বিদ্যুৎ চাই, কিন্তু সুন্দরবনকে ভাসান দিয়ে নয়

বিদ্যুৎ চাই, কিন্তু সুন্দরবনকে ভাসান দিয়ে নয়

মাহির এই প্রথম এসেছে এদিকে। ঢাকা থেকে এতদূর কেউ পিকনিকে আসে না। কিন্তু মাহির আর ওর কিছু বন্ধু ছোট মামাকে ম্যানেজ করে এই ট্রিপটা বাগিয়েছে। বুদ্ধিমান ছেলে সে। বইতে পড়ে তার খুব ইচ্ছে জেগেছে এই জায়গাটায় বেড়াতে আসার। কিন্তু এখানে আসার পর তার নিজেকে বোকা বোকা মনে হচ্ছে। এই প্রথম তার মনে হচ্ছে পাঠ্যবইকে বিশ্বাস করাটা বিরাট ভুল। যে পাঠ্যবইতে টলটলে জল বুকে নিয়ে সবুজ বনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এক নদীর স্বর্গীয় বর্ণনা পড়েছে সে নদীর এমন হাল সে কল্পনাও করেনি। তার খুব অভিমান হলো। কার উপর সে নিজেই জানে না। ছোটমামা এত করে বলেছে এখানে দেখার কিছুই নেই আর, সব শেষ, বইতে ইতিহাস লিখেছে, সে বিশ্বাসই করেনি ছোটমামাকে।

এখন হাড়ে হাড়ে টের পেলো ইউনেস্কো ঘোষিত পৃথিবীর অন্যতম দর্শনীয় স্থানটি ধ্বংসের পথে। এখানে মাইলের পর মাইল মৃত বন, বয়ে চলা নদীর কুৎসিত ময়লাঘন জল, পাখপাখালির কোন চিহ্ন নেই, বাতাসে বিকট অস্বস্তিকর গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন জায়গায় সে একদিনও থাকতে চায় না। কিন্তু আজ ফেরার উপায় নেই। এই রাতটা কষ্ট করে থেকে যেতেই হবে মামার এক বন্ধুর বাংলোয়। রাতে শুয়ে শুয়ে মাহির ভাবছিল, জায়গাটার নাম এখনো সুন্দরবন!

*** *** ***

গল্পটা কাল্পনিক। কিন্তু বাস্তবতা মনে হয় সেই কল্পনাকে ছুঁয়ে ফেলবে অবিলম্বেই। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, আমি রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের প্যাচাল লিখতে বসেছি।

ভারত সরকার যেখানে ২০১০ এ মধ্যপ্রদেশে ন্যাশন্যাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন(এনটিপিসি)এর প্রস্তাবিত রামপালের অনুরূপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব বাতিল করে দেয় সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ এবং জনগণের জীবন হুমকীর মুখে পড়বে এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে। সেখানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড রামপালে ভারতের উক্ত অঞ্চলের দ্বিগুন জনসংখ্যার বসতি আছে জেনেও এনটিপিসির সাথে হাসিমুখে এমন একটি মরনফাঁদে বাগেরহাটের রামপাল তথা দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সঁপে দিলো!

হায় সেলুকাস। এরা নাকি জনগণের জিম্মাদার! জনগণের সুখদুঃখ লাঘবের অঙ্গিকার জলাঞ্জলি দেবার এমন নজির সত্যি বিরল। যারা মানুষের নিরাপত্তা দিতে জানে না তাদের কাছে রামপাল থেকে প্রায় ৯ কিঃমিঃ(সরকারি হিসাবে ১৪ কিঃমিঃ) দূরের ‘সুন্দরবন’ নিতান্তই জঙ্গল বৈ আর কিছু নয়। আর বনের নিরীহ পশু প্রাণীদের নিরাপত্তা রক্ষায় তারা যে সেভাবে সচেষ্ট নন সে তো বহু আগেই প্রমাণিত। নইলে প্রশাসন পিকনিক পার্টি, ডিজেলচালিত ভটভটি ইত্যাদির দ্বারা সংঘটিত নানান ক্রিয়াকর্ম যা বনের প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনাচরনের ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি করে সেসব বন্ধের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা দেখাতো। এসব নির্বিচারেই চলছে। এতসব অত্যাচারের উপরে মহা বিপদ সংকেত হিসেবে ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের’ ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২২শে অক্টোবর।

এই প্রকল্পের অর্থায়নে পিডিবি ১৫%, এনটিপিসি ১৫% আর ৭০% ঋণ নেয়া হবে। যে নীট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০% হারে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে একটা ফর্মুলা অনুসারে। কী সে ফর্মুলা? যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এর দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতি টন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপের সাথে মাওয়া, খুলনার লবন চড়া এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা তে যে তিনটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে চুক্তি হয়েছে পিডিবির সাথে সেখানে সরকার মাওয়া থেকে ৪ টাকায় প্রতি ইউনিট এবং আনোয়ারা ও লবন চড়া থেকে ৩টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে। সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের জন্য কয়লা আমদানির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দিয়ে পিডিবি এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে। এরপর পাবলিক কত করে কিনবে সেটা বলাই বাহুল্য।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে পরিবেশে। আমি পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নেই। তবে বিভিন্ন পত্রিকা ইত্যাদি ঘেটে যা জেনেছি তা হলো –

এ ধরনের কয়লাভিত্তিক প্রকল্প প্রতি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। রামপালের প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা নিঃসন্দেহে মেটানো হবে পশুর নদী থেকে। পশুর নদীর পানি নোনা ও মিঠা জলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রয়োজন মেটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই নদীটির সাথে ওই গোটা অঞ্চলের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের সংযোগ রয়েছে। এটি ওই অঞ্চলের জনবসতির ক্ষেত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী। কিন্তু এই প্রকল্প তৈরি করতে গিয়ে আমরা সেই নদীর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ফেলছি।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করা হবে। ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে ইআইএ রিপোর্টে আশংকা করা প্রকাশ হয়েছে। ড্রেজিং এর ফলে নদীর পানি ঘোলা হবে। ড্রেজিং সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তেল- গ্রীজ ইত্যাদি নিঃসৃত হয়ে নদীর পানির দূষিত হবে। পশুর নদীর তীরে যে ম্যানগ্রোভ বনের সারি আছে তা নির্মাণ পর্যায়ে জেটি নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে কাটা পড়বে। নদী তীরের ঝোপঝাড় কেটে ফেলার কারণে ঝোপঝাড়ের বিভিন্ন পাখি বিশেষকরে সারস ও বক জাতীয় পাখির বসতি নষ্ট হবে। এর পরে আসছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপারেশনে থাকার সময়কার প্রভাব-ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইডও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে।

এনটিপিসিই যখন ভারতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রনির্মাণ করে তখন ‘জিরো ডিসচার্জ’ নীতি অনুসরণ করে অথচ রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে- “পরিশোধন করার পর তরল বর্জ্য বা ইফ্লুয়েন্ট ঘন্টায় ১০০ ঘনমিটার হারে পশুর নদীতে নির্গত করা হবে।” যা গোটা সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করবে। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ২৭৫ মিটার উচু চিমনী থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ফলে আশেপাশের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৭,৫০,০০০ টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে।

কিন্তু আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো, একদিকে বলা হয়েছে এই বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে ব্যাপক দূষণ হবে অন্যদিকে এই ছাই দিয়েই প্রকল্পের মোট ১৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! এই বর্জ্য ছাই- এর বিষাক্ত ভারী ধাতু নিশ্চিত ভাবেই বৃষ্টির পানির সাথে মিশে, চুইয়ে প্রকল্প এলাকার মাটি ও মাটির নীচের পানির স্তর দূষিত করবে যার প্রভাব শুধু প্রকল্প এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই বিপদ সমগ্র সুন্দরবন এলাকার!

আবু ইসহাকের ‘বনমানুষ’ গল্পের কথা মনে আছে? মানুষই আসলে মানুষের সবচে’ বড় ভয় কিংবা বিপদের কারণ হয় সময়ে।বনের হিংস্র পশু ক্ষুধার কবলে পড়লেই মানুষের উপর চড়াও হয়। কিন্তু মানুষ লোভ আর স্বার্থপরতার চুড়ান্তে উঠে বাকী মানুষদের সর্বনাশ করে। কারণ মানুষ নামের এইসব কীর্তিমানেরা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে বসবাসকারী ক্ষমতার বৃত্তে ঘুরে মরা কিছু চোখ সর্বস্ব অন্ধমানুষ। এদের কাছে জনগণ ‘ভাত খেতে পায়না’র অর্থ হলো ‘জনগণ পোলাও খাচ্ছে’র অলীক গালগপ্প। যে কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে রামপালের জনবসতির, সুন্দরবনের কিচ্ছুটি হবে না’র মত অশিক্ষিত প্রচারণা প্রাণ পায়। এইসব স্বার্থান্ধ এলিটদের মাথায় একবারের জন্যও এটা আসে না যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আরো বিকল্প স্থান থাকলেও আরেকটি সুন্দরবন সৃষ্টি করা অসম্ভবের অসম্ভব।

‘সুন্দরবন’ নামটা শুনলে প্রথমেই চোখে ভাসে রাজকীয় ভঙ্গির রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখ, শত শত নাম নাজানা পাখপাখালি, ভীতচোখা হরিণের ঝাঁক, আলসে ভঙ্গির কুমির কিংবা দুষ্টু মিষ্টি বানরের দল। পৃথিবীর সবচে’ বড় এই ম্যানগ্রোভ বনটি আজকে হুমকির মুখে। এমনিতেই আইলা, সিডরে সুন্দরবনের পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপরে আমাদের হাত থাকেনা। কিন্তু, মানুষের সৃষ্ট অনাসৃষ্টি রুখবার ক্ষেত্রে গলা তুলতে পারি। প্রতিবাদে প্রতিবাদে অন্ধের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হতে পারি। সামান্য এই লেখাটি সেই অক্ষম দৃষ্টি আকর্ষণী প্রচেষ্টা। সরকারের সুবুদ্ধির উদয় হোক। বন্ধ হোক সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ। পোস্টারের ছবি দেখে নয়, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি আমার অনাগত সন্তানের হাত ধরে ‘সুন্দরবন আমাদের অহংকার’ এই গর্বের অংশীদার হতে চাই। আমরা বিদ্যুত চাই, কিন্তু তা কিছুতেই সুন্দরবনের অস্তিত্বের বিনিময়ে নয়।

*** *** ***

এবার সূচনার গল্পে ফিরি। আকাশ থেকে তোলা সুন্দরবনের একই এলাকার দুটো ছবি দেখুন।

দুটোর মাঝখানে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধান।

ছবি-১

মাহির ও বন্ধুরা যে ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে ছুটে গিয়েছিল সুন্দরবন।

ছবি-২

মাহির ও তার বন্ধুদের মুগ্ধতা ছুটিয়ে দিয়েছে যে সুন্দরবন।

আমরা কোন সুন্দরবন বেছে নেবো??


Source: আয়নামতি;
http://www.sachalayatan.com/aaynamoti/50316

Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment