জঙ্গি

জঙ্গি

ফজলুল বারী: মনটা খুব বিষন্ন কয়েকদিন। দেশে একের পর এক জঙ্গি আস্তানা চিহ্নিত হচ্ছে। বিদেশে আমরা যারা থাকি সারাক্ষন দেশের বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন, নিউজ পোর্টালে চোখ রেখে দেশ দেখি-দেশের জঙ্গে থাকি। ভালো খবরে মন খুশি হয়। ভালো খবর কম হয়। জঙ্গি আস্তানাগুলো চিহ্নিত হবার খবর-ছবি মূহুর্তে চলে যাচ্ছে বিদেশি মিডিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ার পরিচিত সাংবাদিকরা এসব দেখে ফোন করে বিস্তারিত জানতে চান। মনটা তখন বড় হয়না। এদের কত বড়াই করে বলি, আমাদের দেশটা পাকিস্তান বা আফগানিস্তান না। এত কিছু স্বত্ত্বেও ভালো খবর হচ্ছে এসব বিষয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দা দক্ষতা বেড়েছে। জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত হবার পরপরই অপারেশনে যাচ্ছে পুলিশ-র্যাব-সোয়াত-সেনা কমান্ডোরা। তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু জঙ্গিরা আত্মসমর্পন, ধরা না দিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে। নারী-শিশু সহ নিজেদের আস্তানার সব জঙ্গি একসঙ্গে আত্মঘাতী হয়ে প্রাণ দিচ্ছে! তাদের লাশ পর্যন্ত চেনা যাচ্ছেনা! বেহেস্তে যাবার নাম করে কী বিভীৎস এই খেলা!

সিলেটের আতিয়ার ভিলার আস্তানা ঘেরাও’এর পর জঙ্গিরা যখন চিৎকার করে জানান দেয়, ‘ফোর্স পাঠাও, সোয়াত পাঠাও, আমাদের সময় কম’, তখন ভয় ধরে। তারা মরবে কিন্তু ধরা দেবেনা! মগজটা কি রকম ধোলাইকৃত! আতিয়ার ভিলায় মজুত বিস্ফোরকের খবর শুনে প্রথম সবার ধারনা হয় জঙ্গিদের প্রস্তুতির ধরন পাল্টেছে বাংলাদেশে। একদিকে জঙ্গি নির্মূল অভিযান আরেকদিকে বোমা বিস্ফোরনে দুই পুলিশ, এক র্যাব কর্মকর্তাসহ কয়েক মৃত্যু, অর্ধশতের বেশি আহতের ঘটনা চিহ্নিত করেছে আমাদের দেশীয় অপারেশনের ঢিলেঢালা অবস্থা, ততদিক কৌশলী-ডেডিকেটেড জঙ্গি অপারেশন! বাংলাদেশ পক্ষ দাবি করেই যাচ্ছে দেশে আইএস নেই! কিন্তু যারা আছে তারা কী আইএস এর চেয়ে কম শক্তিশালী? কম সংঘবদ্ধ? আইএস ছাড়াই বাংলাদেশীয়রাই যদি এতো সংঘবদ্ধ হতে পারে তাহলেতো তা আরও ভয়ের। এত গ্রেনেড-বিস্ফোরক এরা কোথায় পাচ্ছে? যে সব বাড়িঘর এরা ভাড়া নিচ্ছে টাকা-পয়সাওতো কম নয় তাদের। এরা আইএস সংশ্রবহীন হয়ে থাকলে এদের এসব অস্ত্র-অর্থের যোগানদাতা কারা?

জঙ্গি অপারেশন নিয়ে কোন কোন বিএনপি নেতার বক্তব্য রাগ আরও বাড়ায়। এদের প্রিয়জন মতিউর রহমান নিজামীর ‘বাংলাভাই নামে কিছু নেই, সব মিডিয়ার সৃষ্টি’ জাতীয় সাফাই সাক্ষীর কথাতো কেউ ভুলে যায়নি। সেই বাংলা ভাই পরে ধরা পড়েছে। এখনকার আরও স্মার্ট-জঙ্গিরা ধরা না পড়ার শপথে আত্মঘাতী হচ্ছে। তাদের ধরতে গেলে গ্রেনেড ছুটছে, বিস্ফোরক বেঁধে রাখছে পথে! মারা পড়ছেন পুলিশ-র‍্যাবের অফিসাররা। আর বিএনপি বলে যাচ্ছে এসব নাটক! জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই জঙ্গিদের মেরে ফেলা হচ্ছে। এসব কিন্তু পুলিশ-র‍্যাবের প্রতি দায়িত্ব-কান্ডজ্ঞানহীন উস্কানি। এতে পরিস্থিতি আরও বিস্ফোরক হচ্ছে। কেউ দায়িত্ব-কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে গেলে মিছিল-মিটিং করতে দিলে আর জঙ্গি হামলা হবেনা জাতীয় আবালের মতো কথাবার্তাও বলে!

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিপদ হচ্ছে এরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মকে ব্যবহার করছে। এরা মুসলমান। এরা প্রকৃত মুসলমান না এসব কথা জোরের সঙ্গে বলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। কিন্তু বিএনপি বা এখানকার ইসলাম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ কী কথাগুলো সেভাবে বলছেন? কেন নয়? প্রায় দেখি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে বা এখানে সেখানে সরকারি মাওলানাদের মিটিং’এ জুমার খুতবা সহ নানা প্রচারনায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বলতে তালিম দেয়া হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বেরিয়ে এরা যান কোথায়? বা দেশের কোথায় কোথায় মাওলানাদের মাধ্যমে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালাচ্ছেন? না হয়ে থাকলে কারন কী এর? শরমটা কোথায়? না রসুনের গোড়াটা এক জায়গায়?

বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উত্থানে আন্তর্জাতিক কারন ও স্বদেশীয় রাজনীতি আছে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এত আওয়ামী লীগার-ছাত্রলীগার এর আগে কেউ দেখেনি! সেখানে আজ এত জঙ্গি আস্তানা কেনো? এর উত্তর ওয়াকিফালরা জানেন। গোটা অঞ্চলের ব্যবসা-বানিজ্য-মিডিয়ার বেশিরভাগ এখন জামায়াত-শিবিরের দখলে। তারা এসব নিরাপদ রাখতে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগার-ছাত্রলীগারদের চাঁদা দিয়ে চলেন! অতএব শেখ হাসিনার সৈনিকেরা সেখানে এখন শুধু চাঁদার পরিমান দেখেন! আর কিছু দেখেননা! এসব নব্য আওয়ামী লীগার-ছাত্রলীগাররা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নীতি-আদর্শ এসবের কিছুই জানেননা বা পড়েননা। চারপাশে যে জঙ্গি আস্তানাও গড়ে উঠেছে তা তারা জানেননা। কারন এসব জঙ্গিরা কাউকে চাঁদা দিয়ে চলেনা।

বাংলাদেশে এবার স্বাধীনতা দিবসের দিন ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী! কারন বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধে চিহ্নিত পথ হারিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সব ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো একযোগে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে। পরিচিত সব আলেম-পীররাও ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে-পাকিস্তানের পক্ষে। এরা শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেনি, দেশের অসহায় মেয়েদের ভোগ করেছে, গণিমতের মাল হিসাবে দেশের মেয়েদের সম্ভ্রম সাপ্লাই দিয়েছে পাকিস্তানিদের কাছে। পাকিস্তানিরা হেরে যাচ্ছে দেখে হত্যা করেছে এবং হত্যা করিয়েছে দেশের বুদ্ধিজীবীদের। শুধু তাই না বাংলাদেশ হয়ে যাবার পরে চেষ্টা করেছে বাংলাদেশকে যাতে কেউ মেনে না নেয়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়।

এসব অভিজ্ঞতায় স্বাধীনতার পর বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়।বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ফিরে আসার ব্যবস্থা করে। কারাগারে আটক স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়। এদের অনেকে জিয়ার দলে চান্স পায়। অনেকে ফিরে যায় যার যার পুরনো দলে। বাংলাদেশ ফিরে যায় পুরনো পাকিস্তানি ধারায়। জিয়ার পর এরশাদও এই ধারাটিকে শুধু লালনপালন না তার শয়তানি-ধান্ধাবাজিতে ধর্মকে যেখানে যেভাবে ব্যবহার করা যায় তাই করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধর্মহীনতার অভিযোগ আনা হয়। এটা সামাল দিতে আওয়ামী লীগও নিজেকে আগের ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষের দল না আমি-আমরা কম ধার্মিক না তা প্রমানে উঠে পড়ে লেগে যায়!

বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকে অথবা যেতে চায় এমন তিনটি দলই এখন নির্বাচনের আগে হজ-উমরাহ করতে যায়। হযরত শাহ জালাল(রাঃ), শাহ পরানের(রাঃ) মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে। দেশজুড়ে যে ঘুষ দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য এসব নিয়ে রাজনীতি করা ছাড়া এসবে অনীহা-নিরাশক্তি কারো নেই। বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারাও ঘুষ-দূর্নীতির প্রশ্নে উচ্চকন্ঠ না। কারন এসব দূর্নীতিবাজরাই তাদেরকে টাকা-পয়সা দেয়। তারা শুধু খেয়াল রাখেন দেশের কেউ নাস্তিক হয়ে গেল কিনা, কেউ কোথাও মূর্তি বানালো কিনা! রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, জঙ্গি সবার টার্গেট বেহেস্তে যাওয়া। জঙ্গিরা বেহেস্তে যেতে চায় ডাইরেক্ট। অন্যরা নিজের তালগাছটা ঠিক রেখে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে জঙ্গির মৃত্যুর পর তার পারিবারিক পরিচয়েও আওয়ামী পরিবারেরও নাম আসছে! জঙ্গি সৃষ্টির মালমশলা সব রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রে সমাজে অবারিত করে রেখেছে। ধর্ম নিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক দেশগড়ার কথা বলে সৃষ্ট বাংলাদেশে যে কেউ একটি ধর্মীয় দল করতেই পারে। গণতান্ত্রিক দলের ক্ষমতার উৎস জনগন। ধর্মীয় দলের ক্ষমতার উৎস আল্লাহ অথবা সৃষ্টিকর্তা। একটি দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধানের সঙ্গে যা সাংঘর্ষিক। কিন্তু শুধু ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কব্জায় রাখার স্বার্থে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দলগুলোকেও আইনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে! এর সবকিছুবাংলাদেশকে এর মুক্তিযুদ্ধ চিহ্নিত পথে ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত চলতি অসৎ পথ থেকে মুক্তি নেই।


Place your ads here!

Related Articles

Test_Page

Test form Test Page Test Page

প্রবাসে বারোয়ারী পূজা

প্রবাস জীবনেও শারদীয়া দুর্গাপূজা এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে প্রতিবছরই পালিত হয়ে আসছে। শারদীয়া দুর্গাপূজার সার্বজনীনতা

শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই

আজ ২৪ এপ্রিল। তোয়াব খানের ৮২ তম জন্মদিন। নট আউট ৮২! ইনি সাংবাদিক তোয়াব খান। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব।

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment