ফ্রেডের পাঠশালা

ফ্রেডের পাঠশালা

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী  ভোলা, চরফ্যাশন থেকে ফিরে | তারিখ: ০৮-০৬-২০১৩

নিশ্চিন্ত অবসরযাপন নয়। বর্ষীয়ান এক অস্ট্রেলিয়ান সিদ্ধান্ত নিলেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। ছুটে গেলেন বাংলাদেশের দ্বীপজেলা ভোলার চরফ্যাশনে। পড়ুন বিস্তারিত

ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছে পাশের আখখেত। মাঠের কাদাপানিতে মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাঁসের দল। মাঠ সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে যে টিনের ঘর, সেটি একটি স্কুলই হবে। সামনে খুঁটিতে উড়ছে জাতীয় পতাকা। দরজা আর খিড়কির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পড়ুয়াদের কৌতূহলী চোখ। জোরেশোরে আরেক দফা বৃষ্টি আর বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিল চরফ্যাশনের পশ্চিম আহমেদপুর গ্রাম। আমাদের গাড়ি এসে থেমেছে উঁচু রাস্তাটার ওপরে। ছাতার অপেক্ষা না করেই নেমে গেলেন ফ্রেড।
বছর তিনেক আগে ৯০ পেরোনো মানুষটা কাদা মাড়িয়ে এগোচ্ছিলেন। তাঁর পিছু নিল গ্রামের ছেলেপিলেরা। ফ্রেড, মানে তাদের ‘মিস্টার হাইপ’কে দেখে স্কুলের পড়ুয়ারা আর বৃষ্টির পরোয়া করল না। বেরিয়ে এল সদলবলে। ফ্রেডের চারদিকে ভিড় জমতে সময় লাগল না।
স্কুলের বাচ্চাকাচ্চারা অকারণেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে ফ্রেডের চারপাশে। তাঁর মুখেও হাসির রেশ।
স্কুলের সামনে কচিকাঁচা পড়ুয়াদের মাঝে ফ্রেড। ছবি তোলার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম মুহূর্ত হয় না। আলোকচিত্রী কবির হোসেন ক্লিক করতে ভুল করলেন না।
পুরো নাম ফ্রেডরিক হ্যারল্ড হাইড। অস্ট্রেলিয়ার মানুষ। দ্বীপজেলা ভোলার চরফ্যাশনের এমন হাজারো শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে ফ্রেড পাড়ি দিয়েছেন দুস্তর পথ। তাঁর গড়া সংগঠন কো-ইড (কো-অপারেশন ইন ডেভলপমেন্ট) এই নিভৃত চরাঞ্চলে তৈরি করেছে ৪০টি প্রাথমিক স্কুল। সব কটি স্কুলেই ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখার সুযোগ পায় একদম বিনা মূল্যে। বইপত্র থেকে শুরু করে পড়ালেখার সব উপকরণ এসব স্কুলে মেলে একদম বিনা মূল্যে।
একটা সময় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন ফ্রেড। রিটেইলার হিসেবেও ছিলেন সফল। তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল ভারতীয় উপমহাদেশ সফর। এখানে এসে ফ্রেড যুক্ত হলেন নানা রকম দাতব্য কাজের সঙ্গে। ১৯৮০ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন তিনি। শুরুতে চরফ্যাশনের একটি অনাথ আশ্রমের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। অস্ট্রেলিয়ার একটি সাহায্য সংস্থা এই আশ্রম পরিচালনা করত। এখানকার লোকজনের চরম দারিদ্র্য ফ্রেডকে ব্যথিত করেছিল। ফ্রেড খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত চরফ্যাশনের লোকজনের কষ্ট। নিশ্চিন্ত অবসরযাপনের বদলে ফ্রেড সিদ্ধান্ত নিলেন চরফ্যাশনের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষাই বদলে দিতে পারে এসব মানুষের ভাগ্য।
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের বছরে ফ্রেড দাঁড় করান তাঁর দাতব্য সংস্থা কো-ইড। তিনি একা নন, তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের আরও কিছু দরদি মানুষ।

ফ্রেডের পাঠশালা
‘আমাদের স্কুল ঝড়ে ভাঙে না’ বলার সময় একটুখানি গর্ব কি ঝিলিক দিয়ে গেল আসলাম আলীর মুখে?
পাশ থেকে আমাদের ভোলা প্রতিনিধি নেয়ামত উল্লাহ যোগ করলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্কুল ভেঙে পড়াটা খুব দুর্লভ ঘটনা নয় এই চরাঞ্চলে, কিন্তু ফ্রেডের স্কুলঘর কেন সহজে ভাঙে না?
‘আমাদের সব কটি স্কুলঘরের নকশাই প্রায় এক রকম। টিনের তৈরি। ভিত্তিটা তৈরি হয় খুব মজবুতভাবে। স্কুলগুলোর নকশা করি আমি নিজেই।’ বলতে বলতে ফ্রেড নিজেই দেখালেন পশ্চিম আহমেদপুর স্কুলঘরের বিভিন্ন জায়গা। স্কুলের ভেতরের সাজসজ্জার কোনো একটা অংশ তাঁর পছন্দ হয়নি, সেটাও মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না সঙ্গী আসলাম আলীকে। সেই ১৯৮১ সালে আসলাম আলী দেখা পেয়েছিলেন ফ্রেডের। তারপর আর তাঁর সঙ্গ ছা

ড়েননি। আসলাম আলী এখন কাজ করছেন কো-ইডের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে। এমন অনেকেই আছেন অনাথ আশ্রমে, যাঁদের দেখাশোনা করতেন ফ্রেড, এখন কাজ করছেন তাঁর সংগঠনেই। অনেকেই কো-ইডের স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। এখন শিক্ষকতাও করছেন একই স্কুলে।
‘এলাকার অন্য সব স্কুলের চেয়ে আমাদের স্কুলগুলো ভালো। এখানে স্কুল হওয়ার পর থেকে শিক্ষার হারও বেড়েছে অনেক।’ বলছিলেন পশ্চিম আহমেদপুর কো-ইড ডারউইন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের সহকারী শিক্ষক আবদুল মতিন। ছেলেমেয়েদের অঙ্ক, বাংলা, ইসলামি শিক্ষা—এসব বিষয় পড়ান তিনি।

কচিকাঁচার আসর
কাদা-পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে আমরা উঁকি দিই একটি স্কুলঘরের ভেতর। ভেতরে সারি বেঁধে বসেছে স্কুলের পড়ুয়ারা। বেঞ্চ-টুল সব পরিপাটি সাজানো। অতিথিদের দেখেই একসঙ্গে গলা মিলিয়ে সালাম দিল সব ছেলেমেয়ে। বইপুস্তক সামনে নিয়ে বসে ছিল মো. আজাদ।
স্কুল ভালো লাগে?
আজাদ জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়—লাগে।
স্কুলে পড়তে টাকাপয়সা লাগে?
জে না।
আজাদের পাশেই কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে হাজির রেশমা, মুক্তা, ফাতেমা—তারা সবাই।
কেউ পড়ে ক্লাস ফোরে, কেউ ফাইভে। সবার মধ্যে মিল একটাই, তাদের স্কুলে আসতে ভালোই লাগে।
ডারউইন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের মতোই কো-ইডের স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। ডারউইন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ স্কুলঘরের ভেতরে টানানো একটি নোটিশ থেকেই তার প্রমাণ মিলবে। যেখানে নড়বড়ে বাংলায় লেখা: ‘এই বিদ্যালয়টি আরজে (জিম) ডাইমন্ড বিএসসি (কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি ১৯৩৭) পিএইচডি (ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ১৯৫১)-এর স্মরণে। যিনি একটি গরিব পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষার মূল্যবোধ শিখেছিলেন…জিম-এর ভাই রন এবং তাঁর ভগ্নিপতি হেলেন এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার যাবতীয় খরচের চাঁদাদানকারী।’

আহমেদপুর থেকে আবদুল্লাহপুর
কো-ইডের বেশির ভাগ স্কুলই দুর্গম চরাঞ্চলে। অনেক জায়গাতেই যেতে হয় পানিপথে। কথা ছিল মোটামুটি চরফ্যাশন সদরের কাছাকাছি স্কুলগুলোতেই যাওয়ার। অপেক্ষাকৃত কাছের আবদুল্লাহপুর কো-ইডের স্কুলগুলোর সামনে এসে বোঝা গেল, বাকি স্কুলগুলো ঠিক কতটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মূল সড়ক থেকে থকথকে কাদামাখা রাস্তা চলে গেছে ভেতরের দিকে। জায়গায় জায়গায় হাঁটুপানি। বাকিরা আর নামার চিন্তা করলেন না। কো-ইডের মো. মন্জু আমাকে নিয়ে গেলেন স্কুলের দোরগোড়া অবধি।
স্কুলঘরটা অবশ্য বেশ অক্ষত। বিশেষ কায়দায় বসানো তক্তায় সাবধানে পা ফেলে মোটামুটি নিরাপদেই স্কুলঘরে পৌঁছানো যায়। আহমেদপুরের মতো এখানে একদল উৎসকু কৌতূহলী মুখ।
সবার সামনেই বই-খাতা।
পড়ালেখা কেন ভালো?
তাদের জিজ্ঞেস করি। জবাবে ওরা কেউ খানিক হাসে। একজন আরেকজনের মুখের দিকে চায়। পড়ালেখা যে একটা অসাধারণ ব্যাপার, সেটা তো তারা জানেই। আবার জিজ্ঞেস করার কী?

চরফ্যাশনের জীবন
চরফ্যাশন সদরে একটা পাকা ভবনে কো-ইডের অফিস। ভোলা লঞ্চঘাট থেকে সকাল সকাল আমরা হাজির সেখানে। আসলাম আলী আর মো. মন্জু হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। পেছনেই ফ্রেড।
চোখে চশমা। মাথার সব চুল সাদা। ৯০ পেরোনোর পর শ্রবণযন্ত্র সব সময় ঠিকঠাক কাজ করে না। একটু লজ্জা লজ্জা করে স্বীকারও করে ফেললেন সেটা। ফ্রেডকে তাই আমাদের ‘উদ্দেশ্য’ বোঝাতে সময় লাগল।
প্রতিবছরের মাস ছয়েক সময় চর

ফ্যাশনেই কাটান ফ্রেড। অফিসের সঙ্গে লাগোয়া খুব সাদামাটা একটা ঘরে থাকেন। ‘ঢাকায় ভয়াবহ জ্যাম। অনেক মানুষ ওখানে। এই জায়গা অনেক নিরিবিলি।’ বলেন ফ্রেড।
বিয়ে-থা করেননি।
অবসরে কী করেন ফ্রেড?
কিছুই না। কারণ, অবসর সময়ও ফ্রেডের চিন্তাজুড়ে থাকে স্কুলের জন্য তহবিল সংগ্রহ।
অস্ট্রেলিয়া থাকার পুরো সময়টা এই নিয়েই কাটান।
সেখানে অস্ট্রেলিয়ান শুভাকাঙ্ক্ষীদের পাশাপাশি আছেন বেশ কিছু প্রবাসী বাংলাদেশিও, যাঁরা ফ্রেডের কাজে সহায়তা করছেন নানাভাবে।
১৯৮০ থেকে ২০১৩। কেমন দেখলেন বাংলাদেশ?
‘সে সময় রাস্তাঘাট বলতে তেমন কিছু ছিল না। মনে আছে, ভোলা থেকে চরফ্যাশন আসতে হতো অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে। পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগত। এখন রাস্তাঘাটের অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’ ফ্রেড হাইড বলছিলেন।
কে জানে ফ্রেডের স্কুল থেকেই হয়তো কোনো একদিন কেউ একজন পৌঁছে যাবে এমন এক উচ্চতায়, যেখানে দাঁড়িয়ে সে ফ্রেডের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেবে দেশজুড়ে। ওই আজাদ কিংবা রেশমার চোখগুলো সেই ইঙ্গিতই বুঝি দেয়।
সহযোগিতায়: নেয়ামত উল্লাহ, ভোলা

Link requested by Borhanuddin Shafi


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment