মুজিব নগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের নেপথ্য কথা!

মুজিব নগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের নেপথ্য কথা!

ঐতিহাসিক মুজিব নগর দিবস আজ। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জন্মের দিন। এই প্রবাসী সরকারই নেতৃত্ব দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। পঁচিশে মার্চের গণহত্যা শুরুর পর শরণার্থীরা, রাজনৈতিক নেতারা যখন ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করেন, তখন এই সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ইন্দিরা-তাজউদ্দিন বৈঠকের পর। ওই বৈঠক উপলক্ষে তাজউদ্দিন ও ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলামকে একটা মালবাহী বিমানে করে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়। কারন ভারত সরকার তখনো শরণার্থীদের সহায়তার বাইরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অন্য কিছুতে প্রকাশ্যে আসতে চাইছিলোনা। ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্বকে একটি সরকার গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন উপলক্ষে ভারতে অবস্থানরত এমএনএ, এমপিএদের নিয়ে একটি বৈঠক হয় আগরতলা সার্কিট হাউসে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় প্রবাসী সরকারের শপথ হবে চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগ নেতা ডা আসাবুল হক এক বিদেশি সাংবাদিককে গল্পচ্ছলে কথাটি বলে দেয়ায় পাকিস্তানিরা চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। তখন চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা এডভোকেট ইউনুস আলীকে মেহেরপুর সীমান্তের বৈদ্যেরনাথতলায় সরকার গঠনের শপথ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে দায়িত্ব দেয়া হয়। সে আয়োজনে গিয়ে নানান সমস্যায় পড়েন এডভোকেট ইউনুস আলী। কারন সে গ্রামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের কিছুই ছিলোনা। গ্রামের লোকজনের বাড়িঘর থেকে চেয়ার-টেবিল যা পাওয়া গেছে তাই আনা হয়। এসব চেয়ারের কোনটির হাতল, কোনটির পা ভাঙ্গা ছিল। ভাঙ্গা চেয়ারের নিচে ইট রেখে সেগুলো বসার উপযোগী করা হয়। কিন্তু অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে কে? আমার সোনার বাংলা গানটি জানে এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিলোনা। জানা গেলো সীমান্তের ওপারের কৃষ্ণনগর স্কুলের ক্লাস এইটের একটি মেয়ে গানটি জানে। লোক পাঠিয়ে সে মেয়েটিকেই নিয়ে আসা হয় এপারের গ্রামে।

১৬ এপ্রিল বিকেলে ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম যান কলকাতা প্রেসক্লাবে। সেখানে গিয়ে বলেন পরেরদিন বাংলাদেশ সরকারের একটি অনুষ্ঠান হবে। ১৭ এপ্রিল ভোরে প্রেসক্লাব থেকে গাড়ি ছাড়বে। সাংবাদিকরা যেতে চাইলে যেন ভোরে প্রেসক্লাবে উপস্থিত থাকেন। কোথায় অনুষ্ঠান কিসের অনুষ্ঠান কিছুই খোলাসা করে বললেন না আমির উল ইসলাম। প্রেসক্লাবে যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমনি হঠাৎই বেরিয়ে চলে যান। খবরটি মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে গোটা কলকাতার মিডিয়া পাড়ায়! সকালে যদি আসতে দেরি হয় সে উত্তেজনায় অনেকে সারারাত প্রেসক্লাবেই থাকেন। পরের সকালে কয়েকটা গাড়ি নিয়ে আসেন আমির উল ইসলাম। সাংবাদিকরা সেগুলোয় চড়ে বসলে গাড়ির বহর চলতে শুরু করে সীমান্তের দিকে।

এদিকে বিদেশি সাংবাদিকদের আস্থা অর্জনের জন্যে শপথ অনুষ্ঠানে কিছু অভিনয়ের আশ্রয় নেয়া হয়! সেই সকালে মন্ত্রিসভার সদস্যদের আগেভাগে নিয়ে এসে বৈদ্যেরনাথ তলার আমবাগানের ভিতরের একটি ইপিআর ক্যাম্পে বসিয়ে রাখা হয়। শপথ অনুষ্ঠানে এসে বিদেশি সাংবাদিকরা দেখেন বাংলাদেশের মন্ত্রীরা বাংলাদেশের ভিতর থেকে হেঁটে আসছেন অনুষ্ঠানে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় শপথ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠন করা হয় বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা। বিশ্বে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশ। বৈদ্যেরনাথ তলার নতুন নামকরন করা হয় মুজিবনগর। বিদেশি সাংবাদিকরা দেখেন শপথ শেষে বাংলাদেশের ভিতরের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মন্ত্রীরা! আসলে তারা হেঁটে গিয়ে সেই ইপিআর ক্যাম্পেই গিয়ে বসেন। বিদেশি সাংবাদিকরা চলে যাবার পর শপথগ্রহনকারী মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। মন্ত্রীরা চলে যাবার কিছুক্ষনের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা পৌঁছে যায় মুজিবনগরে! চরম ক্রোধে তারা তছনছ করে গোটা এলাকা। কিন্তু ততক্ষনে বিশ্ব জেনে গেছে বাংলাদেশ সরকারের জন্ম সংবাদ। সেই সরকারের অধীনে নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। যে যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment