অস্ট্রেলিয়ার ঈদ

অস্ট্রেলিয়ার ঈদ

ফজলুল বারী: বাংলাদেশের মিডিয়ায় এখন শুধু ঈদের কেনাকাটা আর বাড়ি যাবার ছবি। এখানে আমাদের অস্ট্রেলিয়ায় আমরা যারা বাংলাদেশের হয়ে থাকি তাদের এসব নিয়ে কোন ব্যস্ততা নেই। অনেকের হয়তো দেশ থেকে নতুন পাঞ্জাবি বা ড্রেস এসেছে। তবে আমাদের বেশিরভাগ দেরাজে তুলে রাখা পুরনো কোন একটা পাঞ্জাবি পরে নেবো ঈদের দিন। সেটি পরে ঈদের জামাতে গিয়ে নামাজ পড়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বাসায় ফিরে সেটি খুলে প্রতিদিনের পোশাক পরে চলে যাবো কাজে। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় ঈদের কোন সরকারি ছুটি নেই। অনেকে এদিনটি তাদের বার্ষিক ছুটি থেকে বা ঐচ্ছিক ছুটি হিসাবে চেয়ে নেন। বেশিরভাগ লোকজনের বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের কাজ করলে মাইনে কাজ না করলে মাইনে নয়। সে কারনে একদিনের কামাই বিসর্জন দিয়ে ঈদ করবেন এমন লোকজন এদেশে খুব বেশি নেই।

ঈদে যে এদেশে পোশাক ক্রেজ সে রকম নেই এরকারন বেশিরভাগ লোক সারা বছরইতো পছন্দের জামাকাপড় কেনেন। আর বাঙালির পোশাকের তেমন প্রচলিত সে রকম কোন দোকানও এখানে নেই। কিছু লোকজনের বাসাবাড়ির কোন একটা রূমে দেশ থেকে আনা অথবা এখানে বানানো পোশাকের পসরা নিয়ে কোন একটি সাইড বিজনেস থাকে। কিছু এলাকায় ভারতীয় কিছু দোকান আছে শাড়ি-পাঞ্জাবি বা থ্রি-পিসের। কিন্তু হাতে গোনা কিছু লোকজন ঈদ উপলক্ষে সে সব দোকানে কেনাকাটা করতে যান। কারন আমরা এখানে পনেরো-কুড়ি ডলারের মধ্যে শার্ট-টি-শার্ট কেনার মানুষ। ওইসব দোকানের একটা পাঞ্জাবি-শাড়ির দামতো চল্লিশ-পঞ্চাশ ডলার দিয়ে শুরু হয়। একদিন কয়েক ঘন্টার জন্যে অত দামে কেনা পোশাক পরার বা এর পিছনে খরচের সৌখিন মানুষজন এদেশে কম। এখন আবার শীতকাল চলছে অস্ট্রেলিয়ায়। শীতে শুধু পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ানোর লোকও এবার কম হবে। আর জমজমাট কোন বাহারি পাঞ্জাবির ওপর যদি জ্যাকেট পরতে হয় সে পাঞ্জাবির মান-সম্মান বলে কী কিছু থাকে!

অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি জনসংখ্যার আশি শতাংশ অথবা এরও বেশি তরুন ছাত্রছাত্রী। জুনে সেমিস্টার বিরতির এই সময়ে এদের কিছু সংখ্যক বাংলাদেশে ঈদ করতে গেছেন। আবার সিংহভাগ এই সময়ে দেশে যাবার কথা চিন্তাও করেননা। কারন সেমিস্টার বিরতির সময় একজন ছাত্র বা ছাত্রী আনলিমিটেড কাজ করতে পারেন। এদেশের নিরানব্বুই ভাগ বা এরও বেশি ছাত্র নিজের টাকায় পড়েন। ক্লাস যখন চলতে থাকে একজন ছাত্রলীগ অফিসিয়েলি সপ্তাহে কুড়ি ঘন্টার বেশি কাজ করতে পারেননা। কিন্তু কুড়ি ঘন্টার কাজের টাকায় একজনের সাপ্তাহিক থাকা-খাওয়ার খরচ চলতে পারে, টিউশন ফীর টাকা হবেনা। সে কারনে ছাত্রছাত্রীরা অপেক্ষায় থাকেন সেমিস্টার ব্রেক অথবা ছুটির। অতএব এখন তাদের বেশি কাজের সময়। ঈদ বা বাড়ি যাবার চাইতে কাজ-টিউশন ফী তাদের জীবনের সত্য।

সেমিস্টার ব্রেকের সুযোগে যারা বাড়ি গেছেন তারা যাবার সময় বাড়ির জন্যে নিয়ে গেছেন লাগেজ ভর্তি শপিং। বিদেশে আমরা যারা থাকি এসবই আমাদের আনন্দ। নিজের জন্যে কিছু কেনার চাইতে প্রিয়জনকে দেবার আনন্দটাই বেশি। প্রতি বছরের রোজার ঈদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভলিউমের বেচাকেনার উৎসব। বাংলাদেশের লোকজন বোনাস-উপহার অথবা চাঁদা-ঘুষের টাকা নিয়ে ঈদ শপিং’এ যান। বিদেশে বসে আমরাও দেশের এই ঈদ অর্থনীতিতে জোগান দেই আমাদের ভালোবাসা।

বিদেশে থাকা সিংহভাগ লোকজন পরিবারের জন্যে প্রতিমাসে টাকা পাঠান। পরিবারের লোকজনের চিকিৎসা, ভর্তি-পড়াশুনা উপলক্ষেও আলাদা টাকা পাঠাতে হয়। ঈদ উপলক্ষে প্রিয়জনের ঈদ কেনাকাটা, জাকাত-ফিতরার জন্যেও আমরা দেই বাড়তি টাকা। একটা উদাহরন দেই। অস্ট্রেলিয়ায় এবার প্রতিটি ফিতরার দাম পড়েছে বাংলাদেশের টাকায় ৭২০ টাকার বেশি। শুধু অস্ট্রেলিয়া না, সারা দুনিয়ার যেখানে যত বাংলাদেশি মুসলিম আছেন এভাবে প্রায় সবার জাকাত-ফিতরার টাকা বাংলাদেশে গেছে। এ টাকা গেছে-যাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। গ্রামে আমাদের প্রতিবেশী গরিব লোকজনের মাঝে। সারা বছর তারা এই টাকা তথা ঈদ উপহারের জন্যে অপেক্ষায় থাকেন। অমুক বাড়ির অমুক আছে বিদেশে। সে আমাগো লাইগা টাকা পাঠাইছে। এই তৃপ্তির উচ্চারন যে কত আনন্দের তা বলে বোঝাবার নয়।

তবে ঈদে দেশে বাড়িতে যে সব খাবার রান্না হয় সেমাই, পোলাও-কোরমা, ঈদ উপলক্ষে বিদেশের বাসা-বাড়িতেও তা রান্না হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্য বাংলাদেশে রোজা-ঈদ উপলক্ষে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এখানে বাড়েনা। কম লাভে বেশি বিক্রির জন্যে তুলনামূলক কমে। সেমাই এখানে যে সব পাওয়া যায় তা বাংলাদেশের নানা কোম্পানি আর ভারত-পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়ে আসা। মসলাপাতিও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান থেকে আসে। তবে পোলাওর চাউলের বাজারটা একচেটিয়া বাংলাদেশের। দুধ-চিনি এদেশে খুব সস্তা। গরু-খাসি-ভেড়ার মাংসের চাইতে মুরগির মাংসের দাম কম। তবে এসবের দাম ঠিক রাখার জন্যে বাংলাদেশের মতো মন্ত্রী-মেয়র পর্যায়ের বৈঠক লাগেনা। মন্ত্রী-মেয়রদের অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজ আছে। দোকানদাররাই দাম কম রেখে বেশি বিক্রির প্রতিযোগিতা করেন। বাংলাদেশের ঘরে মুরগি রান্না হলে মুরগির রান বাড়ির গুরুত্বপূর্ন সদস্য বা মেয়ে জামাইর পাতে দেবার চল আছে। এখানে মুরগির রান, উইং এসবের দাম কম। কারন এগুলোয় ফ্যাট বেশি। ঈদ উপলক্ষে সব পরিবারে প্রচুর রান্নাও যে হয় তাও নয়। কারন অনেক পরিবারে মেহমান পাওয়া কষ্টের। সবাই এখানে কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

বাংলাদেশ ঈদ নিয়ে অনেক বিভেদ-ভিন্ন চিন্তা আছে। কিছু এলাকার লোকজন সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে রোজা রাখেন। এদেশেও যেহেতু নানামতের মুসলমান আছেন তাই বিভেদটি এখানেও আছে। যেমন এদেশের আরবরা চাঁদ দেখাদেখির ধার ধারেননা। রোজা রাখেন ঈদ করেন সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে। আর বাংলাদেশ সহ ভারত-পাকিস্তান থেকে আসা মুসলিমদের ওপর তবলীগ জামাতের প্রভাব আছে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এরা নিজস্ব নেটওয়ার্কে রোজা-ঈদের ঘোষনা দেন। বহুজাতিক সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকার এর মুসলিম বাসিন্দা কর্মীদের ঈদের ছুটি দিতে রাজি আছে। এরজন্যে বিভিন্ন সময়ে মুসলিম নেতৃত্বের কাছে ঈদের একটি ঐকমত্যের দিন-তারিখ চেয়েছে। কিন্তু মুসলিম নেতারা যেহেতু তা দিতে পারেননা তাই ঈদের ছুটিও দেয়া যায়না। তবে মুসলিম এলাকাগুলোর স্কুলের মুসলিম ছেলেমেয়েদের মৌখিকভাবে বলে দেয়া হয় তারা চাইলে তিন দিন স্কুলে না আসতে পারে। ঈদকে সামাজিকভাবে এদেশে বলা হয় মুসলিম ক্রিসমাস। এখানকার মুসলিম পরিবারের বাচ্চাদের মধ্যে সে রকম ঈদ ক্রেজ ঈদের পোশাক ক্রেজ নেই। ঈদ উপলক্ষে তিন দিন স্কুলে যেতে হবেনা তিন দিন বাসায় বসে কম্পিউটারে-আইপ্যাডে গেম খেলা যাবে এটাই তাদের ঈদ আনন্দ।

অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি বাঙালি মুসলমান সহ প্রধান মুসলিম এলাকাটি সিডনির লাকেম্বায়। এখানকার ওয়ানজি রোডের মসজিদটি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ। যেহেতু এটি আরব মুসলিমরা নিয়ন্ত্রন করে ঈদের প্রধান জামাতটিও এখানে তাদের ঈদের দিন হয়। আর এখানকার ঈদের জামাতটি এমন যে অস্ট্রেলিয়ায় একমাত্র এই মসজিদের সামনেই রাস্তা বন্ধ করে ঈদের জামাত হয়। যেহেতু আগে থেকে পুলিশের অনুমতি নেয়া হয় তাই পুলিশ আগের রাত থেকে রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়ে নামাজে সহায়তা করে। অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিকরা এতবড় সমাবেশ পেয়ে এখানে ঈদ শুভেচ্ছার বক্তৃতা দেবার সুযোগ হাতছাড়া করেননা। আর যেহেতু বেশিরভাগ ঈদ পরপর দু’দিনে হয় তাই একই রাজনীতিক পরপর দুইদিন এই এলাকাটিতে শুভেচ্ছা বক্তৃতা দিতে আসেন। এদের মুসলিম এলাকাগুলোয় বড় কোন বাড়ি ভাড়া নিয়ে পাঁচবেলা নামাজের ব্যবস্থা করা হয় যেগুলো মসজিদ না মাসালা বলা হয়। এলাকার মাসালাগুলোতে নামাজ হয় সবার আগে। যারা ঈদের নামাজ পড়েই কাজে চলে যাবেন তারা মূলত এসব মাসালার জামাতেই শরীক হন। লাকেম্বা এলাকার বাংলাদেশি মুসলিমদের ঈদের জামাত মূলত হয় এখানকার প্যারিপার্কে। এটি এ এলাকার খেলাধুলার বড় মাঠ। এখানে একটি ইনডোর ক্রীড়া কমপ্লেক্সও আছে। ঈদের দিন বৃস্টি থাকলে নামাজ হয় ইনডোর ক্রীড়া কমপ্লেক্স।

এই হলো মোটামুটি আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ঈদ। এখানে ঈদ যেদিনই হোকনা কেন আমাদের অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশের ঈদ। কারন সেদিন আমরা দেশে মায়ের সঙ্গে স্বজনের সঙ্গে ফোনে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করি। আসলে দেশে ফোনের এ পর্বটি ছাড়া আমাদের ঈদই হয়না। বিদেশে থেকে ঈদের এসব বাস্তবতা প্রায় সব দেশ থেকেই সমান। দেশে ঈদ উপলক্ষে বাড়ি যাওয়া নিয়ে যে সব ভাগান্তি-কাহিনী হয় তা বড় কষ্টের। আসলে একসঙ্গে এত লোকের ঈদে বাড়ি যাবার মতো অবকাঠামো যানবাহন, সড়ক বাংলাদেশের নেই। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের লোকজন লম্বা ছুটিতে ছুটি কাটাতে বিভিন্ন দেশে যান। বাংলাদেশের আমজনতার সে সুযোগ নেই। গ্রামে যেখানে তার শেকড় সেখানে গিয়ে সবাইকে নিয়ে ঈদ করাটাই তার বার্ষিক বিনোদন। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের এবারের ঈদটা নিরাপদে আনন্দময় কাটুক। সবাইকে ঈদ শুভেচ্ছা। ঈদ মুবারক এবং জয়বাংলা।


Tags assigned to this article:
অস্ট্রেলিয়ার ঈদঈদ

Place your ads here!

Related Articles

সুখি বাংলাদেশের গল্প

আমাদের আমলে চতুর্থ অথবা পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্য বইয়ে একটা গল্প ছিলঃ “সুখি মানুষ”। তার সারমর্মটা এইরকম ছিল, এক রাজার

এসো হে বৈশাখ- প্রবাসে বাঙালি জাতিসত্তার স্মারক নববর্ষ উৎসব

কালচক্রে বিশ্বনিখিলে অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন নিয়ে সৃষ্টি ও সংহারের কঠিন বাস্তবতায় আসে দুঃখ-বেদনা, আসে উৎসব আনন্দ, আসে চার হাজার বছরের পুরনো

দাস প্রথা এবং ইসলাম

সমকালীন সময় কিছু ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববীদ, বিশেষ করে প্রাচাত্য শিক্ষায় আলোকিত কিংবা ধর্মান্তরিত নও মুসলিম চিন্তাশীল তত্ববীদ যুক্তি তুলে ধরছেন –

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment