ক্রিকেট এবং বাঙালির বর্ষা প্রেম
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমনি ঘনঘোর বরিষায়।
অধিকাংশ জনপ্রিয় বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের প্রিয় ঋতু বর্ষা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, প্রমথ চৌধুরী থেকে শুরু করে এরশাদীয় কবি সৈয়দ আহসান আলী এবং আমাদের সময়ের ক্রেজ হুমায়ুন আহমেদ- সবাই বর্ষা ঋতুকে নিয়ে অনেক গান, গল্প, কবিতা প্রবন্ধ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক জনপ্রিয় গান বর্ষাকে নিয়ে। ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘বহু যুগের ওপার হতে বর্ষা এলো’, ‘আজি ঝরো ঝরো ‘, ‘রিমিক ঝিমিক ঝরে’, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’….. এমন কত গান! রবীন্দ্রনাথ তার নতুন বৌঠানের সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছেন, একসাথে দোলনায় দুলতে দুলতে নতুন কোন গানের বাণী শুনিয়েছেন, এমনকি প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের সময় অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতেও গানের বাণী মনে গেথে নিয়ে বাড়িতে ফিরে লিখেছেন। ‘শাওন রাতে যদি…..’ নজরুল না লিখে যেতেন, তবে এইকালের দেবদাসদের যে কি হইতো! ইস্কুলে প্রমথ চৌধুরীর ‘বর্ষা’ প্রবন্ধ অনুসারে বর্ষায় বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুখস্ত করে লিখতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’ তেও সেই বর্ষার বর্ণনা ছিল… তখন খুব বোরিং লাগতো, কারণ মাথায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ক্যালকুলাস খেলা করতো। ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায়তো আর কবিতা আসবে না। তবে বৃষ্টিকে এক মহান শিল্পের পর্যায়ে এনেছে তামিল এবং হিন্দি সিনেমা। আহ, অপেক্ষায় থাকতাম কখন সেই আকাঙ্খিত বৃষ্টি হবে। সিনেমা দেখে পোষাইতো না তাই বনানীর ‘Rose Valley’ থেকে ১৮০ টাকা দিয়ে (তখন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বেতন পেতো ১৪৭০ টাকা) একটা Video cassette রেকর্ড করিয়ে এনেছিলাম যার টাইটেল ছিল ‘শাওন কি গীত’। নামেই যার পরিচয়! শুধুই বৃষ্টির গান। অনেক বৃষ্টির গানের মাঝে ‘নেমক হালাল’ ছবিতে লম্বুস্তান অমিতাভ যে ভাবে স্মিতা পাতিলের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ‘হাম লোপাট যায় তো আপভি লোপাট যাইয়ে’- অতুলনীয় মনে হয়েছে আমার কাছে। বিশ্বাস না হলে ইউটুবে এখনই দেখতে পারেন। টালিউড আর আমাদের ঢালিউডও বলিউড অনুকরণে বৃষ্টির গান চালু করে কিন্তু তাতে না ছিল কোনো আর্ট না পরিকল্পনা- ছিল শুধুই ক্ষেতামি। এফ কবির চৌধুরী সবচাইতে বেশি ভিজিয়েছে অনজুকে। সওদাগর ছবি যারা দেখেছেন তারা জানেন দর্শক কি দেখেছে। এক কথায় বৃষ্টির অপব্যবহার। আমাদের অধুনা হুমায়ুন স্যারতো সুযোগ পেলেই তার সিনেমাতে নতুন নায়িকা আর লাক্স বিউটিদের বৃষ্টিতে ভিজিয়েছেন। নুহাশ পল্লীতে অন্যদের সাথে নিয়ে নিজেও ভিজেছেন, টিনের চালার ঘরে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনেছেন। সিং মাছ- আলু সালুনের পাতলা ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছেন। আহ সুখ কত পদের হইতে পারে!
কবি সাহিত্যিক আর সিনেমা পরিচালকদের কাছে বর্ষা প্রিয় হলেও, পুরো দেশবাসীর কাছে অতি বা হটাৎ বর্ষা কতটুক প্রিয় প্রশ্ন সাপেক্ষ। একদিন ঢাকার নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম মুহূর্তে কি করে হাটু পানি জমে যায়, আর সেই পানির কি বিবিধ বর্ণ ও গন্ধ! ঐদিন বর্ষাকে খুব কষে অভিশাপ দিয়েছিলাম। ফুটবল দেখতে গিয়ে বৃষ্টি এলে তো সৃষ্টিকর্তাকেও ছেড়ে কথা কইতাম না। বৃষ্টির পর শান্তিনগর-মালিবাগ এলাকায় গুয়ের পানি আর বৃষ্টির পানির মাঝে যে একবার পড়ছেন তার বর্ষাকে ভালোবাসার কোনো কারণ নাই। যে দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে কোনো সভ্য সিস্টেম নাই, সেই দেশের লোকজনের বর্ষা প্রীতি নাই থাকার কথা। তবে দেশের কৃষি এবং পরিবেশের জন্য বর্ষা একান্ত প্রয়োজন, আমাদের মতো কিছু স্বার্থপর শহুরে মানুষের জন্য না হলেও।
১৯৭১ এ বাঙালি জাতি একাত্ব হয়েছিল স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে। গেলো শনিবার বাঙালি জাতিকে একাত্ব করেছিল বর্ষা বা বৃষ্টি। শহর-বন্দর-গ্রাম গঞ্জে সবার একই প্রার্থনা ছিল: বৃষ্টির জন্য যেন অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড খেলা যেন পন্ড হয়ে যায়। যেহেতু বাংলাদেশ দলের আর কিছুই করার ছিল না, তাই পুরো জাতি বৃষ্টির কাছে ধর্ণা দিয়ে বসেছিল। ইংল্যান্ড যে ভাবে খেলেছিল, এমনিতেই জিতে যেত, বাঙালির প্রার্থিত বৃষ্টি ছিল ‘icing on the cake’ . ঐদিন বাঙালি ঈশ্বরবাদী হয়ে গেছিলো। আর ঈশ্বরও বাঙালি হয়ে গেছিলো।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ সেমিতে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে খেলুক, কিন্তু এই প্রোটিয়াসরা বড় খেলাতে কাপড় নষ্ট করে ফেলে; ‘চোকার’ অপবাদ আর ঘুচাতে পারলো না। ভারত দলের হামবড়া ভাব দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। আর এদের কিছু প্লেয়ারের ছোটোলোকিপনা দেখলে মনে হয় আরে এরা তো …. দেশের! এদের দলনায়ক কি ভাবে মাঝের আঙ্গুল দেখায়? আমি পাকিদের একেবারেই দেখতে পারি না, তবে জাভেদ মিয়াঁদাদ একবার ভারতীয় উইকেট কীপার কিরণ মোরেকে অনুকরণ করে যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে ভ্যাংচি কেটেছিল, খুব মজা পেয়েছিলাম। কিরণ মোরে বল ধরেই লাফাতো আর শুধু আপিল করতো! আর বোম্বাইয়া গাভাস্কারের আলাপ শুনলে মনে হয় ভারতীয় ছাড়া আর কেউ ক্রিকেট বুঝেনা। এই বোম্বাইয়া গ্রূপের অনেক আমলা কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭১ এ বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্টা পাল্টা উপদেশ দিতো!
বাংলাদেশ আর ভারত দলের ক্রিকেট শক্তির মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না শুধু মাত্র অশ্বিন ছাড়া। বাংলাদেশ দলে এর মতো একটা স্পিনার থাকলে বাংলাদেশ নিশ্চিন্তে ফাইনালে চলে যেত। তবুও বাংলাদেশ যদি তার সেকিনেস ছেড়ে ‘বিগ ভারতকে’ জাস্ট আরেকটা ক্রিকেট দল মনে করে খেলে, তাহলেই চলবে। বাংলাদেশ তো ভারতকে আগেও হারিয়েছে, ভিরাট কোহলিকে শূন্য রানেও আউট করেছে। সুতরাং ভয় কি?
আমাদের মানসিবও বলছে Bangladesh even could be the champion! পান্না আর আমি বলেছি, “বাবা তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক”।
মানসিব জিজ্ঞাসা করে, ‘What।s fulchondon?” আমরা হাসি।
Related Articles
উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক
উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক , বিলকিস রহমান রচিত প্রথম গ্রন্থ, তাঁর গবেষণার আলোকে লেখা। পড়ে শেষ করলাম বইটি,
প্রবাসী সংগঠনগুলো থেকে প্রবাসীদের প্রত্যাশা !
সকল প্রবাসী সংগঠক ,নেতা ,কর্মী সুশীল ও গুনীজন সমীপে – দেশীয় সংস্কৃতিকে লালন করাই হোক অথবা প্রবাসের সামাজিক জীবনে পরিবর্তনের
এস হে বৈশাখ
নিশি অবসান প্রায় ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত !! বন্ধু হও শত্রু হও