আত্মজিজ্ঞাসা অন্যভাবে প্রয়োজন

আত্মজিজ্ঞাসা অন্যভাবে প্রয়োজন

আত্মজিজ্ঞাসা, অন্যভাবে প্রয়োজন

৫ অক্টোবর ২০১৩ প্রথম আলোয় আসিফ নজরুলের ‘অনন্ত জলিল: কিছু আত্মজিজ্ঞাসা’ লেখাটি পড়ার পর কয়েকটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। অনন্ত জলিলকে এবং তাঁর ছবি নিয়ে কিছু শহুরে দর্শকের ঠাট্টা-মশকরা করার প্রবণতা দেখে আসিফ নজরুল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। লেখক অবশ্য উল্লেখ করেছেন যে দর্শক অনন্ত জলিলের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছবিটি দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা তখনই সন্তুষ্ট হন, যখন তাঁর ছবি বহুসংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। আমরা ধারণা করতে পারি, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছবিটির সাফল্য হয়তো ছবির নির্মাতাকে আনন্দিত করেছে। ছবিটি দেখতে যাওয়া বিপুলসংখ্যক দর্শকের সবাই বা অধিকাংশই যে ছবিটিকে কেবল বিদ্রূপই করছেন, সে কথাও সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

প্রেক্ষাগৃহে যেকোনো ধরনের ছবি চলার সময়ই দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ও সাড়া প্রদর্শন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ছবির বিষয়বস্তু এবং উপস্থাপন পদ্ধতির ভিন্নতা অনুযায়ী দর্শকের প্রতিক্রিয়া এবং সাড়াও ভিন্ন হয়। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীতে সর্বজয়ার কান্নায় ভেঙে পড়ে অনেক দিন পর বাড়ি ফেরা হরিহরকে নিজেদের একমাত্র কন্যার মৃত্যুসংবাদ জানানোর করুণ দৃশ্য বা ভিত্তোরিও ডি-সিকার দ্য বাইসাইকেল থিফ ছবিতে নিজের সন্তানের সামনে অন্যের সাইকেল চুরি করে ধরা পড়ার পর বাবার লজ্জিত ব্যথাতুর মুখের দৃশ্য দেখে হলে উপস্থিত কোনো দর্শকই যে হাসবেন না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আবার, কোনো বিখ্যাত কমেডিয়ানের অভিনয় দেখে দর্শকেরা গম্ভীর মুখে হলে বসে থাকবেন, তা-ও ভাবা যায় না। স্টিভেন স্পিলবার্গের দ্য শিন্ডলার্স লিস্ট ছবিতে নাৎসি সেনাদের বীভৎস আর নির্মমভাবে নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করার দৃশ্য দর্শকদের মনে চাপ ফেলবে, তাঁরা অস্থির বোধ করবেন। আর পুরোদস্তুর বিনোদনমূলক কোনো ছবি দর্শকদের জোগাবে মানসিক তৃপ্তি, তা কিছুক্ষণের জন্য তাঁদের বাস্তব জগতের নানা সমস্যা ভুলে যেতে সাহায্য করবে।

অনন্ত জলিলের ছবি দেখতে অনেক দর্শক হলে আসছেন। আবার তাঁর ছবি নিয়ে দর্শকদের হাসাহাসিও চলছে। কোনো ছবি চলার সময় হলে উপস্থিত বহু দর্শক যদি ছবিটির বিভিন্ন দৃশ্য (ট্র্যাজিক দৃশ্যসহ) এবং সংলাপ দেখে কেবলই হাসতে থাকেন বা বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করতে থাকেন, তাহলে দর্শকদের এমন আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে ছবিটির বিষয়বস্তু, সংলাপ এবং নির্মাণশৈলীর নানা দিক নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

অনন্ত জলিলের ছবি বিনোদনমূলক ছবি। আমাদের দেশে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে সমালোচনাধর্মী চলচ্চিত্র কিংবা চলচ্চিত্রভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি এক্সপেরিমেন্টাল ছবির চেয়ে ফর্মুলানির্ভর বিনোদনমূলক ছবিই বেশি নির্মিত হয়। দেশের অন্যান্য বাণিজ্যিক বিনোদনমূলক ছবির প্রতিও কি শহুরে দর্শকেরা একই ধরনের হাসিঠাট্টা প্রদর্শন করে চলেছেন? যদি তা না হয়, তাহলে কেন অনন্ত জলিলের ছবি আসিফ নজরুলের মূল্যায়নে দেশের গড়পড়তা ছবির তুলনায় বেশি আকর্ষণীয় দৃশ্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করার পরও দর্শকদের বিদ্রূপের সম্মুখীন হচ্ছে, সেই প্রশ্নটি নিয়ে ভাবা দরকার। আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা মানুষ নিজেদের শ্রেণী উত্তরণ ঘটানোর তাগিদেই যদি বাংলা বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে তামাশা করবে, তাহলে তারা একই ধরনের অন্যান্য বাংলা ছবি বাদ দিয়ে কেবল অনন্ত জলিলের ছবিই বিদ্রূপ করার জন্য বেছে নিচ্ছে কেন? অনন্ত জলিলের সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করার কোনো চেষ্টা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। অনন্ত জলিলের ‘আর ইউ ফম গানা’ সংক্রান্ত বক্তব্যটির কারণে মানুষের, বিশেষ করে তরুণদের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আসিফ নজরুল তা উল্লেখ করেছেন। এই বক্তব্য এবং আরও বিভিন্ন সময় অনন্ত জলিলের করা নানা মন্তব্যও কি কোনোভাবে তাঁর ছবি এবং ছবির সংলাপকে অনেক দর্শকের কাছে হাস্যাস্পদ করে তুলতে কোনো ভূমিকা রাখছে? আসিফ নজরুল তাঁর লেখায় আমাদের চারপাশে দাপট দেখিয়ে বেড়ানো অসংখ্য ‘অনন্ত জলিল’-এর আচরণ মানুষ মেনে নিচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন। এই দাপট দেখানো মানুষদের ‘অনন্ত জলিল’ আখ্যা দিলে কি প্রকৃত অনন্ত জলিলকেই খাটো করা হয় না?

অনন্ত জলিলের ছবি যেমন এই দেশের অনেক দর্শককে হলে টেনে আনতে সক্ষম, তেমনি তাঁর ছবি দেখে অনেক দর্শকের হাসি বা বিদ্রূপ মেশানো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়লেও তাতে বিস্মিত বা ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন বড় চলচ্চিত্র উৎসবে নানা দেশের বিভিন্ন সুনির্মিত ছবিকেও কখনো কখনো খোলাখুলিভাবে দর্শকদের বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়, যা গতানুগতিক ঘটনা হিসেবেই ধরা হয়। কী করে কোনো ছবিকে আরও নিখুঁত করে তোলার মাধ্যমে দর্শককে বিদ্রূপাত্মক সমালোচনা করার সুযোগ না দেওয়া যায়, একজন নির্মাতা এবং তাঁর সমর্থকদের বরং সেই কঠিন কাজটি নিয়ে ভাবা উচিত। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছবিতে নিজের হূৎপিণ্ড বের করে দেখানোর অতিনাটকীয় দৃশ্যটির অভিনবত্ব নিয়ে কথা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি দৃশ্য চলচ্চিত্রে দেখানো কঠিন কাজ নয়। এমন একটি দৃশ্য এবং প্রযুক্তিগতভাবে আকর্ষণীয় আরও দৃশ্য দেখানোর কারণেই কি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও সমাদৃত করে তুলতে সক্ষম হলো? চলচ্চিত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ প্রদর্শনই কোনো ছবি ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার মূল মাপকাঠি নয়, কারণ প্রযুক্তির চাকচিক্য এবং নিছক বিনোদন মানুষের মনের মুক্তি ঘটায় না।

নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমে অনেক আলোচনা হয়েছে, যার কারণে এই ছবির ব্যাপারে মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের এই ভাবনা এবং আত্মজিজ্ঞাসা প্রয়োজন যে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নত কিন্তু গৎবাঁধা বাণিজ্যিক ছবি, নাকি স্বল্প বাজেটের কিন্তু রাজনীতি ও সমাজসচেতন এবং চলচ্চিত্র ভাষার চিন্তাশীল এবং নান্দনিক প্রয়োগে সমৃদ্ধ ছবি—কোন ধরনের কাজের প্রচার এবং প্রসার আমাদের চলচ্চিত্রকে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত করে তুলতে পারে।

নাদির জুনাইদ: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Source: http://www.prothom-alo.com


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment