভা-মিছিল কিভাবে হয় তা আপনারা জানেন। বিদেশে গেলে সবকিছু দেখবেন দেশের বিমান বন্দরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তা ভুলে যাবেন, আমাদের রাজনীতিকদের এ সংস্কৃতি ত্যাগ করতে হবে। সরকার কথা শোনেনা? এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে করুন। আমজনতার সঙ্গে জুলুমবাজি করবেননা।
অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিবাদের গল্প এখানে শেয়ার করছি। পার্থের কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন। পার্থে লোকজন কম। বাংলাদেশিও কম। সিডনিতে লোকজন বেশি। বাংলাদেশি বেশি। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ-বিএনপির গ্রুপিং, দল-উপদলও এখানে বেশি। শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে সিডনিভিত্তিক বিএনপির গ্রুপগুলো প্রতিবাদ দেখাতে পার্থে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এদেশের পুলিশ তাদের সে অনুমতি দেয়নি। এখানকার পুলিশ মূলত কেউ কোন প্রতিবাদ-সমাবেশ করতে চাইলে সমাবেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহ নানা সহায়তা করে। কিন্তু পার্থের পুলিশ সিডনি ভিত্তিক বিএনপির গ্রুপগুলোকে তাদের প্রতিবাদের অনুমতির আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বললো, এখানে একসঙ্গে এতদেশের সরকার প্রধান এসেছেন যে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল পুলিশ। কারন এত পুলিশ তাদের নেই। কমনওয়েলথ সামিট উপলক্ষে নিউজিল্যান্ড থেকে পুলিশ ভাড়া করে আনার কথা জানিয়ে বিএনপির গ্রুপগুলোকে জানানো হয়, সরি আমরা আপনাদের প্রতিবাদের নিরাপত্তার জন্যে পুলিশের ব্যবস্থা করতে পারবোনা। পুলিশ অনুমতি না দেয়ায় স্থানীয় বিএনপির অনেকে খুশিও হয়েছিল।

কারন সিডনি থেকে পার্থ বহুদূর। বিমানে যেতে সাড়ে চারঘন্টার বেশি সময় লাগে। সিডনি থেকে পার্থে প্রতিবাদ দেখাতে যেতে প্রতিজনের কমপক্ষে হাজার ডলারের বেশি লাগতো। বিদেশে যারা দেশের রাজনীতি করেন তারা এমন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার মতো তা নিজের টাকাতেই করেন। পার্থের পুলিশ অনুমতি না দেয়াতে তাদের এমন জনপ্রতি হাজার ডলারও বেঁচে যায়। এরপর প্রতীকি প্রতিবাদের উদ্যোগ নেয়া হয় সিডনিতে। এখানকার পুলিশের অনুমতি নিয়ে সিডনির হাইডপার্কে প্রতিবাদ করা হয়। কিন্তু পুলিশ এই প্রতিবাদকারী কাউকে রাস্তায় নামতে দেয়নি। মানুষের স্বাভাবিক পথ চলাচল এমন খুবই গুরুত্বপূর্ন এইসব দেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উদ্যোগটি নিতে পারেন। তবে এর আগে তার ও তার দলের মানুষের পথ আটকানোর সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।


Place your ads here!

Related Articles

Ebarer Shongram… Kintu Mukti Kothy?

এবারের সংগ্রাম… কিন্তু মুক্তি কোথায়?জাতির জনক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ডাক দিয়েছিলেন আন্দোলনের। বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। কিন্তু

দখল বানিজ্যে আওয়ামী লীগ এগিয়ে – হিন্দুদের জমি/সম্পত্তির লোভ

পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার ছিলোনা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃ্ত্বে আওয়ামী লীগের সংগ্রামে তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই কৃতজ্ঞতায়

আগে দর্শণধারী পরে গুণবিচারি

এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে আকার এবং বর্ণের এত বৈচিত্র যা পৃথিবীর অন্য কোথাও মনেহয় দেখা যায় না। এর জন্য অবশ্য

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment