সুধাংশু তুই পালা
Print this article
Font size -16+
একটা ছোট পরিসংখ্যান দেই। বাংলাদেশে ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ ভাগ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের অব্যবহিত পরে তা শতকরা ২২ ভাগে এসে দাঁড়ায়। এরপর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার এবং নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় দেশটিতে ক্রমশ হিন্দুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৬১ সালে ১৮.৫%, ১৯৭৪ সালে কমে দাঁড়ায় ১৩.৫%, ১৯৮১ সালে ১২.১%, এবং ১৯৯১ সালে ১০% এ এসে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে হিন্দুদের শতকরা হার কমে ৮ ভগের নিচে নেমে এসেছে বলে অনুমিত হয়। যারা বিলুপ্ত বন্য প্রাণী নিয়ে চিন্তিত, এখন বাংলাদেশের হিন্দুদের দিকে একটু নেক নজর দিতে পারেন। আপনাদের নেক নজর থাকলে কে জানে – সাইবেরিয়ান বাঘ, মেরু ভল্লুক কিংবা বিরল প্রজাতির পাণ্ডাদের মত হয়তো বিলুপ্তির হাত থেকে হিন্দুরা রক্ষা পেলেও পেতে পারে এ যাত্রা। প্রতিবার দেশে নির্বাচন নিয়ে তামাসা শুরু হয়, আর তামাসার পর শুরু হয় গণহারে কচুকাটা। এভাবেই চলছে। ’৪৭ এ একবার, ’৬৫তে পাক-ভারত যুদ্ধের পরে একবার ’৭১ এ একবার , এরশাদের আমলে দুবার, ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দাঙ্গায় নাজেহাল হয়ে বহু হিন্দু হিন্দু পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এদেশের চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে। পূর্ণিমা রাণীর মত বহু হতভাগ্য নারীকে হতে হয়েছিল গণধর্ষনের শিকার। এই তো সেদিন – সাঈদীর বিচারের পরেও অসংখ্য হিন্দু বাড়ি জালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পেতে হলে যদি বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হতে হয়, ভাইকে পুড়ে মরতে হয়, বোনকে দেখতে হয় ধর্ষিতা, তাহলে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা চেয়ে কি ফায়দা কে জানে। বরং বিচার ফিচার না হলেই মনে হয় এই অভাগারা একটু নিরাপদে থাকে। সাইদীর ফাঁসি হইলেই বা কি আর আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জিতলেই বা কি লাভ। কচুকাটা তো চলছেই। মনে পড়ে শামসুর রাহমান একবার একটা কবিতা লিখেছিলেন, ‘সুধাংশু যাবে না’ নামে। আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা কবিতা। কবিতাটা এরকমের –
সুধাংশু যাবে না (শামসুর রাহমান) ———-
লুণ্ঠিত মন্দির, আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো ‘আখেরে কি তুলি চলে যাবে?’ বেলা শেষে সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা, স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা। স্বর বলে, ‘লুটেরা তোমাকে জব্দ ক’রে ফেলে আশে পাশে তোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকে পশুর চেহারা সহ ঘাতকের ছায়া, আতঙ্কের বাদুড় পাখার নিচে কাটাচ্ছ প্রহর, তবু তুমি যেও না সুধাংশু।’ আকাশের নীলিমা এখনো হয়নি ফেরারি, শুদ্ধাচারী গাছপালা আজও সবুজের পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো। এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও পরাজিত সৈনিকের মতো সুধাংশু যাবে না।
======
চমৎকার কবিতা নিঃসন্দেহে। এরশাদের আমলে যখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বাবরি মসজিদ ইস্যু করে দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল। আমি তখন ঢাকা কলেজে পড়ি। চোখের সামনেই মরণ চাঁদের দোকান ধূলিস্ম্যাৎ হয়ে যেতে দেখেছিলাম। দেখেছিলাম ক্ষুধার্ত চোখের হায়নাদের মিছিল করে জগন্নাথ হলের কালীবাড়ির দিকে যেতে… তখনো আমি রোমান্টিক কবিদের মতোই শামসুর রাহমানকে আবৃত্তি করতাম – ‘এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও, পরাজিত সৈনিকের মতো সুধাংশু যাবে না’। আজ মনে হয় বড়ই ইম্প্র্যাকটিক্যাল রোমান্টিক ছিল এ পাগলামি। বছর দশেক আগে আমি সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আলমগীর হুসেন নামের এক বড় ভাইয়ের সাথে থাকতাম রুম শেয়ার করে। আমার লেখালিখির সূত্র ধরে উনিও একসময় লেখালিখিতে এসেছিলেন। উনি শামসুর রাহমানের কবিতাটার একটা প্যারোডি লিখেছিলেন এরকমের
– সুধাংশু তুই পালা (আলমগীর হুসেন) ———–
পাগলামি করিসনে বন্ধু সুধাংশু সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে এবার যে তোর পালানোর বেলা জিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা। জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু দাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশানসম বাস্তুভিটায় সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলা কিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা। আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু সেই একপাল বন্ধুগুলো ¬ রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকে প্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলা কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা। আমি বুঝি তোর শঙ্কা আগামী বিরহ বেদনার বন্ধু সুধাংশু আড়াই যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা আত্মার সম্পর্ক ¬- এই বাস্তুভিটার সাথে আর এক ঝাঁক বন্ধুর ভালবাসা প্রাণঢালা। কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা। কোথায় সেই কল-কাকলীতে মুখরিত সবুজ সুন্দর কাপালী-ভিটাটি বন্ধু সুধাংশু দু’টি জীর্ণ-শীর্ণ ঘর চির-দুঃখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ সেই কাপালী ভিটায়। কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলী আরও সেই প্রিয় বন্ধুগুলা ওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা। তুই কি জানিস বন্ধু সুধাংশু তোর বিদায়ে ভীষণ ব্যথা পাবে আমার ঐ ছ’বছরের অবুঝ বোনটি ‘নেহা’ কাটাবে কত সন্ধ্যা অধীর প্রত্যাশায়, সুধাংশু ভাইকে জড়িয়ে ধরবে: ¬ কোথায় চকলেটগুলা? তবুও তোকে পালাতে হবে যে, এবার তুই পালা। আরও জানি বন্ধু সুধাংশু তোর ষোড়শী বোনটি ‘মিলা’ দুষ্টামির ছলে আর বলতে পারবে না: আলমদা তুমি এত কৃপণ কেন? চলো মেলায় নিয়ে, কিনে দিতে হবে সুন্দর একটি মালা। তথাপি তোকে পালাতে যে হবে, এবার তুই পালা। তোকে যে বলা হয় নি বন্ধু সুধাংশু মিলা’র সহপাঠী আমার ভাইটি ‘রিপন’ বলছিল সেদিনঃ ভাইয়া মিলা’টা যা সুন্দর হয়েছে না! বলে দিয়েছি ওকে, সুন্দরী মেধাবী মিলা বিশ্ব জয় করবে, তোর মতো গর্দভটি ওর দিকে তাকাবে না। তোর হাতে যে সময় নেই বন্ধু, এবার তুই পালা। মিলাকে যে বিশ্ব জয় করতেই হবে বন্ধু সুধাংশু অসাধারণ সুন্দরী মেধাবী মিলার জন্য এক ধর্ষিত, অচ্ছুৎ, অভাগী নারীর জীবন ¬ হবে মানবতার জন্য এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা। তাই আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা।
======
মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকে যখন ‘সুধাংশু যাবে না’ লিখে নেটে সার্চ দিলাম, কোথাওই শামসুর রাহমানের মূল কবিতাটি পেলাম না। সব জায়গাতেই আলমগীরের লেখা কবিতাটাই পেলাম। অনেকে ওটাকে শামসুর রাহমানের কবিতা হিসেবে ব্লগে টগে পোস্টও করেছেন। কিন্তু আমি জানি কবিতাটি শামসুর রাহমানের নয়, ওটা আলমগীরের প্যারোডি (শামসুর রাহমানের মূল কবিতাটি পিডিএফ আকারে মুক্তমনায় আছে, প্রথম কমেন্ট দ্রঃ), আমার সামনেই সেই প্যারোডি-কবিতাটি আলমগীর লিখেছিলেন । কবিতার বিবর্তন দেখে শত দুঃখের মাঝেও হাসি পেল। আমার প্রিয় দেশটাও যেন কবিতার মতোই মূর্তিমান প্যারোডি হয়ে গেছে। হ্যা, ‘সুধাংশু যাবে না’র চেয়ে ‘সুধাংশু তুই পালা’ ই বরং এখন রূঢ় বাস্তবতা। এখন আমি রোমান্টিক কবির মতো ‘এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও, পরাজিত সৈনিকের মতো সুধাংশু যাবে না’ বলে অহংকার করি না, বরং আলমগীরের মতো প্র্যাক্টিকাল হয়েই ভাবি – ‘আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা’। য পলায়তি স জীবতি।
No comments
Write a comment
No Comments Yet!
You can be first to comment this post!