হেনাখালার হজ

হেনাখালার হজ

(বিশ্বখ্যাত লেখক টলষ্টয়ের একটি ছোটগল্পের পূণঃনির্মানের বিনম্র প্রয়াস)
দিলরুবা শাহানা
ঘুমের চুমু সবে আলতো করে চোখের পাতা ছুঁয়েছে। রাত কত হবে? সাড়ে বারোটা কি বড় জোর একটা। টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং । হুড়মুড় করে উঠে রাফা রিসিভার তুললো। ওপারে আমেরিকা থেকে বোন। ওখানে এখন দিনের শুরু মাত্র।
-হ্যালো রাফায়েল, শোন্ ঘটনা একটা ঘটেছে!
গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে হলে বোন তার পুরো নাম ধরে কথা শুরু করে। শংকিত গলায় সে জানতে চাইলো
-কি হয়েছে আপু খুলে বল?
-এইমাত্র হেনাখালা ফোন করে জানালেন উনি হজে যাচ্ছেন না
-বল কি! উনারতো হজ ফ্লাইট ধরার জন্য এখন এয়ারপোর্টে থাকার কথা
-কথাতো সেটাই
-এতো টাকাপয়সা খরচ করে…
ডাক্তার বোনের ও তার এমবিএ ডিগ্রীধারী স^ামীর ম্যাগডোনাল, কে এফ সি ব্যবসায় বিস্তর বিত্ত। পয়সা ওদের কাছে কোন ব্যাপারই না।
-পয়সার কথা বাদ দে। তুই যে বন্ধুবান্ধবকে কত ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করলি, হেনাখালার দশবছরের পুরানো ছবি ইমেইল করলি যাতে দরকার হলে তারা খালার দেখভাল করতে পারে এখন তাদের কি বলবি?
রাফায়েল সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে ঠিক করে নিল তার কর্তব্য। সে বললো
-আমার বন্ধুরা কি বলেছে জানিস ‘তোরা তোদের খালার হজের জন্য রাজকীয় এনতেজাম করেছিস আর কারও কিছু করা লাগবে না। আমরা দূর থেকেই তাকে দেখবো।’ এখন বল কেন উনি হজে যাবেন না?
-এই মূহূর্তে উনার মনে হচ্ছে ধর্মকর্মের চেয়ে মানুষের প্রতি কর্তব্য বড়
-কিন্তু হজের নিয়ত করে না গেলে অমঙ্গল…
-নিয়ত করার কথা আমিও নরম গলায় বলেছিলাম উনি তেজী ভাষণ দিলেন।
-কি রকম কি রকম?
-শোন্ বললেন যে নিয়ত করেও হজ পালন করিনি এই বোঝাপড়া হবে আমার আল¬াহর সাথে। তোদেরকে জবাবদিহি করবো না
রাফায়েলের বোন ফারিয়েল হেনাখালার হজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ত একরকম জোর করেই নিজ কাঁধে নিয়েছিল। নিঃসন্তান কম বয়সে বিধবা হেনাখালা ঐশ^র্যশালী নারী। কিছুদিন হলো শিক্ষাবিদের সš§ানজনক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। রাজধানীর নামীদামী আবাসিক এলাকায় ছয়তলা বাড়ীর বিরাট বিরাট বারোটি এ্যাপার্টমেণ্টের মালিক। আপনজন বলতে রাফায়েল আর ফারিয়েল। হজে যাবেন ঠিক করার প্রথম আয়োজন ছিল ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ ছাড়া বাকী সব সম্পদ ওদের দুই ভাইবোনের নামে দানপত্র করা। করেছেনও তা।
হজ করার মত অর্থবিত্ত তার আছে। তবে বাবা মা নাই তাই খালার হজের খরচ বহন করতে পেরে কৃতার্থ হয়েছিল ফারিয়েল। রাফায়েলকে তেমন কিছু করতে হয়নি। সে তার সৌদি আরবে কর্মরত রইসকুতুব বন্ধুদের হেনাখালার হজের খবর খুব গৌরবের সাথে দিয়েছিল। বলেছিলো
-আমার হেনাখালা লম্বা নন তেমন, গায়ের রং ফর্সা, মুখের গড়ন লম্বাটে, নাক থেবরা নয় তবে ভারী কিছুটা আর চুল কাঁধ পর্যন্ত সমান করে ছাটা
-চুল জানার দরকার নেই
-কেন দূর থেকেই ঐ চুল দেখলে বুঝবি হেনাখালা আসছেন বা যাচ্ছেন
-আরে উনিতো তখন থাকবেন জুলবাব আর হিজাবে ঢাকা
রাফায়েল দেখলো সৌদী আরবের পেট্রোডলারের মালিক হোমড়াচোমড়া বন্ধুরা শব্দও ব্যবহার করে অদ্ভুত আলিশান। যার কিছু সে বুঝে, কিছু বোঝার ভান করে।
-ওহ্ তাইতো; তবে চশমার ফ্রেম কালো ও চারকোনা
-অতশত বর্ননা বাদ দিয়ে একটা ছবি ইমেইল করে দিস
-কথাটা ঠিক বলেছিস তাই করবো। আচ্ছা সাফামারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি, কাবাশরীফ সাতচক্কর দেওয়া যদি খালার জন্য খুব কষ্টকর হয় কি হবে তখন?
-শোন্ ঐরকম অপারগ কেউ হলে তাকে আগের কালে কুর্সীতে বসিয়ে কাফ্রী চারজন লোক কুর্সী কাঁধে নিয়ে ঐ চক্করগুলো করাতো।
-কাফ্রী কি?
-আফ্রিকান তারা, শক্তিশালী জবরদস্ত হয় এরা। এদের পারিশ্রমিক দিতে হতো, এখন হুইল চেয়ারেই করা যায়।
-আমি খালার জন্য ঐ ব্যবস্থাটাও করে রাখি কি বলিস তোরা?
-তুই ভাবিস না এ নিয়ে, প্রয়োজনে ব্যবস্থা করা যাবে; তা ছাড়া হজের মরশুমে পৃথিবীর নানাদেশ থেকে আমাদের আত্মীয়স্বজনরাও আসেনতো। আমরাতো ঐ কয়দিন এখানেই সময় কাটাই।
আন্তরিকভাবে আগ্রহী তিনবন্ধুকে খালার ছবিও ইমেইল করে পাঠিয়েছিল। যদিও ছবিটা সাত কি আটবছর আগে তোলা। রাফায়েল কখনওই বন্ধুবান্ধবের কাছে অনুরোধ উপরোধ করেনি। এবার এই সামান্য অনুরোধে বন্ধুরা সাড়া দিয়েছে দারুনভাবে। রাফায়েল সগৌরবে জানিয়েছে তার একমাত্র খালা যার নাম হেনা উনি এবার হজে যাচ্ছেন। এক ডাক্তার বন্ধু ঐ সময়ে খোদ মক্কামনোয়ারায় হাজীদের প্রয়োজনে খেদমত করায় নিয়োজিত মেডিকেল টিমের নেতৃত্ব থাকবে। সে ফোন করে রাফায়েলকে জানিয়েছে হেনাখালার কোন সমস্যা হবে না, হওয়ার কথা নয়। এখন দেখা গেল হেনাখালা নিজেই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন।
আমেরিকাতে যখন রাত নামছে অষ্ট্রেলিয়ায় দিন। তখন রাফায়েল ধীরেসুস্থে বোনকে ফোন করলো হেনাখালার শেষ মূহূর্তে হজ বাতিলের বৃত্তান্ত জানতে। যা জানলো তা নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ভাবলো। ভাবনার শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে খালার বিচারের মালিক সে নয়। আল¬াহ্ একমাত্র জানেন কি ঠিক আর ঠিক নয়। তবে হেনাখালার হজযাত্রার খবর যতো সাড়ম্বরে সৌদি বন্ধুদের জানিয়েছিল এবার বিপরীত সিদ্ধান্ত নিল। হজবাতিলের খবর কাউকেউ জানাবে না বলে ঠিক করলো।
এয়ারপোর্টে হজফ্লাইট ধরতে যাওয়ার কিছু সময় আগে হঠাৎ একটা ফোন। ফোন করেছেন হেনাখালার দীর্ঘদিনের এক কলিগ বা সহকর্মিনী। কান্নাভেজা গলা। অল্পক্ষন আগে ডাক্তার তাকে জানিয়েছেন যে তার অসুখ ভয়ংকর, অপারেশন করানো জরুরী, তাতে হয়তোবা বাঁচার উপায় হতে পারে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর যাওয়া তার পক্ষে হয়তো অসম্ভব ব্যাপার নয়। কথা হল আপনজন তার কেউ নাই যে কাছে থেকে ব্যবস্থা করবে। বিদেশী হসপিটালের সাথে যোগাযোগ করা, অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া। হেনাখালা জানতেন তার ঐ কলিগের একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকে। তবে এই প্রথম জেনে আশ্চর্য হলেন যে সে বড় দুঃখিনী। সেই মেয়ের একমাত্র সন্তানকে যখন অটিস্টিক বলে ডাক্তাররা চিহ্নিত করলো তখন তার স^ামী স্ত্রীসন্তানকে ফেলে রেখে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। ঐ মেয়েটির নিজের প্রায় অসুস্থ সন্তান নিয়ে একা একা প্রতিদিন বেঁচে থাকার যুদ্ধ, সে এক নিদারুন যুদ্ধ।
সমস্ত ঘটনা শুনে হেনাখালা হজে যাওয়া বাদ দিয়ে অসহায় অসুস্থ মানুষটির সেবা করা, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার জন্য থেকে গেলেন। রাফায়েল পর্দা সরিয়ে রাতের প্রায় অন্ধকার আকাশ দেখলো। হজবাতিলের খবর বন্ধুদের জানানো জরুরী নয় বলেই আবারও ভাবলো। তাছাড়া তার খালাতো আত্মনির্ভরশীল মানুষ। কোনভাবেই তার বন্ধুদের কোন সাহায্যের প্রয়োজন খালার পড়তো না। কাফ্রী, কুর্সী, হুইল চেয়ার কোন কিছুই লাগবেনা তার হেনাখালার।
স^স্তি নিয়ে ঘুমাতে গেল। ভোররাত্রে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। ভয়ে ভয়ে ফোন ধরলো। সৌদিআরব থেকে বন্ধুদের কেউ ফোন করলে এবার হেনাখালার হজ বাতিলের পাঁচালী গাইতে হবে। ভাবতেই মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠলো। না ফোনটা করেছেন হেনাখালা স^য়ং। গলার স্বর তেমনি তেজি তবে মনে হল একটু যেন ক্লান্ত
-রাফা শোন্ আগামীকাল আমার ঐ কলিগ বান্ধবীকে নিয়ে ব্যাংককে রওয়ানা হচ্ছি। ফারিয়েলকে ফোনে পাচ্ছিনা। তোকে বলছি তুই ওকে জানাবি
-কি জানাবো?
-তোদের দু’জনের নামে দ’ুটো এ্যাকাউণ্ট খুলে ভাড়ার টাকা মানে তোদের এ্যাপার্টমেণ্টের ভাড়ার টাকা এ্যাকাউণ্টে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি
-এখনি কেন খালা
-ভাবছিস আমি মরলে করতে হবে? নারে দানপত্রের নিয়ম হল সাথে সাথে কার্যকর করতে হয়, আর এটা আমার হজের নিয়তের অংশ। আমার লইয়ার তোদের জানাতো, আজ আমি আছি বলে জানালাম। ফারিয়েলকে তুই জানিয়ে দিস তাইলে।
-হজে যাবে বলে এতো ঝামেলা করলে
-থামতো। আরও শোন্ তোরা দুই ভাইবোন ছাড়া আমারতো কোন ওয়ারিশান নাই তাই তোদের জানা দরকার আরেকটা বিষয়
-আর কি বিষয়?
-আমার ব্যাংক এ্যাকাউণ্টের নমিনি করেছি একটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু কল্যাণ সংঘকে। আশাকরি আমি মারা গেলে এসব নিয়ে কোন ঝামেলা করতে হবে না তোদের
-শোন খালা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ কোথায় করবো, মানে ব্যাংককে
-জানাবো আমি
বলেই লাইন কেটে দিল। রাফা আবার ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন বোন ফারিয়েল ফোন করলো। তখন রাফায়েল জানালো খালার সম্পত্তি বিলিবণ্টনের খবর, সেই সূত্রে তাদের প্রাপ্তির বিষয়। সেসব তথ্য বোন শুনলো কি না বোঝা গেল না। সে রাফাকে খালার ব্যাংককে যাবতীয় খবর ও সেই সাথে খালার হোটেলের ঠিকানা ও ফোন নম্বর সব জানালো। রাফায়েল কেন আঁতিপাতি খুঁজে খালার ব্যাংককের সব খবরাখবর জোগার করলো না নিজেও জানে না। তবে ফারিয়েল নিজের নামের মান রেখেছে। যখনই কোন কাজ সে করে শতভাগ মনপ্রাণ ঢেলে দেয় তাতে। খালার দেখভালের জন্যও তাইই করছে। শেষে ফারিয়েল বললো
-রাফা শোন তোর মনে আছে খালা আমাদের ছোটবেলা কবিতা পড়ে শুনাত?
-হু আছেতো, একটা লাইন এখনি মনে পড়লো
-কোনটা কোনটা বলতো?
-‘মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’
-শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাইনা?
-হ্যা তাই।
দুই ভাইবোন ফোনের দুই প্রান্তে পরস্পরের শ^াসপ্রশ^াস শুনলো শুধু আর কোন কথা হল না।
হজ শেষ হল। ঈদও শেষ হল। তারপর পরই রাফায়েল সৌদী আরব থেকে এক বন্ধুর ফোন পেল।
-ঈদ মোবারক রাফায়েল!
-ঈদ মোবারক
তারপর বন্ধু তরতরিয়ে এক নাগাড়ে বলে গেল
-সরি বন্ধু তোর হেনাখালাকে ধরতে পারলাম না। কী ভীড়! এই ভীড়ের মাঝে আমি তাকে একবার দেখেছি আরাফাতের ময়দানে দূর থেকে। ডাক্তার তানভীর দেখেছে ভোর রাতে সোবহে সাদেকের সময়। বোতলে আবে জমজমের পানি নিচ্ছেন। নিরিবিলি ছিল হিজাব খুলে জমজমের পানি হাতে নিয়ে মুখে ও তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলে মাখছেন। তানভীর কাছে যেতে না যেতেই পরীর মত মুহূর্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন!
ফোন রেখে রাফায়েল বিস¥য়ে নীরব নিথর হয়ে বসে রইলো।

Read in pdf format at https://priyoaustralia.com.au/2015/09/Hena-Khalar-Haj1.pdf


Place your ads here!

Related Articles

40th Anniversary of Bangladesh membership to the UN

Bangladesh celebrated the 40th anniversary of its formal entry to the United Nations this year as its 136th member. And

মাদারস ডে

অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে ব্যাপক আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়ে মাদারস ডে পালিত হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব নিয়ে ককবরক (ত্রিপুরা) গান

তুরু রুতু তুরু রু সুমুর সুফতিয়ৈ: পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব নিয়ে ককবরক (ত্রিপুরা) গান ছবিতে: বাম দিক থেকে – মেয়ে

4 comments

Write a comment
  1. Zerin
    Zerin 6 April, 2017, 06:29

    Why this author is not write anymore. She writes so well!

    Reply this comment
  2. Dilruba Shahana
    Dilruba Shahana 10 April, 2017, 11:11

    Thanks a lot Zerin and Priyo Australia for your appreciation. It is not depends on me to publish write-up on this website. Again thanks.

    Reply this comment
  3. shahadat manik
    shahadat manik 11 April, 2017, 00:17

    আপা, আশা করি ভাল আছেন। আপনার লেখা বেশির ভাগই হয়ত পিডিএফ অথবা বিজয়ে লেখা। পিডিএফ কনভার্ড করা যায় না। অন্যদিকে বিজয় কনভার্ড করলে, অক্ষর পরিবর্তন হয়ে যায় – এডিট করা দুরহ। অভ্র বা গোগল বাংলা বা ইউনিকোডে লিখা না হলে প্রকাশ করা লেখকের জন্যেই কিছুটা অকার্যকর হয়ে যায়। সার্চ করে অনলাইনে পাওয়া যাবে না লেখা।

    আপনার লেখা প্রকাশে আগ্রহী আগেও ছিলাম, এখনো আছি। আশা করি অভ্র বা গোগল বাংলা বা ইউনিকোডে লিখা লিখে পাঠাবেন। ভাল থাকবেন।

    https://www.google.com/intl/bn/inputtools/try/

    Reply this comment
  4. Shahana
    Shahana 12 April, 2017, 04:22

    Bhai Shahadat Manik I understand your requirement but unfortunately I only do in Bijoy. I know a large number of Bangla speaking people all over the world read Priyo Australia. All the best

    Reply this comment

Write a Comment