বিরোধীদের নিয়েই কিন্তু চলতে হবে

বিরোধীদের নিয়েই কিন্তু চলতে হবে

বাংলাদেশে পূর্বনির্ধারিত ৫ জানুয়ারির ভোটপর্ব নির্দিষ্ট সময়েই সমাধা হয়েছে। কিন্তু তার মাধ্যমে সে দেশের রাজনৈতিক জটিলতাগুলির সমাধান হয়েছে, এমনটা সম্ভবত কেউই দাবি করবেন না। জাতীয় সংসদের মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে প্রার্থীরা আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন। ভোটের ফল প্রকাশের পরে জানা গেল, মোট ২৩২টি আসনে অর্থাৎ তিন-চতুর্থাংশের চাইতে বেশি আসনে শাসক আওয়ামি লিগ দল জয়লাভ করেছে। এ ছাড়া, আওয়ামি লিগের অন্যতম শরিক এবং ইদানীং ছত্রভঙ্গ জাতীয় পার্টি এরশাদ-জায়া রওশন এরশাদের নেতৃত্বে ৩২টি আসনে জয়ী হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত শেষ সাধারণ নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ ভোটদাতা ভোট দিয়েছিলেন। এ বারে, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বি এন পি) পরিচালিত ১৮ দলীয় বিরোধী জোটের ভোট বয়কটের ডাক এবং দেশব্যাপী ব্যাপক হিংসাত্মক কাজকর্মের প্রেক্ষিতেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, ভোটের হার ছিল অত্যন্ত কম। কোনও দাবি অনুযায়ীই তা ৪০ শতাংশের বেশি ছিল না। বহু ভোট-কেন্দ্রে এক জন ভোটদাতাও ভোট দিতে আসেননি। শতাধিক ভোট-কেন্দ্র, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল স্কুলবাড়ি, ভোটের আগেই আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, ৫ তারিখের ভোটপর্বের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে পর্যায়ক্রমিক নির্বাচনের ধারা অক্ষত রইল বটে, কিন্তু এই ভাবে নির্বাচিত সরকার কতটা বৈধ, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলে দিল। ফলে, একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ সরকার তার পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে।

উল্লেখ্য, পোশাক শিল্পে বিপুল অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থার প্রশংসনীয় উন্নতি ঘটলেও, বিভিন্ন দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচি এবং উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণের জন্য বছরে এখনও অন্তত ৩০০ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা প্রয়োজন। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই এ বারের ভোট নিয়ে তাদের গভীর সংশয় প্রকাশ করেছে। এই সব দেশ বা জোটের তরফে প্রথা মাফিক ভোট পর্যবেক্ষক দলও বাংলাদেশে এ বার পাঠানো হয়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান-কি-মুনও দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামি লিগ এবং বি এন পি-র পারস্পরিক আলোচনার উপরে জোর দিয়েছেন। এই আহ্বানে প্রত্যাশিত সাড়া না মেলায় সংকট গভীরতর হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। আগামী ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনা সরকারের আগের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হলে দেশের ভিতরে ও বাইরে ক্রমবর্ধমান চাপ শাসক দল কী ভাবে সামলায়, তা লক্ষ করবার।

অর্থ/রাজ-নীতি

যে পোশাক শিল্পের সাফল্য বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আগের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে, তার মধ্যে সাম্প্রতিক পুঁজি-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের নানা বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত প্রকট। সে দেশে বিগত তিন দশকে বিকশিত পোশাক শিল্পে অন্তত ৪০ লক্ষ মানুষ কাজ করেন। ২০০০ কোটি ডলারের এই শিল্পের অগ্রগতির ফলে সারা দেশে এ ধরনের কারখানার সংখ্যা সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার। বাংলাদেশের হয়ে বিদেশি মুদ্রা উপার্জনে এই শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই শিল্পোৎপাদনে যুক্ত শ্রমিকদের এক বিরাট অংশই মহিলা। নারীর ক্ষমতায়নেও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিশেষ অবদান রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। কিন্তু পাশাপাশি, এই শিল্পের অন্ধকার দিকটিও লক্ষণীয়।

নামমাত্র মজুরিতে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পে অধিকাংশ শ্রমিককেই প্রাণ হাতে করে কাজ করতে হয়। বাংলাদেশে শস্তায় উৎপন্ন পোশাকের চাহিদা সম্প্রতি আমেরিকা, ইউরোপ-সহ পৃথিবীর অন্যত্র বাড়তে থাকায় যত্রতত্র অপরিকল্পিত ভাবে এর প্রসার ঘটেছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি ছাড়াও তাঁদের নিরাপত্তার দিকটিও কার্যত উপেক্ষিত। গত বছরে দেশের রাজধানীর অনতিদূরে সাভারে রানা প্লাজা নামাঙ্কিত বাড়িটি ভেঙে পড়লে অন্ততপক্ষে বারোশো শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক বাজারে বিপুল চাহিদার ব্র্যান্ডের, নামী-দামি ফ্যাশনের পোশাক সেলাই বা বোতাম লাগানোর কাজেই তঁরা যুক্ত ছিলেন।

রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরে বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে এই শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপক হইচই শুরু হয়। চাপে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিক নিরাপত্তার অভাবের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে এত দিন বিনা শুল্কে আমদানি করা পোশাকের উপরে বিধিনিষেধ আরোপে উদ্যত হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও এই শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে সরব হয়। যে সমস্ত নামী-দামি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের হয়ে ওই পোশাক তৈরি হয়, তাদের তরফেও মায়ানমার, ইথিয়োপিয়া বা কাম্বোডিয়া থেকে অনুরূপ ব্যয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে যত কম খরচে এবং দায়হীন ভাবে কাজটি করিয়ে নেওয়া সম্ভব, তার জুড়ি মেলা সত্যিই ভার। চিনে শ্রমিকদের মজুরি তুলনায় বেশি। প্রতিবেশী ভিয়েতনামে পোশাক শিল্পে শ্রমিক সংখ্যা ১৫ লক্ষ, আর কাম্বোডিয়াতে তা মাত্র ৬ লক্ষ ১৫ হাজার। দেখা গেছে, শেষ পর্যন্ত নানারকম চাপের মুখে বাংলাদেশে এই শ্রমিকদের মজুরি প্রায় তিন গুণ বাড়ালেও, কম উৎপাদন ব্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের মালিকরা এখানেই কাজের বরাত দেবেন। প্রসঙ্গত, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেই কাম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেন-এ হাজার হাজার পোশাক শিল্প-শ্রমিক বেশি মজুরির দাবিতে আন্দোলনে রাস্তায় নামে এবং দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কঠোর হাতে এই আন্দোলনের মোকাবিলা করতে চেষ্টা করায় দীর্ঘ দিনের হুন সেন সরকারের উৎখাতও দাবি করে। বস্তুত, কম মজুরির এবং নিরাপত্তাবিহীন শ্রমিকের চাহিদা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাকের জন্য বিপুল। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ইদানীং কালের নানা বিতর্ক সত্ত্বেও ব্যবসায়িক মুনাফার স্বার্থে বাংলাদেশ নির্বিকল্প। অতএব, সে বাধা অনতিক্রম্য নয়।

শূন্য থেকে

বাংলাদেশে নির্বাচন বা পার্লামেন্ট বয়কটের নজির প্রচুর। ১৯৮৮’তে তদানীন্তন সেনা-শাসক এরশাদ ভোটের আয়োজন করলে বি এন পি তা বয়কট করেছিল। ১৯৯৬’তে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বে ফেব্রুয়ারি মাসে ভোট হলে আওয়ামি লিগ তা বয়কট করেছিল। সেই বছরেরই জুন মাসে শেখ হাসিনার দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় ভোট হলে আওয়ামি লিগ জয়ী হয়। নব্বইয়ের দশকে চালু হওয়া সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে ভোটের ব্যবস্থা ২০১১-এ জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা সরকার বাতিল করে। সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে দ্বন্দ্বের আপাত-মুখ্য কারণ এটা হলেও, সংঘাতের মূল কারণ জানতে চার দশক আগে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ফিরতে হবে।

ইসলাম না বাংলা ভাষা, কোনটি বাংলাদেশ (পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান)-এর অধিবাসীদের আত্মপরিচয়ের মাপকাঠি হওয়া উচিত, বিরোধ ছিল তাকে কেন্দ্র করেই। ইতিমধ্যে প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমান সুকৌশলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করলেও আদি অকৃত্রিম প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। বছর তিনেক আগে, দেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সেকুলারিজমকে পুনরায় গুরুত্ব দেওয়া হলেও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বীকৃতি শেখ হাসিনার আমলেও অক্ষত। এই প্রেক্ষাপটেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার ও শাস্তিবিধান বা ‘মীরপুরের কসাই’ আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ রূপায়ণ বাংলাদেশকে যেন আজ আবার চার দশকের অতীতের মোকাবিলায় বাধ্য করছে। বলপ্রয়োগ ছাড়া এর মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগ কতটা প্রস্তুত? প্রধান বিরোধী দল বি এন পি-ও কি প্রস্তুত জোটসঙ্গী জামাত-এ-ইসলামির সঙ্গত্যাগে? ভুললে চলবে না, বিদেশে, প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোপণ্যে সমৃদ্ধ ধনী আরব দুনিয়ায় বাংলাদেশ থেকে রুজি-রোজগারের সন্ধানে যাওয়া অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিকরা যেমন স্বজনদের টাকা পাঠিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনই উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে এঁরা অনেকেই স্বদেশের ঐতিহ্য ভুলে আরব দেশগুলির ইসলামকেই মুসলমান সমাজের অভিপ্রেত বলে তাঁদের নিকটজনদেরও ভাবতে উৎসাহিত করেছেন। এই নব্য উপায়ীরাই জামাতের মেরুদণ্ড। পেট্রো ডলারের পাশাপাশি এঁরাও বাংলাদেশে কট্টরপন্থী ইসলামের সম্পদবিশেষ।

আধুনিক গণতন্ত্র আগামী দিনের নেতৃত্বকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলেও সহ-নাগরিকদের বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয় না। তাই অনতিবিলম্বে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে কোনও উন্নততর বিকল্প পথ আছে কি?

Source: www.anandabazar.com


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment