একজন সাধাসিধে মা
১.
আমার মা সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ খুব ভোর বেলা মারা গেছেন। আমার বাবা যখন মারা গেছেন তখন তার কাছে কোনো আপনজন ছিলো না, একটা নদীর তীরে জেটিতে দাড়া করিয়ে পাকিস্তান মিলিটারী গুলি করে তাকে হত্যা করে তাঁর দেহটা নদীতে ফেলে দিয়েছিল। আমার মা যখন মারা যান তখন তার সব আপনজন – ছেলে মেয়ে ভাই বোন নাতি নাত্নীরা সবাই তার পাশে ছিল। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার মায়ের বয়স মাত্র ৪১, তারপর আমার মা তার সন্তানদের এবং তার আপনজনদের জন্যে আরো ৪৩ বছর বেঁচে ছিলেন।
আমার মায়ের মৃত্যুটি একান্তভাবেই একটি পারিবারিক ঘটনা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমি এক ধরণের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি তার অসুস্থতার খবরটিও পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। তার মৃত্যুর খবরটি সব পত্রপত্রিকায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। যদি খবরের শিরোনাম হতো, “হুমায়ূন আহমেদের মায়ের জীবনাবসান”, আমি সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে ধরে নিতাম। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছি যখন দেখেছি আমার মা’কে তার নিজের নামে পরিচয় দিয়ে লিখেছে, “আয়েশা ফয়েজের জীবনাবসান”। আমি জানতাম না এই দেশের মানুষ আমার মা’কে তার নিজের নামে চেনে। সেজন্যে আমি আজকে এই লেখাটি লিখতে বসেছি – মনে হয়েছে যদি সত্যিই দেশের মানুষ তাকে তাঁর পরিচয় দিয়েই চেনে তাহলে হয়তো অনেকেই আমার একেবারে সাদাসিধে মায়ের জীবনের একটি দুটি ঘটনা শুনতে আপত্তি করবেন না।
মাঝে মাঝেই আমাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, “আপনি আমেরিকার এতো সুন্দর জীবন ছেড়ে দেশে কেন চলে এলেন?” নানাভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। নিজের দেশে ফিরে আসতে যে কোনো কারণ লাগে না – বরং উল্টোটাই সত্যি, দেশ ত্যাগী হওয়ার পিছনে ভালো কারন থাকা দরকার সেটা কাকে বোঝাব? প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমেরিকা গিয়েছিলাম তখন ই-মেইল ইন্টারনেট আবিষ্কার হয়নি, ডজন হিসেবে টিভি চ্যানেল ছিলো না, টেলিফোন অনেক মূল্যবান বিষয় ছিল, মায়ের ফোন ছিল না থাকলেও আমার তাকে নিয়মিত ফোন করার সামর্থ্য ছিল না। যোগাযোগ ছিলো চিঠিতে – চিঠি লিখলে সেটা দেশে আসতে লাগতো দশ দিন, উত্তর আসতে লাগতো আরো দশ দিন। মেল বক্সে দেশ থেকে আসা একটা চিঠি যে কী অবিশ্বাস্য আনন্দের বিষয় ছিল সেটা এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
সেই সময়ে আমার মা আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতেন। আমি জানি এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমি আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে প্রতি সপ্তাহে আমার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। আমার মা তার গুটি গুটি হাতের লেখায় প্রতি সপ্তাহে আমাকে বাসার খবর দিয়েছেন, ভাইবোনদের খবর দিয়েছেন, আত্নীয়স্বজনদের খবর দিয়েছেন, এমন কী দেশের খবরও দিয়েছেন। আমার প্রবাস জীবনে দেশ কখনো আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি শুধুমাত্র আমার মায়ের চিঠির কারনে।
কয়েক বছর পর বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদও পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা এসেছিল, তখন আমার মা প্রতি সপ্তাহে দুটি চিঠি লিখতেন – একটি আমাকে আরেকটি আমার ভাইকে।
আমার মায়ের লেখা সেই চিঠিগুলো বাঁচিয়ে রাখিনি – এখন চিন্তা করে খুব দুঃখ হয়। যদি চিঠিগুলো থাকতো তাহলে সেটি কী অসাধারণ দলীল হতো আমি সেটি চিন্তাও করতে পারি না।
আমার মা খুবই সাধারণ একজন সাদাসিধে মহিলা ছিলেন – অন্তত আমরা সবাই তাই জানতাম। দেশ স্বাধীন হবার পর যখন আমাদের থাকার জায়গা নেই, ঘুমানোর বিছানা নেই, পরনের কাপড় নেই, তখন হঠাৎ করে আমরা সবাই আমার মায়ের একটা সংগ্রামী নূতন রুপ আবিষ্কার করলাম। আমরা ভাইবোনেরা সবাই লেখাপড়া করছি – কিছুতেই লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না তাই বাবার গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স আর পেনশনের অল্প কিছু টাকার উপর ভরসা করে ঢাকায় স্থায়ী হলেন। কী ভয়ংকর সেই সময়, এখন চিন্তা করলেও আমার ভয় হয়! বাড়তি কিছু টাকা উপার্জনের জন্যে আমার মা একটা সেলাই মেশিন জোগাড় করে কাপড় সেলাই পর্যন্ত করেছেন। আমি পত্রিকায় কার্টুন আঁকি – গোপনে প্রাইভেট টিউশনি করি, এভাবে কোনোমতে টিকে আছি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ পাশ করে একটা চাকরী পাবে সবাই সেই আশায় আছি। এরকম সময় আমি একদিন হঠাৎ করে বলাকা সিনেমা হলের নিচে একটা বইয়ের দোকানে পুরো মানিক গ্রন্থাবলী আবিষ্কার করলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা অপূর্ব প্রচ্ছদ, পুরো সেটের দাম তিনশ টাকা! (এখনকার টাকায় সেটি নিশ্চয়ই দশ বারো হাজার টাকার সমান হবে!) এতো টাকা আমি তখনো একসাথে হয়তো ছুয়েও দেখিনি। এই বইয়ের সেট আমার ধরা ছোয়ার বাইরে। তবু আমি বইগুলো হাত বুলিয়ে দেখি, লোভে আমার জিভে পানি এসে যায়।
যাই হোক বিকালবেলা বাসায় ফিরে এসেছি, ভাইবোনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি তখন মানিক গ্রন্থাবলীর সেটটার কথাই শুধু ঘুরে ফিরে বলছি, কী অপূর্ব সেই বইগুলো, দেখে কেমন লোভ হয় কিছুই বলতে বাকী রাখি নি। আমার মা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কতো দাম?” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “তিনশ টাকা।” আমার মা বললেন, “আমি তোকে তিনশ টাকা দিচ্ছি, তুই কিনে নিয়ে আয়।”
আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমাদের পরিবারের তখন যে অবস্থা তখন প্রত্যেকটি পয়সা গুনে গুনে খরচ করা হয়। তার মাঝে আমার মা আমাকে তিনশ টাকা দিয়ে দিচ্ছেন এরকম ভয়ংকর একটা বিলাসিতার জন্যে? “মানিক গ্রন্থাবলী” কিনে আনার জন্যে? টাকাটা কোথা থেকে দিচ্ছেন, এই টাকা দিয়ে বই কিনে ফেলার পর সংসারের কোন চাকাটা অচল হয়ে পড়বে আমার সেইসব জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিলো! আমি তার কিছুই করিনি। মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ছুটতে ছুটতে সেই বইয়ের দোকানে হাজির হলাম, ভয়ে বুক ধুকধুক করছে, এর মাঝে যদি কেউ সেই বইগুলো কিনে নিয়ে যায় তাহলে কী হবে?
বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখলাম বইগুলো তখনো আছে। আমি টাকা দিয়ে লোভীর মতো মানিক গ্রন্থাবলীর পুরো সেট ঘাড়ে তুলে নিলাম। আহা কী আনন্দ!
বাসার সবাই বই পড়ে, তাই সেই আনন্দ শুধু আমার একার নয়, সবার। কেউ তখন বাসায় এলে বিচিত্র একটা দৃশ্য আবিষ্কার করতো, ঘরের একেক কোনায় একেকজন বসে, শুয়ে, আধাশোয়া হয়ে, কাত হয়ে, সোজা হয়ে মানিক গ্রন্থাবলী পড়ছে!
তারপর বড় হয়েছি, জীবনে বেঁচে থাকলে অনেক কিছু কিনতে হয়, অন্য অনেকের মতো আমিও কিনেছি। আমেরিকা থাকতে শো রুম থেকে নূতন গাড়ী কিনে ড্রাইভ করে বাসায় এসেছি, ঝকঝকে নূতন বাড়ীও কিনেছি – কিন্তু সেই মানিক গ্রন্থাবলী কেনার মত আনন্দ আর কখনো পাইনি, আমি জানি কখনো পাব না। এটি আমার জীবনের ঘটনা, যারা আমার মায়ের কাছাকাছি এসেছে তাদের সবার জীবনে এরকম ঘটনা আছে। কাউকে কিছু কিনে দিয়েছেন, কাউকে অর্থ সাহায্য করেছেন, কাউকে চিকিৎসা করিয়েছেন, কাউকে উপহার দিয়ে অবাক করে দিয়েছেন কিংবা কাউকে শুধু আদর করেছেন, দুঃখের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।
আমরা যখন আমেরিকা থাকি তখন একবার তাঁকে আমাদের কাছে বেড়াতে নিয়ে গেলাম। আমেরিকা দেখে আমার মা খুবই অবাক, তাঁর শুধু একটাই প্রশ্ন, “মানুষ জন কোথায় গেল?” আমরা তাঁকে বোঝাই, মানুষ জন কোথাও যায়নি – যাদের দেখছেন তারাই আমেরিকার মানুষ! আমরা যখন বাসায় থাকি না তখন মাঝে মাঝে আমার মা হাঁটতে বের হন, রাস্তা ধরে এদিক সেদিক হেঁটে আসেন। একদিন হেঁটে এসে আমাদের বললেন, “তোরা কখনো বলিস নি, এখানে একটা কবরস্থান আছে। কী সুন্দর কবরস্থান, কবরের উপর কতো ফুল। আমি সেই কবরগুলো জেয়ারত করে এসেছি।”
আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “হায় হায়! আপনি জানেন কী করেছেন?”
মা বললেন, “কী করেছি?”
আমি বললাম, “ওটা কুকুর বেড়ালের কবর। আপনি কুকুর বেড়ালের কবর জেয়ারত করে ফেলেছেন!”
এই দেশে কবরস্থানে কুকুর, বেড়ালকে কবর দেয়া হয়, শুনে মা চোখ লপালে তুললেন আর আমরা হেসে কুটি কুটি হলাম।
দেশে থাকতে মা কতো রকম কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকেন, আমেরিকায় তার কোনো কাজ কর্ম নেই। আমার ছেলে মেয়েরা ছোট তাদের বাংলা পড়তে শেখান। তখন নূতন পার্সোনাল কম্পিউটার বের হয়েছে, বাসায় একটা আছে, আমি সেখানে বাংলায় লেখার ব্যবস্থা করেছি। একদিন মা’কে বাংলা লেখা শিখিয়ে দিলাম। আমার মা তখন কম্পিউটারে বাংলায় দেশে ছেলে মেয়ে নাতী নাত্নীর কাছে চিঠি লিখতে শুরু করলেন। কম্পিউটারে বাংলায় লেখা মায়ের চিঠি দেখে দেশে সবাই হতবাক হয়ে গেল!
এতো কিছু করেও মায়ের অনেক অবসর। আমার স্ত্রী তখন মা’কে বলল, “আপনার এতো ঘটনাবহুল একটা জীবন, আপনি বসে বসে সেই জীবনীটুকু লিখে ফেলেন না কেন?” আমার মা একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত লিখতে রাজী হলেন। তারপর বসে বসে তাঁর বৈচিত্রময় জীবনীটুকু লিখে ফেলেন, আমি কম্পিউটারে সেটা টাইপ করে দিলাম। মা দেশে যাবার সময় তার হাতে পুরো পান্ডুলিপিটা দিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করলেই কোনো প্রকাশককে দিয়ে সেটা প্রকাশ করানো যেতো কিন্তু কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে সেটা দেশে বাক্সবন্দী হয়ে থাকল। আমরা আমার মায়ের লেখা আত্মজীবনীর কথা ভুলেই গেলাম।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে, আমি দেশে ফিরে এসেছি তখন হঠাৎ করে উইয়ে কাটা অবস্থায় এই পান্ডুলিপি নূতন করে আবিষ্কৃত হল, আমি তখন উদ্যোগ নিয়ে সময় প্রকাশনীকে সেটি দিয়েছি ছাপানোর জন্যে। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়ে নিল। যখন বইয়ের ছাপা শেষ, বাঁধাই হচ্ছে তখন হঠাৎ করে আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ। কী কারণে তার ধারণা হল তিনি বুঝি আর বাঁচবেন না, আমি তখন সিলেটে, আমাকে ফোন করে বললেন, “বাবা, যদি তোদের সাথে কখনো ভুল করে থাকি, মনে কষ্ট রাখিস না। আমাকে মাফ করে দিস।”
শুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা, মা’কে মাফ করে দেবো মানে? আমি তখনই সময় প্রকাশনীর সত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদকে ফোন করে জিগ্যেস করলাম আমার মায়ের বইয়ের কি অবস্থা। ফরিদ জানালেন বই বাঁধাই হচ্ছে। আমি বললাম এই মুহুর্তে দুটি বই বাঁধাই করে আমার মার হাতে দিয়ে আসতে হবে। আমি জানি একজন লেখকের জীবনের প্রথম বইয়ের থেকে বড় আনন্দ পৃথিবীতে নেই। ফরিদ ছুটতে ছুটতে বই নিয়ে আমার মায়ের হাতে তুলে দিল এবং সাথে সাথে মায়ের সব অসুস্থতা দূর হয়ে গেল! আমার মা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলেন। শুধু ডাক্তাররা চিকিৎসা করে কে বলেছে, আমিও চিকিৎসা করতে পারি। আমার মা খুবই আন্তরিকভাবে এই বইটি লিখেছিলেন, যারাই বইটি পড়েছে তাদের সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে। একজন মানুষ জীবনে কতোভাবে কষ্ট পেতে পারে, এই বইটি পড়লে সেটি বোঝা যায়।
হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর আমার মা আবার নতুন করে যে কষ্ট পেয়েছিলেন সেই কষ্ট থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন আমরা কেউ ভাবিনি। সেই কষ্ট ভুলে থাকার জন্যে আমার মা বসে বসে তার কাছে চিঠি লেখার মত করে অনেক কিছু লিখেছেন। পাণ্ডুলিপিটি আমার কাছে আছে, হয়তো এটাও কোনো প্রকাশককে দিয়ে কখনো প্রকাশ করিয়ে দেব।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুটি আমার মা’কে খুব বড় একটা আঘাত দিয়েছে, সত্যিকারভাবে আমার মা কখনোই সেই আঘাত থেকে বের হতে পারেননি। আমরা টের পেতাম তার মনটি ভেঙে গেছে, একজনের মন ভেঙে গেলে তাকে জোর করে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আমরাও পারিনি, গত ২৭ তারিখ আমার মা তার বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদের কাছে চলে গেছেন। সে সম্ভবত আমার বাবাকে নিয়ে আমার মায়ের জন্যে অপেক্ষা করছিল। তারা তখন একজন আরেকজনকে কী বলেছিল আমার খুব জানার কৌতূহল হয়।
২.
খবরের কাগজে আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ ছাপানোর সময় অনেকেই তাকে রত্নগর্ভা বলে সম্বোধন করেছে। এই বিশেষণটি পড়ে আমি দুই কারণে একটু অস্বস্তি বোধ করেছি। এক: এটি সত্যি হলে আমাদের ভাইবোনের সবারই ছোটবড় মাঝারি রত্ন হয়ে ওঠার একটা চাপ থাকে, কাজটি সহজ নয়! দুই: এই বিশেষণটি সত্যি হলে বোঝানো হয় আমার মায়ের নিজের কোনো অবদান নেই, তার একমাত্র অবদান হচ্ছে তিনি ছোট-বড়-মাঝারি ‘রত্ন’ জন্ম দিয়েছেন!
কিন্তু আমি জানি রত্নগর্ভা হিসেবে নয়, আসলে আমার মা একজন খুব সাদাসিধে মা হিসেবেই অনেক বড় অবদান রেখেছেন। আমার মা যেভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমাদের পুরো পরিবারটিকে রক্ষা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। যদি বুক আগলে আমাদের রক্ষা না করতেন তাহলে আমরা কেউই টিকে থাকতে পারতাম না।
কীভাবে কীভাবে জানি আমার মায়ের একটা পরিচিতি হয়েছে, তিনি অসুস্থ হলে টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হয়, তিনি মারা গেলে খবরের কাগজে কালো বর্ডার দিয়ে খবর ছাপা হয়। কিন্তু আমি আমার মা’কে দেখে বুঝেছি এই বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আমার মায়ের মত অসংখ্য মা আছেন যারা যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছিলেন এবং যারা নিজের সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ঠিক আমার মায়ের মত সংগ্রাম করেছিলেন। তাদের কথা কেউ জানে না, তাদের কথা কেউ বলে না। আমার মনে হয় আমাদের বাংলাদেশ যে পৃথিবীর অন্য দশটা দেশ থেকে ভিন্ন তার একটা বড় কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পর এই দেশে অনেক মা ঘর থেকে বের হয়ে সংগ্রাম শুরু করেছেন। বেঁচে থাকার জন্যে সেই সংগ্রামের কথা কতোজন জানে? মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে যে যুদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের দেশের সেই মায়েদের যুদ্ধ তাঁদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমরা কী সেটা মনে রাখি?
একদিন যখন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে তখন আমরা কী বাংলাদেশের সেই অসংখ্য মায়েদের কথা স্মরণ রাখব? যে সাদাসিধে মায়েরা সন্তানদের রক্ষা করার জন্যে সিংহীর সাহস নিয়ে কঠিন পৃথিবীর মুখোমুখি হয়েছিলেন? বুক আগলে তাদের রক্ষা করেছিলেন?
আমি আজকে আমার নিজের মায়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের এরকম অসংখ্য মা’দের কাছে একটুখানি ভালোবাসা পৌঁছে দিতে চাই। একটুখানি শ্রদ্ধা পৌঁছে দিতে চাই।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
০৮.১০.২০১৪