স্বপ্ন-বিধায়ক (গৌরচন্দ্রিকা)

স্বপ্ন-বিধায়ক (গৌরচন্দ্রিকা)

কোথায় যেন একটা গান বাঁজছে, সুরটা এত চেনা চেনা কিন্তু কোনো ভাবেই মনে করতে পারছেনা এটা কোন গান। মাথার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁপা ফাঁপা লাগছে, তিনতলার বারান্দা থেকে রাস্তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্যাস। একটা ফেরিওয়ালা মধ্যদুপুরের অলস নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙ্গে “এই মুরগি ঈঈ ” ….বলে ক্রমাগত ডেকেই  যাচ্ছে, পাশের বাসার আন্টি জানালা দিয়ে চি९কার, ” এই কত করে? ” দোকানের নিচে পাড়ার কতগুলো ছোট ছোট ছেলে ষোলোগুটি নিয়ে উত্তেজিত, বয়োজ্যেষ্ঠরা দুই দলেভাগ হয়ে ওদের শলা পরামর্শ দিচ্ছেন, ওরা খুব একটা কেয়ার করছে বলে মনে হচ্ছে না।

নির্যাসদের বাসার উল্টো দিকের বাসাটা পাঁচ তলা। এক আপু আর তার শ্বাশুড়ি থাকেন ওই ফ্ল্যাটটাতে। উপরের ঐ আপুকে সবসময় দেখা যায় কাপড় শুকাতে দিতে, সারাদিন এত কাপড় কোথায় পান কে জানে? আপুর সব চেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে উনার ম্যাক্সির বোতাম কখনোই সব কয়টা লাগানো থাকেনা, পাশের বাসার আঙ্কেলকে সারাদিন দেখা যায় খবরের কাগজ নিয়ে বারান্দায় বসে থাকেন, সারাদিন কি এতো খবর পড়েন কে জানে! আপুর হাসবেন্ড কুয়েতে থাকেন শোনা যায়, ঐ আন্কেল কুয়েতের খবর বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়েন কারন কখনোই তাকে পাতা উল্টাতে দেখা যায় না।

নির্যাসের আজ কিছুই ভালো লাগছেনা, অপেক্ষার অস্থিরতা যে কতোটা ভয়ংকর হতে পারে ওর এই ২৪ বছরের জীবনে এতোটা উ९কট হয়ে কখনো দেখা দেয়নি। পাঁচ তলার আপুটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো, উনার সাথে কোনো ভাবে এমন হলেই উনি কেমন একটা প্রশ্রয়ের হাসি দেন, নির্যাসের দমবন্ধ হয়ে গা টা গুলিয়ে আসে। সকাল থেকে শুধু এক কাপ চা পেটে পরেছে, কতগুলো সিগারেট খেয়েছে মনে করতে পারছেনা, উল্টো ঘুরে নিজের রুমের দিকে মুখ করে আরেকটা সিগারেট ধরালো- অপেক্ষা,অন্তহীন অপেক্ষা। কাল বিকেলের ঐ ঘটনাটা এমনভাবে ঘটে যাবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি।

সিগারেটটা একদম তিতকুটে লাগছে, এর চেয়ে কুইনাইন খাওয়া মনে হয় অনেক সহজ, সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে আবার বারান্দার নীচের দিকে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে তাকিয়ে থাকা, বিকাল ৫ টা কখন বাজবে ? কাল রাত থেকে অপেক্ষা, সবে বাজে দেড়টা | নির্যাস আস্তে করে রুম এর দরজা খুলে বের হলো, মা খাবার সাজাচ্ছেন,” এতক্ষণে উঠলি?” মা বলে যান, ” সকালেও এক কাপ চা ছাড়াকিছু খেলি না বাবা, এমন করলে শরীর খারাপ করবে, তোর পছন্দের লাউয়ের ছিলকার ভর্তা করেছি, আর ডিম সবজির ঝোল,ভালো করে খেয়ে নে, বিকেলে আবার না কই দুনিয়া উদ্ধার করতে বেরোবি ? ” নির্যাস একটা ছোটো হাসি দেয় ভাবে মা সারাটাজীবন একা হাতে কেমন করে সংসারটা আগলে চলেছেন, হোমমেকার এর পুরা রিয়েল লাইফ উদাহরণ।

গোসল শেষ করে রুমে ঢুকে দেখে কেমন জ্বর জ্বর লাগছে, বমি বমি ভাবটা গিয়ে এখন শরীরটা হালকা লাগছে। এমন যদি একটাসিস্টেম মনের জন্য থাকত তাহলে মন্দ হতো না| শরীর হালকা লাগলে মনে কবিতা আসে, নির্যাস ফিসফিস করে আপনমনে বলেযায়

“তোমার হাত দুটি না ধরতে পারি
চোখ চেয়ে তো দেখতে দেবে,
না ছোয়া ওই ছোয়ার নেশায়
মরণ খেলা তো খেলতে দেবে,
আর না পারি ভালবাসার জুয়া তো খেলতে পারি,
ধূমকেতু হয়ে ছায়াপথে তোমার সাথে থাকতে পারি। ”

কোথায় যে কবিতাটা পরেছিল মনে নেই, কিন্তু ভালো লেগেছিল বেশ। ‘ভালবাসার জুয়া’ বেশ মজা লেগেছিলো উপমাটা। এখন বেশ ভালো লাগছে, ক্ষুধা পেয়েছে, মা খাচ্ছেন টেবিলে, নির্যাস যেয়ে মায়ের পাশের চেয়ারটাতে বসলো, ডাইনিং রুমের জানালা দিয়ে দর্জির দোকানের ওই গানটা আবার শোনা যাচ্ছে, গানটা এবার চিনতে পারল নির্যাস, হাবিবের একটা গান, “ভালোবাসববাসবোরে বন্ধু প্রেমের কারনে  ….” এতক্ষণ চিনতে পারেনি কেন কে জানে? দর্জির দোকান গুলোতে সবসময় একই গান বারবারবাজায় কেন কেউ বলতে পারবে? বেশ তৃপ্তি করে খেযে মাকে বললো “ইউ আর দ্যা বেস্ট কুক ইন দ্যা প্লানেট মা “- মা যারপরনাই খুশি হয়ে যান।

খেলেই  শরীরে কেমন  অবসন্ন হয়ে  আসে, রাত থেকে কিছু পেটে না পরায় অনেক  খেয়ে ফেলেছে, বাঙালির কাজের আউটপুট এত্তকম কেন এই নিয়ে নির্যাসের নিজস্ব একটা থিওরি আছে , এর একমাত্র কারন ভাত। ভাত না খেয়ে বাঙালি থাকতে পারেনা, মজারএকটা গল্প মনে পরে যায়- ওর আগের অফিস এর বস ছিল একদম অকাটমূর্খ, পুরান ঢাকাইয়া কুট্টি, ছিল কাড়ি কাড়ি টাকা আরকিছু পদলেহনকারী কর্মচারী, বস যাই বলত তাতেই আহা উহু বলা আর মাসকাবারি বেতনটা নেয়া ছাড়া ওদের কোনো কাজ ছিলনা, প্রতিদিন দুপুরের খাবার সময় অফিস এ ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে যেত, বাসা থেকে রান্না করা আট/দশ রকমের তরকারী, ভর্তা-ভাজিআসত উনার জন্য, উনি উনার মার্বেল পাথরের প্রমান সাইজের টেবিলটাতে সব ছড়িয়ে  ছিটিয়ে নিয়ে বসতেন একটা বিশালভাতের থালা। এত তৃপ্তি করে কাওকে কখনো ভাতের উপাসনা করতে দেখেনি, প্রতিদিন খাওয়া শেষ করে উনি একটা কথাইবলতেন, ” জীবনের মানে কি জানো তোমরা? চাইট্টা ভাত, আর সালুন (তরকারী) আর এরপর শান্তির একটা ঘুম ” । অফিসেরটেবিলের উপরেই এরপর একটা ঘন্টাখানেকের একটা ঘুম দিয়ে নিতেন, এই সময় অফিসের সব কাজ মোটামুটি বন্ধ থাকতো। বেশপরহেজগার লোক ছিলেন, সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে অফিসে জামাত হত, ফির বছর ১০/১৫ জনের একটা দল নিয়ে নিজ্খরচে হজ্ব করতেযেতেন, পাপের খাতা শূন্য করে আবার দেশে ফিরে আবার ঘুষ দেয়া নেয়া আর নানা অনৈতিক কাজের হালখাতা বউনি করতেন।ধর্মভীরু বাঙালির এই রূপ কি শাশ্বত ! নির্যাসের হাসি চলে আসে।

বিছানার উপর আইপডটা পরে আছে, শরীরটা ভেঙ্গে আসছে, না ঘুমিয়ে একটা পুরো রাত আর আধবেলা, কানে ইয়ারফোনটা কানে লাগিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় নির্যাস। শাফল অপসনটা অন করা, বাংলা প্লে-লিস্টটা দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে|কানেরভেতরে মৃদু গীটারের প্লাকিন, তপুর গলা ভেসে আসে

“তুমি চাও রোদ্দুর
আমি চাই আকাশ মেঘলা
খোঁজ পূর্ণিমা
বলি চাঁদ ডুবে যাক না
ছুটে চলো একা দুরে
আমার ইচ্ছে করে না
দু’জনেই দু’জনাকে চাই তবুও
নিজেদের আজ কেউই চাই না
মেলে না আজ কিছু মেলে না
ভালোবাসা আর বাঁচতে চাওয়া ছাড়া
এ দুটোই মিলে যায়
বসে একা ভাবি তাই
—এই কি বেশী না
এই কি বেশী না
বলো এই কি বেশী না
আজ এই কি বেশী না?  ”

ইয়ারফোনের এই ব্যাপারটা খুব মজা লাগে ওর, গোটা পৃথিবীর থেকে আলাদা করে দেয়, থাকে শুধু ও আর এলোপাথারি সুর। হঠা९ রিনিঝিনি চুরির শব্দ, বারান্দায় দাড়িয়ে আছে সুনয়না, বারান্দায় যায় নির্যাস, উল্টোদিকের কোনো একটা বাসা বিয়ের সাজে, হলুদ লাল এলইডি লাইটগুলো একটা ছন্দে জ্বলছে আর নিভছে। সাথে রাস্তার নিওন লাইট মিশে ওর বারান্দাটা মনে হচ্ছে স্বপ্নপুরী,সন্ধ্যার ক্ষয়ে যাওয়া লাল আলোতে চুল খোলা সুনয়নার দিকে তাকিয়ে কেমন থতমত খেয়ে যায় ও, বুকের ভিতরে হৃতপিন্ড যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে, কিন্তু আশ্চর্য রকম নিঃস্তব্ধ পুরো এলাকা, নির্যাসের মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, সুনয়না এগিয়ে আসে ওর দিকে, আলতো করে নিজের চুলগুলো একপাশে সরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্যাসের চোখের দিকে, নির্যাসের হৃতপিন্ডেরগতি আরো দ্রুত হয়, দুহাতে ওর মুখটা তুলে নেয় দুহাতে, সময় যেন থমকে দাড়িয়ে, হঠাথ সরে যায় সুনয়না, নির্যাস দেখে পাশেরবাসার আঙ্কেল নিজের পেপার পড়া বাদ দিয়ে তীর্যক চোখে তাকিয়ে আছে, দৌড়ে ভেতরে চলে আসে দুজনে।

সুনয়না জড়িয়ে ধরে নির্যাসকে, নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা আর, ঐ পাখিগুলোর মতো, যারা মৃত্যু অবধারিত জেনেও ঝাঁপ দেয় আগুনে, অসম্ভব ঘোর লাগা জ্বরতারিত লাগে নিজেকে, সুনয়না ফিসফিস করে বলে যায়, ” শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই, তোমাকে চাই… তোমাকে চাই …চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় নির্যাসকে…হাত খেলা করে ওর বুকে, চুরির রিনিঝিনি শব্দে আর ‘তোমাকে চাই ফিসফিসানি’, ধরমর করে উঠে বসে নির্যাস, ধাতস্ত হয়ে দেখে কানে বাঁজছে কবির সুমনের ‘তোমাকে চাই’- ডাইনিং টেবিলে মা বাবার জন্য চা বানাচ্ছে ওখানেই টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে, জ্বরে অর গা পুরে যাচ্ছে,ঘামে ভিজে একসা। স্বপ্ন কখনো এত বাস্তব হয় !

ওষুধের বাক্স ঘেটে দুটা প্যারাসিটামল বের করে ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি গিলে ফেলে মাকে বলে “আমাকে কড়া এক কাপ কফি দাও না মাগো, জ্বর জ্বর লাগছে। ” কফি হাতে নিয়ে বারান্দায় ফেরত আসে, একটা সিগারেট ধরায়, হাত কাঁপছে এখনো,এখনো স্বপ্নের ঘোর কাটেনি ওর। নির্যাস স্বপ্ন দেখে না সাধারনত, কিন্তু যখন দেখে তখন বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার ফারাকটা কেমন যেন খুব ক্ষীন হয়ে যায়।

ঘটনার শুরু বছর খানেক আগে, এক বন্ধুর বাসায় প্রথম দেখে সুনয়নাকে, প্রথম দেখার  কথা একদম স্পষ্ট মনে আছে, মেয়েটার মধ্যেকোনো ভনিতা নেই, অসম্ভব স্নিগ্ধ একটা চেহারা, চশমা পরে নির্যাসের মতোই, দেখলেই মনে হয় রবীন্দ্র সংগীত গায়। পরিচয় হবার পর কথা হয় একদম অল্প, কিন্তু এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে কথা বলার তাগিদ অনুভব করে ও, মনে হয় আরো একটু কথা হলে ভালো হতো।

(চলবে)



Place your ads here!

Related Articles

Greetings from Bangladesh!

Thirty years ago, I landed in Bangladesh for what I then thought would be a short stay. I visited Char

খুঁজে নিয়েছি আমায়

এই করোনায়নীল আকাশ ভালোবাসেপাঠায় মেঘ আমি হাঁটি ছায়ায় ছায়ায় এই করোনায়চলতি পথের পাখিকাছে এসে মিষ্টি করে পা ঠোকরায় এই করোনায়পিচঢালা

চুপচাপ থাকলে চলবে না, মাঠে নামতে হবে

সাক্ষাৎকার : অজয় রায় চুপচাপ থাকলে চলবে না, মাঠে নামতে হবে অজয় রায়, অভিজিৎ রায়ের বাবা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment