আমার স্বপ্নের ঢাকা ইউনিভার্সিটি
শিরোনাম দেখে ভেবে বসবেন না, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। আমি কখনো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যাইনি। তবু ঢাকা ইউনিভার্সিটি আমার স্বপ্নের। আমার স্বপ্নের সব হিরো, আমার বাস্তবের সব হিরো- ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে কখনো মাতিয়ে রেখেছিল। মনে আছে যেদিন আমি ফেইসবুকে এক আধপরিচিত ছেলের অপরাজেয় বাংলার নিচে গ্র্যাজুয়েশান ক্যাপ ছুঁড়ে দেয়া ছবি দেখেছিলাম, সেদিন ঈর্ষায় আমি জ্বলে গিয়েছিলাম। আমার নিজের বিখ্যাত গ্রেট হল গ্রাজুয়েশানকে কেমন ফিকে মনে হতে লাগলো। আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া প্রেমিককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- তুমি মিছিল দেখেছো? ও বলতো- “দেখবো না কেন? করেছিও।” আমি আমার কাছের মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখি। আমার সামনে একটা জলজ্যান্ত হিরো, যে মিছিল করেছে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইতাম কিভাবে এতোদিন সে কাউকে ভালো না বেসে ছিল। ও বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করতো- আরে কাকে ভালোবাসবো? আমি আরো অবাক হয়ে বলতাম- “কেন? সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরা মেয়েদের। পহেলা বৈশাখে দেখায় না? সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে, চুড়ি পরে আর টিপ পরে।” ও আরো বিরক্ত হয়ে বলতো- “ধুর! যত্তসব খ্যাত!” আমার অবাক লাগতো- ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কিভাবে কোনো খ্যাত পড়বে? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সব বিদ্রোহীরা পড়ে। যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে।
মানুষ বলে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি মুক্ত করতে হবে। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ছাত্রদের গর্জন জড়িয়ে আছে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজনীতিকরণ দেশের জন্যে কতটা ভালো? আমার মনে হয় না পৃথিবীর আর কোনো ইউনিভার্সিটিতে জাতির ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে শহীদ মিনার ধরনের কিছু আছে। যখনই ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা জেগেছে, ওরা ইতিহাস গড়ে দিয়েছে। নিজেদের ক্যাম্পাসে বিদ্রোহের এতো বড় প্রতীক রেখে কিভাবে অরাজনীতিকরণ সম্ভব? বিশ্বজিত হত্যার পর খুনিদের তালিকা দেখে আমি খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম কিভাবে একটা দর্শন পড়ুয়া ছেলে খুন করতে পারে। আমি আমার ফিলোসফি পড়া বন্ধুদের কথা ভাবছিলাম। জীবন সম্পর্কে এতো গাঢ়ভাবে যারা ভাবতে পারে তাদের পক্ষে কিভাবে একটা অপরিচিত কাউকে এভাবে রাস্তায় ফেলে খুন করা সম্ভব? আমার প্রশ্নের জবাব আমি পেয়ে গেছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি কেন এমন, তাও এখন আমি জানি। আমরা সবাই জানি। তাহলে আমি এটা কেন লিখছি?
কিছু সময় আগে, আমার ইউনিভার্সিটিতে একটা বির্তক হচ্ছিল। বিষয় ছিল Oxbridge has failed Britain. সে প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু বলেছিল- “Oxbridge has a duty to reform its internal culture. Oxbridge focuses only on our degree, on our internship, on our job, on our CV points but never on our responsibility. Oxbridge has many internal problems; problems that spill out into rest of the society via its graduates.” এখানে আমি Oxbridge প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সমস্যার সাথে অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজের সমস্যার তুলনা হয়না। কিন্তু, এখানে দুটো পয়েন্ট খেয়াল করার মতো- ১) ঢাকা ইউনিভার্সিটির নিজেকে শুধু একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাবি করে অন্য সব দায়িত্ব থেকে নিজের হাত ধুয়ে ফেলতে চাওয়া সমস্যাযুক্ত ; ২) অক্সব্রিজের মতো ঢাকা ইউনিভার্সিটির সমস্যাগুলোও আমাদের সমাজের সবাইকে ক্ষতি করে, সে আপনি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্কিত থাকুন বা নাই থাকুন।
আমরা সবাই নিউজপেপারে পড়ি শিক্ষক নির্বাচনে দুর্নীতি নিয়ে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাচ্ছে- এই কারণে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন টিচার পাচ্ছিনা। আপনি যদি বাংলাদেশের বর্তমানে ঢাকার নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির টিচারদের যোগ্যতা আর ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচারদের যোগ্যতা বিচার করেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। আমার সাবজেক্টের কথাই বলি- আমি যেখানে প্রাইভেটে কর্নেল, পেনসিলভেনিয়া, কেম্বিজ এবং আরো নাম করা ইউনিভার্সিটির নাম পেয়েছি, সেখানে আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি- পি এইচ ডি না করা সহকারী প্রফেসার! এইখানে হয়তো অনেকে বলতে পারে- কিন্তু প্রাইভেটে টিচারদের বেতন বেশি। আমার মনে হয়না প্রাইভেটে টিচাররা বেশি টাকা পায় বলে পড়াতে যায়। যে ছেলে বা মেয়ে, ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়ার পর দেশে ফিরে আসে, সে অন্তত টাকা কিংবা কাজের অভাবে ফিরে আসে না। ওরা আসেই দেশের জন্যে কিছু করতে। (আমি বলছি না প্রাইভেটে পড়ালে দেশের জন্যে কিছু করা হয়না। আমি বলতে চাচ্ছি, অনেকের ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, সম্ভব হয়না।) যোগ্যতাসম্পন্ন টিচারের অভাবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের মান খারাপ হচ্ছে – তাতে আমার কি? আমার বন্ধুর কথা শুনে সেদিন আমি বুঝেছিলাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে না গেলেও ওদের হাত থেকে আমার নিস্তার নেই।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের জন্যে “থিঙ্ক ট্যাঙ্ক” গড়ার উদ্দেশ্যে। এরাই তো বু্যরোক্রেসিতে থাকবে। সচিব হবে, ব্যাঙ্কার হবে, সুশীল হবে। সমাজের সব পর্যায়ে ওরা যাবে। আর আমাদের দেশের ভবিষ্যত দেশ ফেলে আসা মেধাবী ছাত্রের না, ওদের হাতেই থাকবে। ওদের ক্ষতি মানে আমাদের ক্ষতি। ইউনিভার্সিটির কর্তব্য একটা ডিগ্রি দেয়া না। আমাদের সুশিক্ষিত করা। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এমন একটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে আমাদের সুশিক্ষিত করা হয়। যেখানে মূল্যবোধকে জাগিয়ে দেয়া হয়, যেখানে মানুষ বানানো হয়। ছাত্র রাজনীতি ব্যান করা কোনো সমাধান না, কিন্তু ছাত্রদের সুশিক্ষিত করা সমাধান। যখন তাদের মধ্যে একটা মতাদর্শ থাকবে, তখন তাদের ব্যবহার করা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে কঠিন হয়ে যাবে। লিডার কোনো গাছ থেকে টপকাবে না। লিডার তৈরি করার জন্যে পরিবেশ গড়া লাগবে আগে। এখন সময় হয়েছে “স্বলেহন” বাদ দিয়ে, একবার নিজেদের ইউনিভার্সিটিগুলোর ভেতরকার সংস্কৃতির সমালোচনা করার, পরিবর্তন আনার।
-রাঙা
Source: http://www.sachalayatan.com/guest_writer/50474