এভারেস্টের উচ্চতায় আলোকিত অন্ধকার! – লুৎফর রহমান রিটন

এভারেস্টের উচ্চতায় আলোকিত অন্ধকার! – লুৎফর রহমান রিটন

এ বছর জানুয়ারির শুরুতে প্রথম আলোর রস-আলোর জন্যে একটা ছড়া চেয়ে ফোন করেছিলো অনুজপ্রতীম মাহফুজ রনি। রনি আমার বিশেষ স্নেহভাজন। বললো–একটা ছড়া দিতে হবে। ‘বছরের আলোচিত চরিত্র’ শিরোনামে চারটি ছড়া ছাপা হবে উপমহাদেশের বিখ্যাত ক্যারিকেচারিস্ট শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুনের সঙ্গে। আমাকে চারটি চরিত্রের নাম বলে রনি অনুরোধ করলো–একজনকে বেছে নিতে। আমি এড়াতে চাইলাম। কিন্তু নানান কৌশলে আমাকে এক পর্যায়ে পটিয়ে ফেললো রনি। তিনজন বিখ্যাত লেখকের নামও বললো, যাঁরা লিখবেন ওই বিশেষ সংখ্যায়। চারটি চরিত্র থেকে আমি বেছে নিয়েছিলাম ওয়াস্ফিয়া নামের চরিত্রটিকে। এভারেস্ট জয়ী হিশেবেই মেয়েটাকে পছন্দ করেছিলাম। মিডিয়ায় তখন ওকে নিয়ে খুব মাতামাতি হয়েছিলো। আমাদের আরেকজন মেয়ে নিশাত মজুমদারও এভারেস্টকে পদানত করেছিলো। কিন্তু নিশাতকে নিয়ে তেমন একটা হইচই হয়নি ইলেক্ট্রনিক কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায়। যেমন মুসা ইব্রাহিমকে নিয়ে দেশের তাবৎ গণমাধ্যম বিশেষ করে প্রথম আলো অতিমাত্রায় মাতামাতি করলেও নেপাল এবং তিব্বত দুদিক থেকে দুবার এভারেস্টে উঠেও এম এ মুহিত মিডিয়ার আনুকূল্য পাননি। যেটা মুহিতের প্রাপ্য ছিলো। যাক। ওয়াস্ফিয়ায় ফিরে আসি।

অতিসম্প্রতি ফেসবুকে কিউট কিউট জঙ্গিদের ছবি দেখে সমাজের একশ্রেণীর ‘আপ্পি’ অবিরাম ক্রাশ খাচ্ছে। পোশাকে আধুনিক কিন্তু চেতনায় অন্ধকারের জীব এইসব আপ্পিদের দলে ওয়াস্ফিয়াও আছে জানতাম না। ফজলুল বারীর একটি পোস্টে দেখলাম, হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী গ্রেফতারকৃত কিউট জঙ্গিদের একজন, কানাডার একটি ইউনিভার্সিটির ছাত্র তাহমিদের মুক্তি চেয়ে ফেসবুকে কান্নাকাটি করছে ওয়াস্ফিয়া! ‘ফ্রি তাহমিদ’ ইভেন্টে আমার চেনাজানা অনেককেই কান্নাকাটিতে অংশগ্রহণ করতে দেখে আমি যার পর নাই বিস্মিত। ইন্টারনেটের কল্যাণে অস্ত্রহাতে ওর এতো গুলো আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্র দেখেও তারা বিশ্বাস করতে বা মানতে রাজি নয় যে তাহমিদ নামের ছেলেটা জঙ্গি। কারণ এরকম কিউট একটা ছেলে জঙ্গি হতে পারে না। দাবি করা হচ্ছে জঙ্গিরা ওকে ভয় দেখিয়ে ওর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। ডাইরেক্ট বেহেশতে যেতে আগ্রহী ভয়াল ভয়ংকর জঙ্গিরা একজন জিম্মির হাতে অস্ত্র তুলে দেবে!! সেলুকাস। এই খুনিদের হাতে মৃত্যুবরণকারী কেউ একজন ফিরে এসে সাক্ষ্য না দেয়া পর্যন্ত এইসব বালক-বালিকাবৃন্দ বলতেই থাকবে–সে যে খুন করেছে তার প্রমাণ কী! কোরিয়ান ভদ্রলোককে এখনই পাকড়াও করা উচিৎ। মিয়া কিউট হাসনাত টাকলু আর তাহমিদ-রোহানদের এতো ছবি তুললেন আর্টিজানের পাশের বিল্ডিং থেকে, ওরা রাত্তিরে যখন খুন করছিলো তখন আপ্নে বিল্ডিং থিকা নাইমা আইসা খুনের সেই দৃশ্য তুইলা রাখলেন না কেনো? এই নিরিহ কিউট ছেলেটাকে এইভাবে ফাঁসিয়ে দিলেন!

এভারেস্ট জয়ী বাংলাদেশের প্রথম নারী নিশাত মজুমদারের চেয়ে ইংরেজি জানা ওয়াস্ফিয়া বেশি স্মার্ট। সেই কারণে নিশাতকে রেখে ওয়াস্ফিয়ার কীর্তনই গেয়েছে মিডিয়া। এখন তো আমার নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে প্রীতিভাজন মাহফুজের ওপরেও। ওর প্ররোচনায় আমি কী না এমন একটা মেয়েকে নিয়ে ছড়া লিখলাম যে একটা জঙ্গি ছেলের মুক্তি চায়!

ধরে নিলাম তাহমিদ নামের ছেলেটা ওয়াস্ফিয়ার বন্ধু। ধরে নিলাম ছেলেটা ওর আত্মীয়। ধরে নিলাম ছেলেটা ওর পরিবারের সদস্য। কিন্তু পরিবারের সদস্য হলেই একটা জঙ্গির মুক্তি দাবি করতে হবে? গুলশানের আর্টিজান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া এবং কল্যাণপুরের পুলিশি অভিযানে নিহত একাধিক জঙ্গির মা-বাবা কিন্তু জঙ্গি সন্তানের লাশটাও গ্রহণ করতে রাজি হয়নি!

এদিকে ফজলুল বারীর অপর স্ট্যাটাসে ওয়াস্ফিয়ার ফেসবুক টাইমলাইন থেকে প্রাপ্ত ওর আরেকটি স্ট্যাটাসের ক্রিনশট থেকে আরেকটা ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে দেখলাম। অন্য একটি ইস্যুতে ওয়াস্ফিয়া লিখেছে—”…end of the day its about my own identity, as a Bangladeshi, a citizen of a so-called independent country…”—সো কল্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট কান্ট্রি!! বাংলাদেশকে বলছো তথাকথিত স্বাধীন দেশ! ওয়াস্ফিয়া, তোমার দুঃসাহস তো কম না! তিরিশ লক্ষ শহিদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে তুমি বলছো তথাকথিত স্বাধীনতা!! তোমার তো শাস্তি হওয়া উচিৎ।

শোনো ওয়াস্ফিয়া, একানব্বুই সালে কলকাতার সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘আত্মঘাতি বাঙালি’র মহাবিখ্যাত লেখক নিরদ সি চৌধুরী তার একটি নিবন্ধে বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ লিখেছিলো। আমরা সোচ্চার হয়েছিলাম প্রতিবাদে। আমি তখন ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’র ফিচার এডিটর। আমাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে ‘দেশ’ পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিলো সরকার। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছিলো ‘দেশ’। বাংলাদেশে বিশাল বাজার ছিলো ‘দেশ’-এর। নিষিদ্ধ হবার কিছুকাল পরে কলকাতার ‘সাপ্তাহিক’ দেশ পত্রিকাটি ‘পাক্ষিক’-এ পরিণত হয়েছিলো। মহাশক্তিমান লেখক নিরদ সি চৌধুরী কিংবা শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারতকেই ছাড় দেয়া হয়নি ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ প্রশ্নে। তুমি তো সেই তুলনায় অতিনগণ্য একজন।

বাঙালি তোমাকে মাথায় তুলে নিয়েছিলো। বাঙালিকে চেনো নি তুমি। স্বাধীনতার প্রশ্নে মাথা থেকে ছুঁড়ে ফেলতেও জানে এই বাঙালি।

অনেক উপরে উঠলেও কেউ কেউ উচ্চ আসনের যোগ্য হয় না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার চরণ মনে পড়ছে–‘আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দেখায়।’ তুমিও আসলে বড় হওনি। তোমাকেও বড়র মতো দেখিয়েছে।

০৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর জন্যে তোমাকে নিয়ে যে ছড়াটা লিখেছিলাম তার শেষ চরণ ছিলো–‘শাবাশ মেয়ে শাবাশ/কূপমণ্ডুক অন্ধকারকে পায়ের তলায় দাবাস।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে তোমার মনোজগতে লালিত ও উপলব্ধিজাত উচ্চারণ —‘সো কল্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট কান্ট্রি’ শোনার পর মনে হচ্ছে ‘কূপমণ্ডুক অন্ধকারকে পায়ের তলায় দাবাস’ চরণের জায়গায় লেখা উচিৎ–কূপমণ্ডুক অন্ধকারেই তোদের আদি আবাস…।

যে বাংলাদেশ তোমাকে এতো সম্মান দিয়েছে সেই বাংলাদেশ তোমার কাছে ‘তথাকথিত স্বাধীন একটি দেশ’!

০৮ আগস্ট ২০১৬

tin-jonggi

pVmwU23tQ9qs


Place your ads here!

Related Articles

Prime Minister’s Visit to Bhutan

Prime Minister Sheikh Hasina’s visit to Bhutan is timely and appropriate. Cooperation with neighbouring countries is one of the priorities

এই হতাশার নাম শেখ হাসিনা

ফজলুল বারী: মঙ্গল শোভাযাত্রার ওপর পড়েছে অমঙ্গলের ছায়া! বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতির একটি সাংস্কৃতিক বিকাশের মঙ্গল শোভাযাত্রার বিপুল বৈভব।বঙ্গেয় দেশটির সর্বজনীন

Bangladesh Parliamentary Elections on January 5th

On 2nd January, Awami League President and Prime Minister Sheikh Hasina said “We had taken oath as an elected government

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment