পায়ে প্যাডেল, মনে কবিতা, মুখে গান
![পায়ে প্যাডেল, মনে কবিতা, মুখে গান](https://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2015/08/ishrafil-890x395_c.jpg)
তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মতো হবে, প্রথম আলো কার্যালয়ের নিচে চা খেতে খেতে সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা রিকশা এসে দাঁড়ায় আমাদের পাশে। রিকশাটা এক পাশে রেখে চালক এগিয়ে এলেন। ভাবলাম পাশের দোকানে চা খেতে নেমেছেন তিনিও। কিন্তু দোকানে না ঢুকে এগিয়ে এলেন বাইরে দাঁড়ানো আমাদের দিকে। বললেন, ‘আপনারা পত্রিকার লোক হলে দুটো কথা বলব।’
সাগ্রহে সায় দিই আমরা। মাঝারি উচ্চতার লোকটির গলায় গামছা, ঘামে ভেজা শরীর। রুক্ষ মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, অচর্চিত চুল ধারণ করেছে লালচে রং। কুর্তার কয়েকটা বোতাম নেই, সেটা কোনো মতে নেমেছে কোমর পর্যন্ত।
মুহূর্ত খানেকের জন্য মনে ভাবনা এল সাহায্য চাইতে এসেছেন হয়তো। কিন্তু ভুল ভাঙল তাঁর কথায়। ‘হাতে সময় থাকলে দুটো কবিতা শোনাতে চাই।’ বিস্মিত হয়ে ভালো করে তাকাই আরেকবার তাঁর দিকে। ততক্ষণে তিনি পড়তে শুরু করেছেন, ‘উঁচু ওই পাহাড়ে/ দেখি যেন কাহারে/ ছুঁতে চায় মন/ পাই না যে তারে/ আহারে আহারে…’
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ক্ষীণ কণ্ঠে অবিশ্বাসীর প্রশ্ন, ‘আপনার লেখা?’ মাথা নিচু করে সায় দেন তিনি। ‘হ্যাঁ, আমি ইস্রাফিল, রিকশাওয়ালা কবি। বাংলাদেশের রিকশাওয়ালা কবি।’
এরপর ঘণ্টা খানেক কেটে গেল আলাপে আলাপে। জানা হলো তাঁর কাব্যচর্চা আর সংগীত প্রতিভার কথাও। চট্টগ্রামে এসেছেন মাস চারেক। এর আগে রাজশাহীতে রিকশা চালাতেন। এখানকার ঠিকানা এখন চকবাজারের ভোলা শাহ মাজারের পাশের একটি মেসবাড়িতে। গ্যারেজে রিকশা জমা দিয়ে লিখতে বসেন রাতে, সুর তুলে রেকর্ড করে রাখেন মুঠোফোনে। সঙ্গী চালকেরা ঘিরে ধরে তাঁকে। মজলিশ বসে যায় রীতিমতো। সবার প্রশ্ন, ‘কবি হওয়া কি তোমার কাম মিয়া?’ ইস্রাফিল তখন মনে করিয়ে দেন আসানশোল শহরের রুটির দোকানের ছেলেটির কথা। সগর্বে তাঁদের বলেন, ‘নজরুল পেরেছেন, আমিও পারব।’
সময় নিয়ে একদিন আসতে বলি তাঁকে। আরও কবিতা, গান ও বৃত্তান্ত শোনার জন্য। কথা রেখে ইস্রাফিল ঠিক ঠিক এলেন সপ্তাহ খানেক বাদে। হাতে কবিতার খাতা। সেটি ওল্টাতে ওল্টাতে শুনতে থাকি তাঁর কথা।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মচমইল মাধাইমুড়ি গ্রামের বাসিন্দা ইস্রাফিলের বাবা ছিলেন পেশায় জেলে। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাড়িতে অভাব থাকা সত্ত্বেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন বাবা। নিয়মিত পড়াশোনা করে এসএসসি পরীক্ষাও দিয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। তবে তাঁর নিজের কথায়, লেখাপড়ায় তেমন মন ছিল না বলে পাস করা হলো না। আর সেখানেই থামল ইস্রফিলের শিক্ষাজীবন।
.এরপর কখনো পোশাক কারখানা, কখনো পাটকলে চাকরি করেছেন। সামান্য বেতনে চলছিল না বলে সব ছেড়ে রাজশাহী শহরে এসে রিকশা চালানো শুরু করেন। স্কুলে লেখাপড়ায় তেমন নাম না করলেও নাটক করেছেন, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কবিতা আবৃত্তি আর গানও করেছেন মঞ্চে। ১৯৯৬-৯৭ সালের কথা। শ্রমের ভার লাঘব করার জন্য গুনগুনিয়ে গাইতেন প্যাডেলে পা রেখে। কিন্তু ভাবেননি কখনো লিখতে শুরু করবেন। একটা ঘটনাই পাল্টে দিল সবকিছু। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সামনে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি। এক যাত্রী গন্তব্যের কথা বলে দরদাম শুরু করলেন। বনিবনা না হওয়ায় সজোরে থাপড়। সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ। আশপাশের কেউ প্রতিবাদ করল না। এগিয়েও এল না। রিকশাওয়ালা থাপড় খাবে এটাই যেন স্বাভাবিক। যতটা শারীরিক কষ্ট তার শত গুণ অপমানে দুমড়ে–মুচড়ে গেলেন ইস্রাফিল। চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে আসা রাস্তা দিয়ে গ্যারেজে ফিরেই লিখলেন, ‘রিকশা চালাই মানুষ তো নই/ জীবজন্তু ভাবো/ থাপ্পর তো দিতেই পারো/ তোমার লাথি–গুঁতাও খাব।’
দুঃখে থরথর শরীরটা শান্ত হয়ে এল। দেখলেন, যন্ত্রণা আশ্চর্য ফসল ফলিয়েছে তাঁর মনের জমিনে। সেই থেকে তাঁর লেখার শুরু। এ পর্যন্ত কয়েক শ কবিতা লিখেছেন। গান বেঁধেছেন শতাধিক। রাজশাহীর রেডিও পদ্মায় একসময় নিয়মিত অনুষ্ঠানও করেছেন।
প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধির কাছ থেকে নম্বর জোগাড় করে মুঠোফোনে যোগাযোগ করি রেডিও পদ্মার প্রেজেন্টার ও প্রোগ্রাম প্রোডিউসার নাসিমা জামানের সঙ্গে। রাজশাহীর এই এফএম বেতারে ‘কবির কবিতা’ ও ‘গানে গানে কবিতা’ নামে দুটি অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন তিনি। ইস্রাফিলের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে ‘কবির কবিতা’ নামে আধা ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানে ইস্রাফিল কবিতা পড়েছিলেন। একই বছর ‘গানে গানে কবিত’ অনুষ্ঠানে স্বরচিত গান গেয়ে শোনান ইস্রাফিল। নাসিমার কথা, ইস্রাফিলের কবিতাগুলো অনেক তরুণ কবির কবিতার চেয়ে ভালো। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা।
ইস্রাফিলের লেখায় এখনো কাঁচা হাতের ছাপ রয়ে গেছে। তবু তাঁর বাস্তবতা বিচার করলে সেসবকেই অর্জনই বলতে হয়। নিজের গ্রাম নিয়ে এই কবি লেখেন, ‘মাধাইমুড়ির গাঁয়, মনটা ছুটে যায়/মাঠ-ঘাট ধানখেত/মায়ের মমতায়…’
ইস্রাফিল এক সন্তান দুর্জয়ের (৬) বাবা। তবে কবিতা লেখার বাতিকের কারণে স্ত্রী ঊর্মি আক্তার রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেছেন। ইস্রাফিল বলেন, তাঁর স্ত্রী একদিন ঠিকই বুঝতে পারবেন। আর কবিদের জীবনে এমন দুঃখ তো থাকেই। মায়ের কথা, মাধাইমুড়ির কথা মনে হলে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। ইস্রাফিল গাছের ছায়ায় রিকশা রেখে লিখতে বসেন।
কবিতার সঙ্গে থাকবেন সারা জীবন। শত বাঁধা আসুক, স্বপ্ন তিনি দেখবেনই। চোখ বুজলেই যে নজরুলকে দেখতে পান তিনি।
original source at http://www.prothom-alo.com
Related Articles
কথা, সুর আর গানে অলিম্পিকে দ্বিতীয় সেরা ‘আমার সোনার বাংলা’ গার্ডিয়ানের সাংবাদিকের মূল্যায়ন
প্রথম আলো ডেস্ক‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বিশ্বের ২০৫টি দেশের জাতীয় সংগীতের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। ব্রিটেনের বিখ্যাত
Barapukuria Coal Mine: Khaleda, 10 of her ministers sued for corruption
The Anti-Corruption Commission (ACC) yesterday filed a case against detained BNP Chairperson Khaleda Zia and 15 others including 10 former