গেমস সফটস এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম

২১শ শতাব্দীর প্রারম্ভে প্রযুক্তির উৎকর্ষ পৌছে গেছে সর্বত্র। প্রযুক্তির সমস্ত সুযোগ সুবিধা এখন রিমোর্ট কর্ন্টোল আর টাচ স্ক্রিনের মধ্যে – টিপ দিলেই পর্দায় ভেসে আসে আলাদীনের চেরাগ। না চাইলেও পর্দায় খোচা দেয় টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউব, ইত্যাদি। এসব টেকনোলজি কিন্তু শুধু আমাদের মনোরজ্ঞনের জন্য নয়, বরং হাল্কা সুরসুড়ি দিয়ে টানাটানি করছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে। এ টানাহ্যাচড়ার শেষ কোথায় এখনি বলা কঠিন। তবে এটা ঠিক যে, যারা মানব কল্যানের দুহাই দিয়ে অকল্যানের ব্যবসহা করে টেকনোলজি পুজি করে পুরা মানবজাতি নিয়ে তারা সহজে ছাড়বে না। কারণ টেকনোলজির উৎকর্ষ মাইক্রো থেকে ন্যানো এবং ন্যানো থেকে ফেমটোলজিতে পদার্পণ করবে এ শতাব্দীর কোন এক সময়ে।
এখন ঘরে-ঘরে বাচ্চাদের খেলার জন্য রকমারি গেম সফটস বেরিয়েছে বাজারে। দু’একটার নাম উল্লেখ না করলেই নয় যেমন বেকাগন, পকেমন, ড্রাগন বলজি ও সিমসেন্স। আজকাল বাচ্চাদের ঘরের মধ্যে ধরে রাখার জন্য মাতামাতি করার আর কোন দরকার নেই; একটা গেম সফট আর টিভি সেট কিনে দিলেই যথেষ্ট। ঢাকার কথা বল্লেতো আরো পোয়াবারো – বাইরে যাবার রিস্ক থেকে বাবা-মা’রা রেহাই পান। কারণ ঢাকাতে বাসার বাইরে বাচ্চাকে ছেড়ে দেয়া মানে অনিশ্চিত ভ্রমন! তাছাড়া সম্প্রতি পরকিয়ার যে নিন্মচাপ শুরু হয়েছে ঢাকাতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে-দেখে তাতে বাবা-মা’ও কিছুটা ফুরসৎ পান লঘুচাপে প্রেম করতে। ফলে টাকা-পয়সা যতোই লাগুক বা খরচ হোক না কেন এই ইকোনোমিক ডাউনটার্ণে, গেম খেলার সরঙ্গাম কিনতে বাবা-মা এক পায়ে খাড়া।
এটা যে শুধু আমাদের দেশের সমস্যা তা নয়, প্রত্যেকটা ডেপ্লপিং ও উন্নত দেশের সমস্যা। চিনের এক ডাটা থেকে জানা যায় যে, একটা উঠতি বয়সের বাচ্চা (ছেলে-মেয়া যাদের বয়স ৪~১৬ বছর) প্রতিদিন প্রায় ৪~৬ ঘন্টা সময় পার করে শুধু গেম খেলে। এই গেমগুলো শুধু যে কম্পিউটারে খেলা যায় তাই নয়, এটা যে কোন টিভিতেও খেলা যায়। এর বাইরে আরো অনেকভাবে খেলা সম্ভব (বহুমুখী ব্যবহার), যেমন ঢাকাতে প্রতি মহল্লায়-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজ়িয়ে উঠা ক্যাফেতে গিয়ে ক্লোজড-ডোরে (আনসেন্সর ডকুমেন্টস) বাচ্চারা সহজেই খেলতে/দেখতে পারে। তাছাড়া, পিএসপি, ডিএসপি, মোবাইল, ইত্যাদি-তো আছেই। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো গেম ইন-ছেটু (game specialist) হয়েই জন্ম নেবে কারণ এসব খেলাগুলো শুধু যে এখন বাচ্চারা খেলছে তা নয়, বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই পাগল। টেকনোলজির ছোবলে চাকরি-বাকরি হারিয়ে যাবার যোগাড় সবার কারণ ১০ জনের কাজ এখন একাই সম্ভব। ফলে বেকারত্ব থেকে রেহায় পেতে এখন সবাই এ থলিতে হাত ঢুকাতে চায় একটু শান্তির/প্রশস্তির আশায়। সাথে আরো কতোকি দেখা যায় যা নিয়ে অন্য কোন লেখায় তুলে ধরা যাবে।
এখন প্রতিটি ঘরে-ঘরে ২ থেকে ১৫ বছরের বাচ্চারা গেম নিয়ে খেলা করে। খেলাটাকে একটু উপভোগ্য করার জন্য অনেক সময় মা চা-পানিয়ের ব্যবসহ্যাও করেন; বিশেষ করে ছেলে-মেয়ের বন্ধুবান্ধব বাসাতে বেড়াতে এলে। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা আরো পেয়ে বসে – আবদার বাড়তে থাকে নুতন মাত্রায় নতুন গেম কেনার জন্য। গেম কিনতে কিনতে বাসার পড়ার টেবিল উপচে ড্রয়িং টেবিল পর্যন্ত ছেপে যায়। বন্ধুবান্ধব এলে দাম্ভিকের স্বরে বলে দেখ আমার কালেকশনস! ওয়াউ! ব্যাস, আর যাই কোথায়। দু’এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধুর বাড়ীর টেবিলও উপচে পড়তে থাকে। একে-একে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আট – ছেলেমেয়েদের ইনভল্বমেণ্ট গেমসসে বাড়তে থাকে জ্যামিতিকহারে। আদর করে বাবা-মা বলে, বাচ্চাটা কি যে পেয়েছে, গেম কিনতে কিনতে ঘর ভরে ফেলেছে আর লেখাপড়া ছিকেয় তুলেছে!
এখানেই যত সমস্যা ও অসম্ভবনা। গেম দেখতে দেখতে খেই হারায়ে ফেলে বাচ্চারা কারণ নীতিগতভাবে গেম সফটসের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পার্থক্য নেই। ফলে ছেলেমেয়েরা দিক হারায়ে খুজে নূতন দিগন্ত – ফিরতে পারে না লেখাপড়ার টেবিলে। ভেগাবন্ড লাইফে অভ্যস্ত হতে শুরু করে যা দেখা যায় প্রত্যেকটা গেমের শেষভাগে। সবচেয়ে জনপ্রিয় সিমসেন্স গেমসের দিকে একটু নজর দিলেই দেখা যায় যে পুরা গেমসের চরিত্র হলো সিলিনেস। ফলে যে বাচ্চা ২ বছর বয়স থেকে প্রতিদিন এই চরিত্র উপভোগ করে সে কি শিখবে? তাছাড়া অধিকাংশ গেমসের বেলায় দেখা যায় যে, শিক্ষনীয় কিছু নেই কিন্তু ছেলে-মেয়েদের মাঝে ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি – রিয়েল-আনরিয়েলের কনফিউশানে আবব্ধ। আজকাল্কার বাচ্চাদের দেখলে কেন জানি মনে হয় সবাই বেশ মজা করতে জানে – এক একটা পাকা কমিডিয়ান। এসব বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে আমাদের দুরন্ত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে তথাকথিত গেমস সফট। এবার বোঝেন ঠেলা! গেমের সাথে খেলতে খেলতে বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়ে রিয়েল-আনরিয়েল নিয়ে দ্বিধা-দন্ধ। কারণ গেমের মধ্যেতো সব কিছুই আছে; বাচ্চা কিভাবে বুঝবে যে কলা গাছে ধরে! কি চায় গেমে – আলীবাবার আশ্চর্য প্রদীপের সব আলো গেমের মধ্যে সিথে আছে। ফলে গেমের রিমোর্টে টিপ দিলেই বেরিয়ে আসে মেকি ভবের হাটবাজার।
এখানে ছোট্ট একটা উদাহরণ না দিলেই নয়। আমার বাচ্চার বয়স ১০। মাঝে মধ্যেই আত্নীয়-স্বজনের বাসায় যাবার সময় ফুল-ফল কিনতে গেলে তাকে বোঝাতে হয় কোনটা রিয়েল আর কোনটা মেকি। তো এ যখন অবসহা ১০ বছর বয়সের বাচ্চার তখন করনীয় কি? আমাদের ভেবে দেখার সময় কি এখনো আসেনি যে গেমস সফটস বাচ্চাদের আনাড়ি বানাচ্ছে, ধবংস করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে?
৮ জুলাই ২০১০ | ব্রোখহেভেন ন্যাশনাল ল্যাব, নিউইয়র্ক