বাল্যবিবাহ, সাভার ট্রাজেডি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির যোগসূত্র

বাল্যবিবাহ, সাভার ট্রাজেডি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির যোগসূত্র

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হলো বাল্যবিবাহ। দেশে আইনত মেয়েদের সর্বনিম্ন বিয়ের বয়স হলো ১৮। এই বয়সের নিচে বিবাহকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গন্য করা হবে যা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যথাযথ আইন থাকলেও আমাদের ৫০ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৬ বছরের নিচে।

দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইনের যে কোনো প্রয়োগ নেই তা সম্প্রতি সাভারে রানা প্লাজায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনায় হতাহত হতভাগ্য নারী পোশাককর্মীদের বয়স ও তাদের সন্তানদের বয়স পর্যবেক্ষণ করলেই এর প্রমান পাওয়া যায়।

সম্মানিত পাঠক, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রানা প্লাজায় হতাহত নারীকর্মীদের নিয়ে রিপোর্টগুলোর দিকে একটু নজর দেয়া যাক। দোরমুটিয়া গ্রামের তসলিমা, যিনি ভবন ধ্বসে মারা গিয়েছিলেন বয়স ছিল ২৫। তসলিমার দুটি সন্তান আছে। পুত্র সবুজ যার বয়স ১৪ এবং মেয়ে রুপালি, বয়স ৭।

রানা প্লাজার আরেক নারী কর্মী শিল্পী বেগম, যিনি ভবন ধ্বসে পড়ার ৮ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার হয়ে পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। আমরা পত্রিকা থেকে জানতে পারি যে, বর্ষা নামক তার ৪ বছরের একটি কন্যা সন্তান আছে।

অন্যদিকে মানব জমিনে প্রকাশিত আজকের সংবাদে জানতে পারি যে, ভবন ধ্বসের ১২ দিন পর পীরগাছা উপজেলার মাছুয়াপাড়া গ্রামে রহিমা বেগমের লাশ পাওয়া যায়। রহিমার বয়স ছিল ১৮। খবরে প্রকাশ, ১৮ বছরের রহিমার ৩ বছর আগে প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম রানার সাথে বিয়ে হয়। অর্থ্যাত রহিমার যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জনাব এরশাদ যে ৯ জন আহতকে আজীবন ভরনপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন এদের মধ্যে ১৬ বছরের আন্না ও সানিয়া আছেন।

অর্থ্যাত, পোশাক শিল্পে কাজ করা আমাদের নারী শ্রমিকদের অধিকাংশের বয়স ২১- ৩০ এর মধ্যে। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচেও অনেক আছেন। তাদের প্রায় সবারই এক বা একাধিক সন্তান আছে, যাদের বয়স ১ থেকে ১০ বছরের মধ্যে।

দেশে যে বাল্যবিবাহ বিদ্যমান এবং তা যে ভয়াবহভাবে ক্রমবর্ধমান তা উপরের সামান্য কিছু ঘটনা থেকেই প্রমানিত। এ যেন সমগ্র বাংলাদেশের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জীবনযাত্রার খন্ডচিত্র।

নিম্নবিত্ত পরিবারে কন্যা সন্তান জন্মানোর লগ্ন থেকেই আমাদের পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা বিয়ে দেবার চিন্তা শুরু করে দেয়। যে পরিবারে কন্যা বেশি সেই পরিবারে বাবা-মায়ের চিন্তা বেশি। মেয়েদের কোনোমতে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে পারলেই যেন দরিদ্র পিতামাতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

অথচ বিয়ে দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না, তা যেমন দরিদ্র পরিবারের বাবা-মা ভালোভাবে বোঝেন, তেমনি হতদরিদ্র বাবা-মায়ের ঘর থেকে হতদরিদ্র স্বামীর ঘরে গিয়ে হতভাগ্য কিশোরী মেয়েটিও তা ভালো জানেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মাতৃত্বের স্বাদ নেয়া ভঙ্গুর স্বাস্হ্যের কিশোরী মেয়েটি তাই জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ কেউ মা হতে গিয়েই মারা যায়।

এ কথা নয় যে, দরিদ্র বাবা-মায়েরা বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। কম বেশি সব বাবা-মায়েরাই জানেন অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে তার জন্য কি ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। কিন্তু এছাড়া উপায়ই বা কি?

আমাদের দেশের অধিকাংশ পোশাককর্মীরা তাদের শৈশব পার করেছে কারো না কারো বাসায় কাজ করে। সেই ৫ বছর বয়স থেকেই দরিদ্র পরিবারের মেয়েটি গ্রাম থেকে শহরে যায় বাসাবাড়িতে কাজ করতে। যে ছোট্ট মেয়েটির পুতুল খেলার কথা, শহুরে খালাম্মাগো বাসায় বিবিসাহেবার সদ্যজাত শিশুটিকে দেখাশোনা করার জন্য তাকে নামমাত্র বেতনে দরিদ্র বাবা-মায়েরা কাজে লাগিয়ে দেন। ভোর থেকে সারাদিন কাজ করে রাত ১২ টার আগেও ছোট্ট মেয়েটির ঘুমানোর অনুমতি মেলেনা। এর মাঝে টিভির দিকে কিংবা বন্ধ বাসার বারান্দায় দাঁড়ালেও চর-থাপ্পর কটু কথার বৃষ্টি বর্ষণ তো আছেই। এভাবেই বাসাবাড়ি গুলোতে কাজ করতে করতে এই ছোট্ট মেয়েগুলো শৈশব হারিয়ে কৈশোরে উপনীত হয়।

দেশের নারীরা অনেক অনেক এগিয়ে যাচ্ছে এই দাবি করলেও কি এক অজানা কারণে, বাসার গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে আমরা এখনো সেই শরতচন্দ্রের আমলেই পড়ে আছি। বাড়ির “কাজের ছেমরির” ১২-১৩ হলেই বিবিসাহেবা তার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে বলে মেয়ের বাবাকে জানিয়ে দেয়। আবার অনেক সময় দরিদ্র বাবা-মা নিজে থেকেই গ্রামে মেয়ের জন্য পাত্র দেখে এসে কিশোরী মেয়েটিকে বিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে যায়।

এরপরের কাহিনী তো সবার জানা। কেউ তালাকপ্রাপ্ত হয়ে, কেউ মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচারে কেউবা অভাবের তাড়নায় আবার গ্রাম থেকে শহরে পা বাড়ায়। ভাগ্য ভালো হলে গার্মেন্টেসে কাজ পায়। অথচ ততদিনে সবার কোলেই থাকে একাধিক সন্তান।বাচ্চা বয়েসেই বাচ্চার মা হয়ে হতভাগ্য মেয়েটি যেমন নিজের জীবন বিপন্ন করছে, ঠিক তেমনি তার শিশু/দের ভবিষ্যতও অন্ধকারে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

এভাবেই বাল্যবিবাহ আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাকাটিকে থমকে যেতে ব্যহত করছে। অথচ পরিসংখ্যান বলে যে, এক বাল্যবিবাহ বন্ধ হলেই আমাদের দেশে বছরে ১০ লাখ জন্ম কমবে, সে সাথে কমবে মাতৃমৃত্যু হারও।

গ্রামেগঞ্জে আমাদের কিশোরী মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে যদি কর্মক্ষম হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ দেয়া হয়, তবে অনাকাঙ্খিত অনেক সামাজিক সমস্যা এড়ানো সম্ভব।কিন্তু কর্মক্ষম হিসেবে গড়ে তোলার যাদের কাজ করার কথা, যারা কাজ করবেন এই আশায় আমরা ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করি, সেই সরকারী মন্ত্রনালয়গুলো শুধু টাকা পয়সা বরাদ্দ নিয়ে সারা বছর ঘুমিয়ে কাটায় এবং নিজেদের উন্নয়ন নিয়ে ব্যতীব্যস্ত থাকে।

সমস্যা কি আমরা সবাই জানি, সমাধানও জানি। সমাধান হয় না জন্যই রহিমা-তসলিমা-শিল্পীরা কুড়ি পেরুনোর আগেই লাশ হয়, ওদের হতভাগ্য সন্তানেরা একদিন ওদের মতই জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে, ওরাও একদিন লাশ হবে। এ যেন এক দুষ্টচক্র। মুক্তির উপায় সবাই জানি, কিন্তু জেনেও না জানার ভান করি।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment