অগ্নিতে নগ্নিকা- দিলরুবা শাহানা

অগ্নিতে নগ্নিকা- দিলরুবা শাহানা

ঘটনা দু’টি একই দিনে বা একই সময়ে ঘটেছিল। একটা বাগদাদে ঘটলো। আরেকটা ঘটেছিল, যতদূর মনে পড়ে, ব্রাজিল বা কলম্বিয়াতে। ইরাকের শহর বাগদাদে সাংবাদিক মুন্তাজার আল জায়েদী ২০০৮সালে ১৪ই ডিসেম¦র মহা শক্তিশালী দেশের মহা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতিকে পাদুকা ছুড়ে মারলো। এতে সারা বিশ্ব হৈ-হল্লা, উল্লাস- আনন্দে বেহুশ প্রায় । ঐ সময়টাতে বুশকে জুতা মারা বা বুশের জুতা খাওয়ার( কোনটা শুদ্ধ পাঠকেরা নিজ মর্জিমাফিক

ঠিক করে নেবেন) ঘটনায় মানুষ এমনি বুঁদ হয়েছিল যে সে সময়ে অন্য কোন ঘটনার দিকে ফিরে তাকানোর ইচ্ছা বা হুশ কারোও ছিলনা। কোথায় বুশ আর কোথাকার কোন এক অখ্যাত মডেল মেয়ের বিস্ফোরনে ছিট্কে পড়ে অলৌকিক ভাবে বেখবর হওয়া। কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! রাজরাজড়ার সঙ্গে নলখাগড়ার তুলনা কি চলে? চলেনা অবশ্যই। তবে বিস্ফোরনের শিখায় ছিট্কে উঠা মেয়েটির শেষ সাক্ষাতকার নিয়েছিল জায়েদীরই এক দেশী ভাই এ্যারেন নাজ্জার। মডেল ফডেলে তার আগ্রহ কখনোই ছিলনা। সেও মুন্তাজারের মতো বুকে সাহস নিয়ে যুদ্ধের ভয়ংকর সব ছবি তুলেছে। মানুষ যে কত জঘন্য হতে পারে এ্যারেনের তোলা ছবি দেখে বোঝা যায়। আবু গ্রাইব বন্দীশালায় কুকুর লেলিয়ে দিয়ে অসহায় ভীতসন্ত্রস্ত বন্দীদের পেসাব করিয়ে পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়া মানুষ নামের কলংক একদল জঘন্য জীবকে এ্যারেন জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ক্যামেরা বন্দী করেছে । যুদ্ধের মাঠ থেকে শক্তিধর দেশের পতাকায় মুড়ে ফেরত আসা অগুনতি কফিনের ছবি সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে ক্ষমতাবান পক্ষেরও মরছে। পৃথিবীর কাছে যে খবর লুকিয়ে রাখার চেষ্টা ব্যথ্র্ করে দিয়েছিল এ্যারেনের তোলা ছবি। এমন একজন সাহসী মানুষ কেন যে গুটিয়ে নিল নিজেকে? কেন সে মডেলের ছবি তোলায় নিবেদিত হল?

সে ছিল এমন একজন মানুষ যার কাছে ‘আমি’ ও আমার’ শব্দদুটো গুরুত পায়নি কখনো। সে ‘আমাদের’ ও ‘আমরা’ নিয়েই ভাবতে ভালবাসতো। সেই এ্যারেন একসময়ে দেখলো সে বড় একা।

যখন হঠাৎ অসুস্থ হল তার কন্যা। একাকী রুগড়ব স¤Íানের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত এ্যারেনের স্ত্রী চলে গেল সন্তানটিকে এক আত্মীয়ের কাছে রেখে। এইরকম পরিস্থিতি মানুষকে বাধ্য করে পৃথিবীকে ভুলে যেতে, নিজের জন্যই মনপ্রাণ ঢেলে দিতে। স্ত্রীকে দোষ দিতে পারছেনা এ্যারেন । যার স্বামী অগুনতি দিন, সপ্তাহ, মাস ঘরে ফেরার সময় করে উঠতে পারেনা সে কিভাবে একা একা রোগদুঃখ, অভাবঅনটনের সংসার পাড়ি দেবে। অনেক কষ্ট সহ্যের পর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল মেয়েটির। আর কষ্ট করতে সে অপারগ। এরপর এ্যারেন গুটিয়ে নিল নিজেকে। এতদিন সবার জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। আজ তাকে শুধুই আত্মচিন্তা করতে হচেছ। কি করে নিজের মেয়েকে বাঁচাবে, চিকিৎসার টাকা কিভাবে জোগার হবে এই চিন্তাতেই পাগলপারা অবস্থা।

কাজ সে একটাই জানে ছবি তোলা। এই ছবি তুলেই টাকা রোজগারে নামলো সে। যদিও ছবিগুলোতে আগেরমত আর অন্তরের দরদ মেশানো থাকেনা। ছবিতে সত্যপ্রকাশ ও জীবনের শৈল্পিক বিকাশ সন্ধানের ইচ্ছা বড় কষ্টে বাদ দিয়ে দিল সে। ছবির শিল্প মূল্য নয় বানিজ্যিক মূল্যের সুলুকসন্ধান হল তার বর্তমান আরাধ্য। গুণী ছবিতুলনেওয়ালার ছবি ভাল দামে বিকি-কিনি শুরু হল। অর্থসমাগম হল প্রচুর । নিজের কন্যাকে বিখ্যাত মাউণ্ট সিনাই হসপিটালে ভর্তি করার পর ভাবলো কন্যার উনড়বত চিকিৎসার টাকা জোগাতে আজ থেকে তার

মাঝে বাস করা শিল্পী আত্মাহুতি দিল । এই হসপিটালের নামই শুধু পর্বত সিনাই নয় আসলেও এর অবস্থান এত উঁচুতে যে সাধারন মানুষের পক্ষে এখানে পৌছানো পর্বতে আরোহনের সমান প্রায়। এও এক ব্যবসা। জগতে

জুড়ে ব্যবসারই জয়জয়কার। যে যতো ব্যবসা বুদ্ধির ধান্ধা বের করতে পারবে তার কপালে জুটবে সব বাহ্বা। সে ব্যবসাতে মানুষের অপকার হলেও কিছু যায় আসেনা, মুনাফা উঠলেই হল।

টাকার চিন্তা মাথায় রেখেই মডেল মেয়ের ছবি তুলে বিক্রির পরিকল্পনা করে এ্যারেন। তবে এতে কারওর অপকার হবেনা তা সে জানে। সাধারন মানুষের উপকারও যে হবেনা এবিষয়েও এ্যারেন নিশ্চিত।

মেয়েটিকে তখনও মিডিয়ার আলোতে আনা হয়নি। ‘আসছে’, ‘আসছে’, ‘অত্যাশ্চর্য মেয়ে এক আসছে’ প্রচার চালিয়ে মেয়েটির এজেণ্ট মিডিয়ার ময়দান গরম করে তুললো। ব্যবসায়ীরা হন্যে হয়ে পথ খুঁজছে কে আগে মেয়েটিকে বাজারে নামাবে তার পণ্য বিপনণের জন্য। ষঢ়যন্ত্র চলছে কে মেয়েটিকে আগে দখলে নিতে পারবে, কার পণ্যের জন্য মেয়েটি দাঁত কেলাবে, উরু উন্মোচিত করবে, বিবসনা হবে প্রায়। এজেণ্টের কাছে দরখাস্ত জমা পড়ছে গাদা গাদা। এ্যারেনও একটি আবেদনলিপি জমা দেয় মডেল মেয়েটির ছবি তোলার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। উদ্দেশ্য জানাতে দ্বিধা করেনি। অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার টাকা জোগাতে ছবি গুলো সে বিক্রি করবে। বিনিময়ে মেয়েটির পছন্দ মাফিক কিছু ছবি তুলে উপহার দেবে তাকে। এ্যারেনের আবেদনও অর্থ চিন্তা থেকেই উদভূত।

তবে তা একক ব্যক্তির অর্থহীন মুনাফার পিপাসায় নয়। এই অর্থ মানবিক প্রয়োজনে, মুনাফার প্রসারণে নয়।

মেয়েটির অলৌকিক সৌন্দর্য থেকে মনকাড়া শিল্প তৈরীর বদলে তাকে বাজারের জন্য লাভজনক পণ্য করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে লোভী মানুষেরা। ওর অতুলনীয় রূপই ওর জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে। অনেক মেয়েই কর্মকীর্তিতে নয় শুধু দর্শনীয় হয়ে সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে, তাদের জীবনের একমাত্র সাধনাও তাই। এই মেয়েটি তা চায়নি ফলে যত ঝুটঝামেলা ওর কপালে লেখা। মেয়েটি বুদ্ধিমতী সেজন্য তাকে ঘিরে অর্থকেন্দ্রিক অর্থহীন কর্মকান্ড দেখে ত্যক্তবিরক্ত ও ক্লান্ত সে। সবাই তাকে নানা মূল্যে কিনে নিয়ে বিজ্ঞাপনের মুখ করতে চায়। সবার আবেদনের সারকথা একটাই কি মূল্যে সে তার সৌন্দর্য বেচবে? এ্যারেনের আবেদন অন্যরকম। তাতে সে সাড়া দিয়েছে সাগ্রহে। কারন সে ভেবে দেখেছে এটি একটি ভাল

কাজ, মহৎ কাজ। তার সুন্দর চেহারা একজন অসুস্থকে সুস্থ করার জন্য অর্থ জোগারে সাহায্য করবে! এই প্রথম সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ার জন্য স্রষ্টার কাছে সে কৃতজ্ঞ হল। যদিও বানিজ্য, তবে তা মঙ্গলের জন্য। এখানে সে দাতা, বিক্রেতা নয়।

পাহাড়ের উঁচুতে কন্ভেন্শন সেণ্টারে নতুন মডেলের বোধন। কন্ভেন্শন সেণ্টারের মনোরম জমকালো চত¦রের রংবেরংয়ের ছোট ছোট ছাতার নীচে পৃথিবীর নামীদামী মিডিয়া সাংবাদিক, ফটো সাংবাদিকরা গিজ গিজ করছে । সূর্য অস্তাচলের পথে প্রায়। সন্ধ্যা নামলে পাহাড়ী অঞ্চলে মনোহারী যে সিড়বগ্ধতার আবেশ ছড়াবে তখন অনুষ্ঠাণ শুরুর বাঁশী বাজবে। তখনই অপেক্ষারত আমন্ত্রিত লোকজন প্রাসাদপ্রতিম সেণ্টারে প্রবেশ করবে।

এরই মাঝে সবাইকে বিস্মিত করে এ্যারেনকে দেখা গেল কন্ভেন্শন সেণ্টারের সদর দরজা দিয়ে বেরিযে আসতে। তাকে যারা চেনে তারা অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। এ্যারেনের ছবি অসাধারন, তার শৈল্পিক পারঙ্গমতাকে তারা ঈর্ষা যেমন করে তেমনি আবার এ্যারেনের বৈষয়িক বুদ্ধিহীনতাকে সমানভাবে অবজ্ঞাও করে। নিজের দক্ষতাকে আবেগতাড়িত হয়ে শিল্পসৃষ্টিতে ব্যয় না করলে আজ তাদেরই মত নামজাদা সংস্থার হোমড়াচোমড়া একজন হয়ে সে এখানে আসতে পারতো। যত দক্ষ হউকনা কেন এইরকম উদাসীন এলোমেলো

সাজসজ্জায় পরিচয়হীন একজনকে ঐরকম চোখ ঝলসানো অনুষ্ঠাণে কার দায় পড়েছে যে ডাকবে?

এ্যারেন সবার চোখের আড়ালে এসে রেলিংএ ঝুকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ভাবছিল মেয়েটির কথা। প্রকৃতি ও স্রস্টার নিজের হাতের সব মাধুরী ঢেলে সৃজিত শিল্প যেন একটি। তবে এ মাধুরী জীবন্ত, চলমান। মেয়েটিকে দেখলে মানুষের অ¤Íরের নান্দনিক সৌন্দর্য দর্শনের যে তৃষ্ণা তা পূর্ণ হবে। স্রষ্টা যেন সব মহাদেশের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য থেকে একটু একটু করে নিয়ে মেয়েটিকে গড়েছেন। আফ্রো মেয়ের ঋজুতা, এশিয়ান মেয়ের কোমলতা, ক্যারিবীয় মাদকতা, ঊষর মরুভূমির মেয়ের আগেড়বয় দীপ্তির সাথে ইউরোপীয় বালিকার আত্মপ্রত্যয়ের মিশেল যেন সে।

এ্যারেনকে মেয়েটি জানালো ‘বোরখা আর বিকিনিওয়ালা দু’দলই আমাকে চাইছে!’

বিস্মিত এ্যরেন প্রশ্ন করলো

‘কেন?’

‘ধর আমি যদি বোরখা পরি তবে বিকিনির বিজ্ঞাপনের মডেল কমে গেল একজন? বিকিনি আমি পরে হাজির হলে ক্রেতা অনেক টানবে নয় কি? বিজ্ঞাপিত পণ্য সেরা পণ্য সে পণ্যের মুখ যদি আমি হই তবেতো কথাই নাই।’

একটু দম নিয়ে আবার সে বললো

‘মানুষ বিজ্ঞাপনের বশ, অনবরত বলা হচ্ছে যদি অমুক কোম্পানীর জুতা না পর, তমুক কোম্পানীর গাড়ী না চড় জীবনটাই বৃথা । এরমাঝে আমার মত মডেলকে দিয়ে যদি এসব বলানো যায় তখনতো নিজের পছন্দ রুচি ভুলে গিয়ে মানুষ বিজ্ঞাপনের আজ্ঞাবাহী দাস হয়ে যাবে।’

এরমাঝে মেয়েটি এ্যারেনের স্যুয়েটারটি এক ঝলক্ দেখে নিয়ে বললো

‘তোমার স্যুয়েটারটা সু›˜রতো! কোন ব্র্যান্ড নেইম এর?’

এ্যারেন বলেছিল

‘আমার স্ত্রী বুনেছে আর আমি ব্র্যান্ড নেইমএর জন্য ক্রেজী না। একটা হলেই হল।’

‘মানে! তবে কি তুমি টমি হিল ফিগার ব্র্যান্ডএর জামাও পরবে? যারা তাবৎ কালো মানুষকে অপমান করেছে এই কথা বলে যে তারা কালোদের জন্য পণ্য তৈরী করেনা। কালো মানুষকে ক্রেতা ভাবতেও ওদের ঘেন্না করে! ঐ দেখ তাদের দরখাস্ত আমি ছিড়ে ফেলে দিয়েছি।’

অপূর্ব সুন্দর তর্জনী তারচেয়েও মনোরম ভঙ্গিতে উত্থিত হয়ে কাগজ ফেলার ঝুড়ি দেখিয়ে দিল।

‘আমি জানি এটা ভাল করে, শুনে ভাল লাগছে যে তুমি ওদের পণ্য প্রমোট করছোনা। হাসি পায় যখন দেখি কালো ও বাদামী চামড়ার লোকেরা ঐ টমি হিল ফিগারএর জামা পরে, ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজেদের বিত্তের বিজ্ঞাপনে

ব্যাকুল হয়’

মেয়েটি তখন বিষাদ মাখা কণ্ঠে বললো

‘তখন ওদের আত্মসন্মানহীনতা ও মূর্খতাও যে বিজ্ঞাপিত হয় তা ওরা বুঝে না;’

ধীরে ধীরে এবার সে নিজের মনেই বললো

‘কর্পোরেট দানবদের পছ›˜ মত না চললে ওরা আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারে তা জান কি?’

মনে মনে এ্যারেন বলেছিল বিশ্বায়নের যুগে মাল্টি ন্যাশনাল কর্পোরেটকে রাগালে দেশের সরকারকে পর্যন্ত গদী ছাড়া করে ক্ষান্ত হয় তারা আর তোর মত ক্ষমতাহীন একজন মডেলের কপালে কি ঘটবে কে জানে?

সূর্য যেই ডুবলো এ্যারেন রেলিংএর কাছ থেকে সরে এলো। বাইরে কেউ আর নেই এই মূহূর্তে। তখনি প্রচন্ড শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠলো। কন্ভেন্শন সেণ্টারের প্যাগোডার চুড়ার মত ছাদ ফেটে আগুনের শিখা দাউ দাউ করে

জ^লে উঠলো। সে জলন্ত শিখার শীর্ষে চড়ে এক নগিড়বকার দেহরেখা ছিট্কে বেরিয়ে আকাশে যেন মিশে যেতে লাগলো। কোন ফ্যাসন ডিজাইনারের তৈরী পোষাক নয় আগুণের শিখা পরম মমতায় তার সবটুকু লজ্জা ঢেকে রাখলো।

এ্যারেন কি ভেবে যেন এই ছবিটি আর তুললোনা।

(শব্দসংখ্যা ১৩৭৩)


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment